27.8 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

অভিবাসী পাখিদের ছন্দে প্রযুক্তির উৎকর্ষ বিপ্লব

Must read

ভাষান্তরে: আহমেদ ইউসুফ আকাশ

পরিবর্তিত ঋতু এবং উপযুক্ত তাপমাত্রার আবাসস্থল খুজে নিতে অভিবাসী পাখিরা নতুন গন্তব্যের পথে ডানা মেলে। বিশেষত উত্তর আমেরিকা এবং কানাডা থেকে দক্ষিণের শীতপ্রধান অঞ্চলের দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবীয় অঞ্চল, এবং ল্যাটিন আমেরিকা তাদের অন্যতম গন্তব্য। আবার কখনও কখনও এসকল অভিবাসী পাখিদের হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে নতুন গন্তব্য বেছে নিতে দেখা যায়। কিছু পাখিদের অস্ট্রেলিয়ার উষ্ণ অঞ্চল, আফ্রিকা, এবং ইউরেশিয়ান অঞ্চল থেকে নতুন গন্তব্যের দিকে ছুটে চলতে দেখা যায়। প্রায় ১৪৩ টি রাডার এবং কিছু সংখ্যক ওয়েদার স্টেশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য প্রদান করেছে পাখি বিশেষজ্ঞরা।

বিংশ শতাব্দীতে পাখি বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তির উৎকর্ষ ব্যাবহার করে এবং প্রাচীনতম ব্যান্ডিং প্রক্রিয়ায় অভিবাসী পাখিদের প্রায় সকল প্রজাতির তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। এতে পাখিদের গতিবিধি নির্ণয় করতে পেরেছেন তারা।

প্রসঙ্গত, বার্ড ব্যান্ডিং হল একটি প্রাচীন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল যা পাখিদের পৃথক অধ্যয়ন এবং সনাক্তকরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এতে পৃথক পাখি সনাক্ত করতে এবং তাদের ট্র্যাক নির্ণয়ে বিজ্ঞানীরা পাখির পায়ে ব্যান্ডটি পরিয়ে রাখেন। যা একটি গাড়ির লাইসেন্স প্লেটের মতো। প্রতিটি অ্যালুমিনিয়াম ব্যান্ড নম্বরের একটি অনন্য সেট দিয়ে খোদাই করা হয়। ১৮০০ সালের শেষ দশকের গোড়ার দিকে, জন জেমস অডুবন নামে একজন বিশেষজ্ঞ তার খামারে প্রথম এ পদ্ধতির ব্যাবহার করেন বলে জানা যায়। ছবি: বার্ড ব্যান্ডিং, সূত্র: ইন্টারনেট।

পাশাপাশি রাডার ব্যবহার এবং ওয়েদার স্টেশন থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা মতামত দিয়েছেন, যখন পাখিরা নতুন গন্তব্যে পাড়ি জমায় তখন এতে আবহাওয়ার ভূমিকা কেমন থাকে কিংবা কতটুকু উচ্চতায় পাখিরা উড়ে বেড়ায় আধুনিক প্রযুক্তি সেটিও নির্ণয়ে সক্ষম।

প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং নতুন উদ্ভাবনের ফলে  সমসাময়িককালে আমরা অভিবাসী পাখিদের বিষয়ে অন্তর্নিহিত তথ্য জানতে পারছি। যেই অভূতপূর্ব দৃশ্যগুলো ইতোপূর্বে বিজ্ঞানীরা জানতেন না৷ অতিক্ষুদ্র ডিভাইসের সাহায্যে বর্তমানে সেই অসাধারণ দৃশ্যগুলো আমাদের সামনে উঠে এসেছে। একইসাথে এসকল নতুন তথ্যগুলো অভিবাসী পাখিদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যেসকল স্থানে পাখিরা নতুন আবাসস্থল হিসেবে পাড়ি জমায় সেখানে প্রকৃতির মসৃণ আবরণ নিশ্চিতেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আমাদের সহায়তা করে।

