তানভীর হোসাইন:
বর্তমানে প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) শব্দটি খুবই পরিচিত। শব্দটির সাথে অনেকের পরিচিতি থাকলেও এর কার্যপ্রণালী সম্পর্কে জানেনা এমন মানুষও কম নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসলে কি? কিভাবে এটি কাজ করে সে সম্পর্কেই আজকে জানার চেষ্টা করবো।
সাধারণ অর্থে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হলো মানুষের পরিবর্তে মানুষের দ্বারা তৈরী একটি ব্রেন বা সফটওয়্যার যেটি মানুষের কাজকে সহজ করে দিয়েছে বহুগুণে। আরেকটু ব্যখ্যা করে বলতে গেলে, এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা জ্ঞান আহরণ করে শুধু তাই নয় বরং আহরণকৃত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে শুরু করে সমস্যা সমাধান ও নতুন কোন আইডিয়া তৈরী করাসহ আরো অনেক কাজ করতে পারে। তাছাড়া এটি মানুষের অনুভূতি, আনন্দকেও বুঝতে পারে ঠিক মানুষের মত। সাথে আরো আছে বস্তুগত ও অবস্তুগত বিষয়ের মাঝে সম্পর্ক নির্ধারণ করতে পারার যোগ্যতা।
এক বাক্যে বলতে গেলে মানুষের ব্রেনের মতই বিকল্প আরেকটি ব্রেণ।
বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। যেমন ধরুন, আজকের দিনে মানুষের নিত্য দিনের অনেক কাজ করে দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। যার প্রভাবে আমাদের অনেক কাজের চাপ যেমন কমেছে তেমনি বেশ সংখ্যক মানুষ তাদের চাকুরীও হারিয়েছে। শুধু তাই নয় আমাদের কাজের জটিলতাকেও কমিয়ে দিয়েছে বহুগুণে এবং সময় সাশ্রয়েও বড় ধরণের প্রভাব ফেলছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। উদাহরণস্বরূপ কোন একটি পণ্যের বিজ্ঞাপন দিতে চান তখন সেই নির্দিষ্ট ব্যাক্তিকে খুঁজে বের করা আপনার জন্য কষ্টসাধ্য বিষয়। কিন্তু যদি আপনি সেই বিজ্ঞাপনটি সোসাল মিডিয়া গুলোতে দেন তখন সেই পণ্য পছন্দকারীর সামনে অটোমেটিক পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হবে আপনার কোন ধরণের অতিরিক্ত কষ্ট করা ছাড়াই।
তাছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কার্যক্ষমতা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এটি একটি যান্ত্রিক ব্রেন হওয়া সত্বেও অনেকক্ষেত্রে মানুষের ব্রেনের চেয়েও বেশি ধূর্ততার সাথে কাজ করে থাকে। অর্থাৎ একটি নিখুঁত কর্মযজ্ঞ সম্পাদনে এ ব্যবস্থা যথেষ্ট ক্রিয়াশীল।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতির ক্রমবিকাশের ফলে মানুষের মঝে এক ধরনের আতংকও লক্ষ্য করা যায় যে, অদূর ভবিষ্যতে কি তাহলে এটি সম্পূর্ণভাবে মানুষের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে? সকল কাজ কি তাহলে যন্ত্রই সমাধান করবে? যদি তাই হয় তাহলে মানুষের কর্মসংস্থানের পরীধি অনেকাংশে সংকুচিত হয়ে যাবে। তবে আরেকটি ভালো দিক হলো যেমন কিছু ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ কমেছে তেমনি টেকনোলজিক্যাল কাজে অভাবনীয়ভাবে কাজের সুযোগও বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। তবে কাজের সুযোগ কমেছে কি বেড়েছে সেটা আজকের আলোচনার বিষয় না সেটা নিয়ে অন্য কোন দিন কথা বলা যাবে। আজকে বরং আমরা জনবো এর কাজের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে।
