হাছান আল মাহমুদ:
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের একটি বাড়িতে থাকতেন ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু পরবর্তী সময় থেকে দীর্ঘদিনের আল-কায়েদা প্রধান আয়মান আল-জাওয়াহিরি। ৩১ জুলাই সূর্যোদয়ের ঠিক এক ঘন্টার পরে বাড়িটির ব্যালকনিতে প্রার্থনা বা নামাজ পরবর্তী নিয়মিত অভ্যাসের অংশ হিসেবে বারান্দায় হাটাহাটি করছিলেন প্রবীণ এই মিশরীয় জিহাদি এবং এটিই তার জীবনের শেষ মুহূর্ত ছিল বলে ধারণা করা হয়।
স্থানীয় সময় ভোর ৬ টা ১৮ মিনিটে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র বারান্দায় আছড়ে পড়ে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ক্ষেপণাস্ত্রটি থেকে ছয়টি ব্লেড বের হয়ে ৭১ বছর বয়সী এ প্রবীণ নেতাকে হত্যা করে। কিন্তু ঘরে থাকা তার স্ত্রী ও কন্যার গায়ে একটি আঁচড়ও লাগেনি। এয়ার স্ট্রাইকটির ফলে ব্যালকনি ছাড়া ঘরের অন্য কোথাও তেমন ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন নেই বলে জানা গেছে।
এর আগে লক্ষ্যবস্তু ত্রুটির কারণে অনেক বেসামরিক মানুষকে হত্যার জন্য মার্কিনদের সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু সকল সমালোচনাকে পেছনে রেখে এবারে এক নতুন ইতিহাসের কধা জানালো হোয়াইট হাউস। তাদের এবারের মিশনটি এত নিখুঁতভাবে আঘাত করা কিভাবে সম্ভব হলো? ক্ষেপণাস্ত্রটি কোন ধরণের ছিল? কিংবা জাওয়াহিরির নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাসের উপর মার্কিন গোয়েন্দাদের এত নিবিড় পর্যবেক্ষণ কীভাবে সম্ভব হয়েছে? এসকল একেকটি প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের হয়তো আরও অপেক্ষার প্রয়োজন।
নিখুঁত লেজারের ব্যবহার:
হামলায় ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্রটি অন্যসব ক্ষেপণাস্ত্র থেকে ভিন্ন ধরণের ছিল। মার্কিন কর্মকর্তারা এগুলোকে ড্রোন-চালিত হেলফায়ার বলেছিলেন যা এক ধরনের এয়ার-টু-সারফেস ক্ষেপণাস্ত্র। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযানে নিয়মিত এই ক্ষেপণাস্ত্রটির ব্যবহার শুরু হয়।
হেলিকপ্টার, স্থল যানবাহন, জাহাজ এবং ফিক্সড উইং এয়ারক্রাফ্টসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে ক্ষেপণাস্ত্রটি নিক্ষেপ করা যায়। কিংবা জাওয়াহিরির ক্ষেত্রে একটি মনুষ্যবিহীন ড্রোন থেকে।

২০২০ সালের প্রথম দিকে বাগদাদে ইরানী জেনারেল কাসেম সোলেইমানি এবং ২০১৫ সালে সিরিয়ায় “জিহাদি জন” নামে পরিচিত ব্রিটিশ বংশদ্ভূত ইসলামিক স্টেটের জিহাদীকে হত্যা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হেলফায়ার ব্যবহার করেছিল বলে ধারণা করা হয়। হেলফায়ারের ব্যবহারের প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে এর নির্ভুল টার্গেট।
শত শত মাইল দুরে থেকেও অস্ত্রটি পরিচালনা করা সম্ভব। এমনও হতে পারে যে যখন কোনো ড্রোন থেকে এটি উৎক্ষেপণ করা হয় এর অপারেটর হাজার মাইল দূরের অ্যামেরিকায় বসে এটি পরিচালনা করছেন এবং এর মধ্যে থাকা ক্যামেরা সেন্সরের মাধ্যমে লাইভ ফিডব্যাক পাচ্ছেন। স্ক্রিনে “টার্গেটিং ব্র্যাকেট” এর মাধ্যমে ক্যামেরা অপারেটর লক্ষ্যবস্তুকে ‘লক আপ’ করে এবং একটি লেজার রশ্নি তাক করে। ক্ষেপণাস্ত্রটি নিক্ষেপের পর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত না করা পর্যন্ত এটি সেই লেজারের পথ অনুসরণ করে।

জাওয়াহিরির ক্ষেত্রে মনে করা হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র R9X নামে হেলফায়ারের একটি তুলনামূলকভাবে অপরিচিত সংস্করণ ব্যবহার করেছে। যা তার গতিশক্তি ব্যবহার করে ছয়টি ব্লেড দিয়ে লক্ষ্যবস্তুকে মুহুর্তের মধ্যে টুকরো টুকরো করে ফেলে।