অভিবাসী পাখিদের রোমাঞ্চকর বিভিন্ন বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ এবং নতুন গবেষণার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ই-বার্ড নেটওয়ার্কের সাহায্যে পাখিবিদরা বিশ্বব্যপী একটি ডাটাবেইজ প্রস্তত করেছে। যেখানে বিজ্ঞানীরা মোটাস নেটওয়ার্ক নামে রিসিভার স্টেশনগুলির একটি বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক স্থাপন করছেন। যার বর্তমানে ৩১টি দেশে ১৫০০টি রিসিভার রয়েছে৷  প্রতিটি রিসিভার ক্রমাগত নয়-মাইল (১৫-কিলোমিটার) ব্যাসার্ধের মধ্যে যে কোনও পাখি বা অন্যান্য প্রাণীর উপস্থিতি রেকর্ড করতে সক্ষম।

ছবি: মেটাস নেটওয়ার্ক, সূত্র: ইন্টারনেট।

এছাড়াও  বর্তমানে এমন গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রযুক্তির ব্যাবহার রয়েছে যেটি পাখি বিশেষজ্ঞদের নতুন ধারণা প্রদান এবং এ সংক্রান্ত গবেষণার নতুন সংযোজনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এরমধ্যে স্যাটেলাইটের ব্যবহার, জিও লোকের ট্যাগ অন্যতম। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পাখিদের গতিবিধি কিংবা দূরত্ব নির্ণয় করা যায়। সম্প্রতি এমন কিছু ভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে প্রযুক্তির সাহায্য, যে বিষয়গুলো ইতোপূর্বে আমাদের জানা ছিলনা। এমনকি একটি পাখি কতদূর পথ পাড়ি দিয়েছে, সেক্ষেত্রে কতবার বিশ্রাম নিয়েছে কিংবা যাত্রাকালে পাখির গতি কমাইল বেগে ছিল সে বিষয়েও বর্তমান স্যাটেলাইটগুলো নিখুঁত তথ্য দিতে সক্ষম।

বার-টেইলড গডউইটস এমনি এক প্রজাতির অভিবাসী পাখি। বকের যেমন গলা লম্বা হয় তেমনি এই পাখির ঠোঁট অনেক লম্বা হয়। প্রজননের সময় এদেরকে অ্যালাস্কা এবং সাইবেরিয়া অঞ্চলে দেখা যায়। ব্যাতিক্রমি দিক হলো, মাইগ্রেশান করা অন্যান্য পাখিদের মধ্যে এরাই একমাত্র পাখি যারা না থেমে অর্থাৎ নন-স্টপ মাইগ্রেশন করে থাকে। সম্প্রতি একটি গডউইটস পাখি আলাস্কা থেকে নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত ১০ দিনে ৮ হাজার ১০০ মাইল (১৩ হাজার কিলোমিটার) পথ বিরতিহীন ভ্রমণ করে রেকর্ড স্থাপন করেছে। সেটেলাইট তথ্য একইসাথে পাখিদের আলাদা বিশ্লেষণ করেছে। প্রতিটি অভিবাসী পাখির শারীরিক গঠন এবং ভ্রমণে অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এমনকি ভিন্নতার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে।

ছবি: বার-টেইলড গডউইটস পাখি, সূত্র: ইন্টারনেট।

তবে অভিবাসনের পথে হুমব্রেল প্রজাতির যেসকল পাখিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয় তারা যখন লেজার এনটিলেস দ্বীপে ভ্রমণ বিরতি নেয়, তখন দুঃখজনকভাবে শিকারীরা এ প্রজাতির কিছু পাখিকে হত্যা করে। এতে কিছু পাখির সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