এআইের (Ai) মূল ভিত্তি হলো এটি সময়ের সাথে সাথে নিজেদের উন্নতি ঘটাতে পারে এবং নিজেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাকে বলা হয় মেশিন লার্নিং। তবে সাধারণ সফটওয়্যার ও এআই’র (AI) মাঝে পার্থক্য হলো এআই নিজেই নিজেকে নিয়মিত দক্ষ করে তুলে যেখানে সাধারণ সফটওয়্যার একজন প্রোগ্রামারের লেখা কোড অনুসারে কাজ করে থাকে। প্রোগ্রামার যে কমান্ড দিবেন তার কাজ তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শিখার মূল বা মূখ্য বিষয় হলো “তথ্য”। আর মেশিন লার্নিং এলগরিদমের মাধ্যমে কম্পিউটারকে শিক্ষা দেয় কিভাবে তথ্য নীরিক্ষা করে কোন নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধান করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, ক্লাসিফিকেশন এলগোরিদম ব্যবহার করা হয় মানুষের হাতের লেখাকে সনাক্ত করে সেটাকে আলাদা করতে। হাউজিং ডাটা সেট যেটি রিগ্রেশন এলগরিদম ব্যবহার করে পূর্বে বিক্রি হওয়া প্রপার্টির মূল্যের উপর ভিত্তি করে নতুন একটি দাম ঠিক করে।
মেশিন লার্নিং প্রথমে বিচ্ছিন্ন অনেকগুলো তথ্যকে সংগ্রহ করে তারপর প্রক্রিয়া করে সেই তথ্য দিয়ে একটি নিজস্ব মডেল তৈরী করে নেয় যাতে করে একটি সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারে। আপনি যদি টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখে থাকেন তাহলে লক্ষ্য করলে দেখবেন সেখানে একটি প্রেডিকশন করা হয় যে, একটি দল জেতার সম্ভাবনা আছে ৭৮% এবং অন্য দলের ২২%। এই প্রেডিকশনটি করতে প্রথমে মেশিন পর্যাপ্ত তথ্য, যেমন রিকয়ার রেট, উইকেটস ইত্যাদি, সংগ্রহ করে তারপর সেই তথ্য দিয়ে একটি অনুমানের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। যেমনটি আমরা যখন খেলা দেখি তখন অনুমান করি এই দলটি জেতার বা হারার সম্ভাবনা আছে। এই একই অবস্থা ঘটে, মার্কেট রিসার্চ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর আচরণ কিংবা কোন প্রতিষ্ঠানের লোকদের পরিসংখ্যান করার ক্ষেত্রে।
ডাটার ২ ধরনের উপদান রয়েছে— নমুনা ও বৈশিষ্ট্য।
ফেসবুক ব্যবহারকারীরা হলো স্যাম্পল আর তাদের ব্যবহারের ধরণ হলো বৈশিষ্ট্য। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে যেমন রয়েছে ভিন্নতা তেমনি তাদের পছন্দের মধ্যেও রয়েছে ভিন্নতা। ব্যবহারকারীর পছন্দের উপর নির্ভর করে তাদের সামনে প্রদর্শিত হয় বিভিন্ন ধরণের বিজ্ঞাপন, ছবি, বিডিও বা খবর। আপনি যদি লক্ষ্য করেন, আপনি যে জিনিসটি আজকে বেশি দেখছেন আগামী দিন সেই ধরণের জিনিসই আপনার সামনে বেশি প্রদর্শিত হবে কোন ধরনের অনুসন্ধান করা ছাড়াই।
তাছাড়া মিচুয়াল ফ্রেন্ডের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটে। যাদেরকে আপনি চিনেন তাদের প্রোফাইল গুলোই ঘুরেফিরে আপনার সামনে প্রদর্শিত করা হয় যাতে করে আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে পারেন। এভাবেই আপনার নেটওয়ার্কের পরিধি বৃদ্ধি পায় যার পিছনে কাজ করে থাকে এআই (AI)।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়াও বিভিন্ন শিল্পকারখানার কার্য সম্পাদন করার প্রক্রিয়াকে পর্যবেক্ষণ করা ও সেখানে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ গুলোর কোন যন্ত্রটি বেশি ব্যবহার হচ্ছে সেটির পর্যবেক্ষণ করাও এআই করে থাকে।
