28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

বটবৃক্ষের ইতিকথা

Must read

হেদায়েতুল ইসলাম নাবিদ:

ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল এক ছায়াবৃক্ষ আমি। আমার অবিরত শাখা-প্রশাখা আর অজস্র পাতাজুড়ে রয়েছে কালের বিস্তৃত ইতিহাস।

আমি ভীষণ মমতাময়ী অতি উদার এক বৃক্ষ। বিশুদ্ধ অক্সিজেন আর নির্মল ছায়া দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি তোমাদের। উৎসব পার্বণে আমার ছায়াতলে জমে উঠে ব্যতিক্রমি সব আয়োজন। বৈশাখী মেলা, পিঠামেলা, বস্ত্রমেলা কখনওবা ধর্মীয়, কৃষি ও ঋতুভিত্তিক মেলার আয়োজন হয়। আমার ছায়াতলে আশ্রয় নেয় গৃহহীন ও ছিন্নমূলের অসহায় মানুষ। সহায়সম্বলহীন থেকে বিত্তশালী পর্যন্ত সবাই আমার বন্ধু। পরম যত্নে আমি তোমাদের আগলে রাখি। আমি বটবৃক্ষ। আমার বাহুতেই শত প্রাণের অবলম্বন।

উদ্ভিদবিদ্যার দ্বিপদ নামকরণ অনুযায়ী মোরাসিয়া পরিবারের এই বিশালাকার বটবৃক্ষটির বৈজ্ঞানিক নাম ফাইকাস বেঙ্গালেনসিস (Ficus-benghalensis)। এটি চিরহরিৎ সাইকাস বহুবর্ষজীবি বৃক্ষ। এর আদিনিবাস হল বঙ্গভূমি (বাংলাভাষী অঞ্চল)। বটের পাতা একান্তর, ডিম্বাকৃতি, মসৃণ ও উজ্জ্বল সবুজ। ডুমুর ফলের মতো ছোট আকৃতির এই ফল পাকলে নরম ও লাল রঙের হয়। কিন্তু মানুষের জন্য এই ফল খাওয়ার যোগ্য নয়।

বট বাংলা অঞ্চলের আদিমতম বৃক্ষ। বটবৃক্ষকে ঘিরে বাংলা অঞ্চলের রয়েছে শত-সহস্র বছরের ইতিাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন। বটবৃক্ষ নিয়ে বাংলা সাহিত্য ও রচনা লেখা হয়েছে।

আদিমতম বৃক্ষ হিসাবে বটবৃক্ষ বাঙালির জীবনে শত-সহস্র বছর ধরে সামাজিক, সৃংস্কৃতি, ধর্মীয় ও সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত। আমাদের সমাজে এখনও প্রবীণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, বাঙালিরা গর্বের সাথে বটবৃক্ষ শব্দটি ব্যবহার করে। অর্থাৎ এটি একটি রুপক সম্মানসূচক অর্থ বহন করে। যিনি বটবৃক্ষের ন্যয় একটি পরিবার কিংবা সমাজকে সকল অনিষ্ট থেকে স্বযত্নে পথনির্দেশনা দেন।

বট বৃক্ষকে ঘিরে বাংলা অঞ্চলে রয়েছে নানান ঐতিহ্য, এখনও ছায়ানটের বাংলার পহেলা বৈশাখের নববর্ষ বরণ বটবৃক্ষের তলায় হয়। নানা উপকারিতা ও ধর্মীয় গুরুত্বের কারণে বটবৃক্ষ ভারতের জাতীয় বৃক্ষ।

উষ্ণ আবহাওয়ায় বিশাল আয়তনের এই ছায়াবৃক্ষটি আমাদের নানা উপকারে আসে। প্রাচীনকাল থেকেই বটবৃক্ষের ছায়ায় হাট-বাজার বসত, মেলা হত, লোকগানের আসর বসত, জনসভার আয়োজন হত। কারণ বাংলার গ্রামাঞ্চলে বড় কোন সুশীতল হলরুম ছিলনা। আর তাই আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান ও জনসভাগুলো ছায়া সুনিবিড় বটতলায় অনুষ্ঠিত হতো।

বট গাছের ফল কাক, শালিক ও বাদুড়ের প্রিয় খাদ্য এবং শকুন ও এ জাতীয় পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বটের নানা রকম উপকারিতা রয়েছে। এর কষ থেকে নিম্নমানের রাবার তৈরি হয় এবং বাকলের আঁশ দড়ি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার্য। এর পাতা কুষ্ঠরোগে উপকারি। এছাড়াও ঔষধি গুণাগুণ সমৃদ্ধ বটের আঠা পায়ের ফাটা নিরাময়ে প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহার হয়। বটের ছাল দেহের মেদ কমায়। হাড় মচকে গেলে এর ছাল বেটে গরম করে মালিস করলে নিরাময় হয়।

কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুরের জন্য বটবৃক্ষ হয়ে উঠে জীবনরক্ষকারী আশ্রয়স্থল হিসাবে। অর্থাৎ যাকে বলা হয় অসহায়ত্বের শেষ অবলম্বন। কারণ দিনভর অক্লান্ত পরিশ্রম করে রোদে পুড়ে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যখন তারা জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন বটবৃক্ষের ছায়া তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে তৃণমূল ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য বটবৃক্ষের উপকারিতা অনস্বীকার্য। তবে এতসব উপকার কিংবা সমৃদ্ধির কথা ক্রমেই রুপকথার সাথে মিশে যাবার পথে। এক দশক আগেও বটগাছের এমন সৌন্দর্য আমাদের পথে প্রান্তরে কিংবা সবুজ মাঠের পাশে দেখা মিলত।

কিন্তু প্রতিনিয়ত বৃক্ষ নিধন বটবৃক্ষের জন্য হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। জনসংখ্যার চাপ, শিল্প-কারখানা ও নগরায়নের কারণেই মূলত নির্বিচারে বৃক্ষনিধন করা হচ্ছে। ফলস্রুতিতে হাজার বছরের পুরনো বটবৃক্ষগুলো আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অচিরেই।

সমাজ এবং আমরা বড় নিষ্ঠুর সময়ের ইন্দ্রজালে বন্দি। যে বটগাছ আমাদের আগলে রেখেছিল আমরা ক্রমেই সেটিকে ধ্বংস করেছি। তাই এখন সময় এসেছে জাগ্রত হবার। জাগাতে হবে আমাদের বিবেক। শুধু বটবৃক্ষ নয়, যুগ যুগ ধরে যে বৃক্ষগুলো আমাদের উপকারী বন্ধু হয়ে আগলে রেখেছে, আজ সময় এসেছে তাদের আগলে রাখার। কাঠ ফাটা রোদ থেকে এতদিন আমরা ছায়া পেয়েছি, মায়া পেয়েছি। আজ আমাদেরই বৃক্ষ হয়ে তাদের ছায়া দিতে হবে, মায়া দিতে হবে। কোনো কুঠার নয়, কোনো করাত নয়, মানুষ হয়ে উপকারীর উপকারিতা স্বীকার করে বৃক্ষ বাঁচাতে আমাদেরই আজ বৃক্ষ হতে হবে। দিতে হবে বন্ধুত্বের পরিচয়। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article