ছবি: হুমব্রেল পাখি, সূত্র: ইন্টারনেট।

আবার অভিবাসী পাখিদের কিছু ছোট প্রজাতি রয়েছে যাদেরকে সেটেলাইট পদ্ধতিতে গতিবিধি নির্ণয় করা সম্ভব হয়না। কারন পাখিদের অভিবাসনের সময় কর্মক্ষম যাত্রা নিশ্চিতে লোকেটর ডিভাইসটি অবশ্যই পাখির শরীরের ওজনের সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হতে পারবে। বেশিরভাগ অভিবাসী সঙবার্ডসের ওজন শূণ্য দশমিক ৭ আউন্স তথা প্রায় ২০ গ্রাম। তাই তাদের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধান হয়ে ওঠে জিওলোকেটর ট্যাগ। যেই যন্ত্রটি অন্তত নিখুঁতভাবে সময়, পাখির অবস্থান এমনি সূর্যের আলোর উপস্থিত কিংবা অনুপস্থিতিকে নির্ণয় করতে পারে।

ছবি: সঙবার্ড জিওলোকেটর ট্যাগ, সূত্র: ইন্টারনেট।

ভূতত্ত্ববিদরা দেখিয়েছেন যে, ছোট প্রজাতির কিছু সঙবার্ডস রয়েছে যারা উত্তর আমেরিকার বোরিয়াল বনে প্রজনন করে। শরৎকালে আটলান্টিকের উপরে দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দিয়ে তারা আমাজন অববাহিকায় চলে যায়। পূর্ব উত্তর আমেরিকায় প্রজনন করা পাখিরা  কানাডা বা উত্তর-পূর্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আটলান্টিকের উপর দিয়ে এবং বৃহত্তর অ্যান্টিলেস দ্বীপের উপর দিয়ে দীর্ঘ ৬০ ঘন্টা বিরতিহীনভাবে ১৫০০মাইল (২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার) পথ ভ্রমণ করে। সেখানে তারা বিশ্রাম নেয় এবং পুনরায় নিজেদের উজ্জীবিত করে। তারপর ক্যারিবিয়ান থেকে দক্ষিণ আমেরিকার দিকে চলতে থাকে। ব্ল্যাকপোল ওয়ার্বলাররা এসময় সর্বমোট ৬০ দিনের মধ্যে ৬ হাজার ৬০০ মাইল (১০ হাজার ৭০০ কিলোমিটার) ভ্রমণ করে। একইসাথে এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তারা প্রজননেও অংশগ্রহণ করে থাকে।

আরও আবিভূত তথ্য হলো, আরেকটি ছোট প্রজাতির সঙবার্ডস রয়েছে, যারা উত্তর আমেরিকা থেকে সাব-সাহারান আফ্রিকায় চলে যায়।  এসময় তারা ৯ হাজার ১০০ মাইল (১৪ হাজার ৬০০ কিলোমিটার) উড়তে থাকে। এই ভ্রমণে তাদের দীর্ঘ তিন মাস সময় অতিবাহিত হয়। আবার পূর্ব কানাডায় যারা প্রজনন করে তারা পানির উপরে ৪ হাজার ৬০০ মাইল (৭ হাজার ৪০০ কিলোমিটার) আটলান্টিক পেরিয়ে ইউরোপে এবং তারপরে পশ্চিম আফ্রিকায় ২ হাজার ১০০ মাইল (৩ হাজার ৪০০ কিলোমিটার) চার দিনের বিরতিহীন ভ্রমণ করে।

বিশ্বব্যপী একটি উদ্বেগ
অভিবাসী পাখিদের নিয়ে বর্তমানে পৃথিবীব্যাপি নতুন নতুন গবেষণা কর্ম এবং তথ্য উঠে আসছে। বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখি রয়েছে। এসকল পাখিদের মধ্যে ১৮৫৫ প্রজাতিই (প্রায় ১৯%) পরিযায়ী বা অভিবাসি। পাখি পরিযানের অন্যতম দু’টি কারণ হচ্ছে খাদ্যের সহজলভ্যতা আর বংশবৃদ্ধি। অধিকাংশ পরিযায়ী পাখি বসন্তকালে উত্তরে আসে অত্যধীক পোকামাকড় আর নতুন জন্ম নেয়া উদ্ভিদ ও উদ্ভিদাংশ খাওয়ার লোভে। এসময় খাদ্যের প্রাচুর্যের কারণে এরা বাসা বেঁধে বংশবৃদ্ধি ঘটায়।