২০১৭ সালে সিরিয়ায় আরেক আল-কায়েদা নেতা এবং জাওয়াহিরির একজন ডেপুটি আবু খায়ের আল-মাসরি R9X হেলফায়ারের আঘাতে নিহত হয়েছেন বলে জানা যায়। স্ট্রাইকের পরে তোলা তার গাড়ির ছবিগুলোতে দেখা যায় যে ক্ষেপণাস্ত্রটি বিস্ফোরণ বা গাড়িটিকে ধ্বংস করা ছাড়াই শুধুমাত্র ছাদে একটি গর্তের মাধ্যমে এর যাত্রীদের আঘাত করা হয়েছে।
জাওয়াহিরির উপর মার্কিন গোয়েন্দাদের নজর:
স্বভাবতই মার্কিনিরা কোনো অভিযান পরিচালনা করার আগে টার্গেট সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। জাওাহিরির ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম ছিলনা।
হামলার পর মার্কিন কর্মকর্তারা জানান যে তাদের কাছে জাওয়াহিরির নিয়মিত বারান্দার অভ্যাস ছাড়াও তার জীবনের ধরণ বোঝার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য ছিল। এ থেকে বোঝা যায় যে, মার্কিন গোয়েন্দারা কয়েক মাস না হলেও কয়েক সপ্তাহ ধরে বাড়িটি পর্যবেক্ষণ করছিল।
সিআইএ-এর প্রাক্তন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মার্ক পলিমেরোপোলস জানিয়েছেন যে, সম্ভবত স্ট্রাইকের আগে বিভিন্ন ধরণের গোয়েন্দা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে মাটিতে থাকা গুপ্তচর এবং সিগনাল ইন্টেলিজেন্স।
কেউ কেউ মনে করেছেন যে মার্কিন ড্রোন বা বিমানগুলি কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে তাকে পর্যবেক্ষণ করেছিল যা সাধারণ কেউ নিচে থেকে দেখেনি বা শোনেনি।
পলিমেরোপোলস আরও জানান, এ হামলাটিতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কয়েক দশক ধরে আল-কায়েদার ব্যক্তিত্ব এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তু খুঁজে বের করার অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে।
যাইহোক, এই ধরনের মার্কিন অপারেশনগুলো সবসময় পরিকল্পনা অনুযায়ী হয় না। ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট কাবুল বিমানবন্দরের ঠিক উত্তরে একটি গাড়িতে ড্রোন হামলা করা হয়েছিল, এতে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর একটি স্থানীয় শাখাকে লক্ষ্য করার পরিবর্তে ১০ জন নিরীহ লোককে হত্যা করেছিল। পেন্টাগন তখন স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছিল যে এটি ‘দুঃখজনক’ একটি ভুল হয়েছে। যেই ভুলটি তারা জাওয়াহিরির ক্ষেত্রে করেনি।
তবে জাওয়াহিরির মৃত্যুর পর একটি বিতর্ক রয়ে গেছে। সেটি হল, ২০১১ সালে বিন লাদেনকে হত্যা করে তার লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার দাবি করে আমেরিকা। যদিও সেই অভিযানের কোনো বিশ্বাসযোগ্য ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করেনি হোয়াইট হাউজ। এবারের জাওয়াহিরিকে হত্যার অভিযানেরও একইরকম কোনো বিশ্বাসযোগ্য ছবি কিংবা ভিডিও প্রকাশ করেনি তারা। দেশটির সমর্থিত বিভিন্ন গণমাধ্যমে গ্রাফ এঁকে যে বক্তব্য দিয়েছে, জাওয়াহিরি রোজ সকালে ফজরের নামাজ সেরে বারান্দায় পায়চারি করতেন। সেখানেই বিশেষ ক্ষেপণাস্ত্র তাকে আঘাত করে। বাড়ির অন্যদের কিছু হয়নি। যত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার পুরোটাই বারান্দার ঠিক মাঝের জায়গা জুড়ে। তাহলে তার স্ত্রী-সন্তানরা এখন কোথায়?
আবার জাওয়াহিরি যে বাড়িতে ছিলেন, ওই বাড়ির কয়েকটি ছবি প্রকাশ হয়েছে। একটিতে ভাঙা জানালা দেখা গেছে, অন্যটি ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। আরেক ছবিতে ধোঁয়া উড়তে দেখা যাচ্ছে। ছবিটি বেশ দূর থেকে তোলা। বলা হচ্ছে, হামলার পর ওই বাড়ি থেকে ধোঁয়া উড়ছে। নিনজা ক্ষেপণাস্ত্রে বিস্ফোরকের বদলে বিশেষ ছয়টি ব্লেড থাকে। তাহলে ধোঁয়া এলো কীভাবে? এভাবে নানা অসংগতি তুলে ধরছেন বিশ্লেষকরা।
তথ্যসূত্র: বিবিসি