এই সকল ভিন্ন ভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে মেশিন তথ্যের উপর নির্ভর করে এবং সেই তথ্য দিয়ে মেশিন নিজেকে শিখায় নিজস্ব একটি সিদ্ধান্তে পোঁছতে।
একবার তথ্যকে বুঝে নেওয়ার পর মেশিন সিদ্ধান্ত নেয় যে এই তথ্য দিয়ে কি করা হবে। মেশিন লার্নিং এর সবচেয়ে সাধারণ বিষয় হলো এর কাজকে ভাগ করে নেয়া। এ পদ্ধতি শিখে নেয় কিভাবে তথ্য গুলোকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে রাখা যায় এবং সময় সময় সে তথ্যকে কাজে লাগানো যায়।
এআই সরাসরি আমাদের দৈনন্দিন কাজের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। হোক সেটা কোন পণ্য পছন্দ করার ক্ষত্রে বা পছন্দের কোন মুভি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। যখন কেউ ময়েশ্চারাইজার পণ্য, যেমন লোশন, সাবান, পাউডার ইত্যাদি, ক্রয়ের সময় সেই পণ্যের ঘ্রাণ, ব্রেন্ড, বা কোন দেশের পণ সেটার দিকে লক্ষ্য করে তারপর সব ঠিকঠাক মত হলে সেটা ক্রয় করে এবং সেই পণ্যের পূর্বের ব্যবহারের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারে পণ্যটি ভালো না খারাপ। সেই একই ক্ষেত্রে কোন একটা সিনেমা দেখার পূর্বেই অভিনেতা ও পরিচালক সম্পর্কে জানার মাধ্যমে সিনেমা সম্পর্কে বলে দিতে পারে ভালো না খারাপ।
এই দুটি উদাহরণে পণ্যের গ্রাণ, ব্রেন্ড, দেশ এবং সিনেমার অভিনেতা ও পরিচালককে জানার মাধ্যমে বিচার করতে পারে। এভাবে এআইও আমাদের পছন্দ গুলোকে পূর্বের পছন্দ অনুযায়ী পরিমাপ করতে পারে এবং আমাদের পছন্দ অনুসারে সেই বিষয়গুলো প্রদর্শন করে থাকে। আর এগুলো সম্ভব হয় আমাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার মাধ্যমে।
কিন্তু আমরা এই তথ্যগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে আমাদের তথ্য বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ অথবা একজন দক্ষ গণিতবিদ ও পরিসংখ্যানবিদ হওয়ার পাশাপাশি প্রোগ্রামিংয়ে দক্ষ হওয়ার দরকার প্রয়োজন ছিল। যেটি এআই সময়ের সাথে সাথে নিজেদের কে দক্ষ করে তুলে আমাদের কাজকে সীমিত করে দিচ্ছে ।
আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে কোন মানুষর সাথে প্রথমবার সাক্ষাৎ করলেই সেই মানুষটি সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা আমাদের মাঝে তৈরি হয়। তার রুচি, পছন্দ, ভাললাগা, আচরণ সম্পর্কে একটা ভাসা জ্ঞান লাভ করে থাকি। সময়ের সাথে সাথে যখন তার সাথে পথচলা আরও দীর্ঘ হয় তখন তার সম্পর্কে আরও গভীর ধারনা লাভ করে থাকি।
তেমনি একজন ব্যবহারকারী, সেটা হতে পারে গুগুল, ইয়ুথওয়েব, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি তারা যখন প্রথমবার কোন এপ্লিকেশন ব্যবহার করে তখন তাদের রুচি, পছন্দ ও বুঝতে পারে এআই। সেই অনুযায়ীই তাদেরকে সার্ভিস দিয়ে থাকে।
লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।