তবে আবিভূত হওয়ার মতো বিষয় হলো, দীর্ঘ যাত্রায় পাখিরা কিভাবে পথ চেনে! সে এক রহস্য বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মাঝেও বিভিন্ন ধারণা দেখা যায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে পথ চেনাতে অভিজ্ঞ পাখিরাই ঝাঁকের সামনের দিকে থাকে। নতুনরা থাকে পেছনে। এ ক্ষেত্রে পাখিরা উপকূলরেখা, পাহাড়শ্রেণী, নদী, সূর্য, চাঁদ, তারা ইত্যাদির মাধ্যমেই পথ খুঁজে নেয় বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু যেসব পাখি একা ভ্রমণ করে তাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জীবনে প্রথমবার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেও তারা গন্তব্যে পৌঁছে যায়। এ জন্য বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রই পাখিদের পথ চেনায়।

সম্প্রতি নতুন আরেক গবেষণায় জানা গেছে, সমুদ্রের ওপর দিয়ে পাখিরা যখন দীর্ঘপথ পাড়ি দেয় তখন এ কাজে তাদের ঘ্রাণশক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অক্সফোর্ড, বার্সেলোনা ও পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা সমুদ্রগামী পাখিদের ঘ্রাণশক্তি সাময়িকভাবে নষ্ট করে একটি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। এরপর পাখি আকাশে ওড়ার পর তাঁরা দেখতে পান যে পাখিরা ভূমির ওপর দিয়ে ঠিকই উড়ে যেতে পারছে। কিন্তু সমুদ্রের ওপর দিয়ে ওড়ার সময় এরা দিকভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। এতে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, পাখিদের মস্তিষ্কে একটি গন্ধের মানচিত্র রয়েছে। সমুদ্রের ওপর তারা চোখে কিছুু দেখতে না পেলেও গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিকই চলে যেতে পারে।

তবে সর্বপরি অভিবাসী পাখিদের ভ্রমণকালীন সময়ে সম্প্রতি বেশকিছু উদ্বেগের কথা আমাদের সামনে এসেছে। এসময়ে পাখিরা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। এরমধ্যে শিকারীদের হানা, এবং উঁচু দালানের সাথে ধাক্কা লেগে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির মৃত্যুর ঘটনা আমাদের দারুণ ব্যাথিত করে।

ছবি: যুক্তরাষ্ট্রে দালানের সাথে ধাক্কা লেগে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির মৃত্যুর দৃশ্য, সূত্র: ইন্টারনেট।

২০১৯ সালের জরিপ বলছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর বিভিন্ন ভবনের কাঁচের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মারা যাওয়া পাখির সংখ্যা প্রায় একশ কোটি হতে পারে৷ সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরের এক সকালে নিউইয়র্কের ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের আশপাশ থেকে এক ঘণ্টায় ২২৬টি মৃত পাখি খুঁজে পেয়েছিলেন মেলিসা ব্রেয়ার৷ সেই খবর ও ছবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল৷ মেলিসা ব্রেয়ার ‘এনওয়াইসি আডবন’ নামে একটি সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক৷ এই সংস্থার এক গবেষণা বলছে নিউইয়র্কে প্রতিবছর ভবনের কাঁচের সঙ্গে সংঘর্ষে ৯০ হাজার থেকে দুই লাখ ৩০ হাজার পাখি মারা যায়৷

কাজেই আধুনিককালে পাখিদের অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে এবং স্বাভাবিক প্রজননে সহযোগীতা করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। পাশাপাশি পাখিদের বিচিত্র চলাচল ঠিক রাখতে পাখি নিধনে প্রতিটি দেশের সরকারি পর্যায় থেকে সচেতন উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article