আহমেদ ইউসুফ আকাশ:
আমরা একসময় আদিম ছিলাম। সভ্যতা কি জিনিস, তা আমরা জানতাম না। যুগের পরিবর্তন হল। নানাবিধ অভিজ্ঞতা এবং চাক্ষুষ পরিবর্তন আমাদের নতুন কিছু জানতে এবং মিলিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করল। তবে আদিম থাকলেও সেই অবস্থায় নৈতিকতা বলতে কিছু একটা যে আছে, এই জ্ঞান আমাদের ছিল। সময় যখন গড়াতে লাগল, আমাদের বস্তুগত এবং ভাবগত উভয় দিকেই উৎকর্ষ সাধিত হল।
একটা সময় স্থির হল, উত্তম আচরণ এবং সুন্দর মননশীলতার মূল্য রয়েছে। সেটি সম্পদের চেয়ে ঢের বেশি হিসেবে নির্ণীত হয়। কারণ অবশিষ্ট সম্পদ ব্যায় করেই আমরা আচরণ এবং মননশীলতা কদর করতে থাকলাম। এরও কিছু বিশেষ কারণ রয়েছে। যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক আচরণ এবং ভিন্ন কৌশল বিভিন্ন গোত্র কিংবা সম্প্রদায়কে অধিক সম্পদ অর্জনের পথ সুগম করে দেয়। ফলে এই মননশীলতা কিংবা কৌশল রপ্ত করতে আমরা অবশিষ্ট সম্পদ ব্যায়ে কুণ্ঠাবোধ করিনি। বরং এই প্রক্রিয়াটি একপ্রকার বিনিয়োগ ধারণার রুপ লাভ করে।
ফলে আমাদের নৈতিক চর্চাও বাড়তে লাগল। একসময় নৈতিকতা বিষয়টি জ্ঞানের একটা স্বতন্ত্র শাখায় রুপ নিল। এটিকে বংশ-পরম্পরায় পৌঁছে দেবার জন্য আমরা একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করলাম। যে জানে, সে যারা জানে না তাদেরকে জানাবে। আমরা এর নাম দিলাম ‘শিক্ষা’। যখন আমরা ধর্মের সাথে পরিচিত হলাম, তখন তা পত্র পল্লবে সুশোভিত হয়ে উঠল। ধর্ম আমাদেরকে নৈতিকতার সর্বোচ্চ সবক দিল। আমরা আমাদের ‘শিক্ষা’ নামক পদ্ধতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলাম। গড়ে তুললাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই গাছের তলা থেকে রাজকীয় বিল্ডিং এ পৌঁছলাম। আমাদের নৈতিকতার শিক্ষাও এগুতে লাগল সমান তালে।
পরবর্তী দৃশ্যপটে এটুকু স্থির হল, একটি জাতির পরিচয় তার শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নের ওপর নির্ভর করবে। এটির প্রাতিষ্ঠানিক কোন স্বকৃীত না থাকলেও প্রতিযোগিতামূলক পদক্ষেপে এটিকে মনস্তাত্বিক ভাবে আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হলাম। পরবর্তী স্তরে নির্ণীত হল, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে যে জাতি যত এগিয়ে যাবে, সে দেশ বা জাতি তত উন্নত হবে। এমনকি ক্রমেই মানবসম্পদ উন্নয়নের সর্বপ্রথম ধাপ শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত হতে থাকল।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডের স্বাধীনতা এবং পরবর্তী রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশলে আমরা নিজেদেরকে এই শিক্ষা অর্জনের দিকে ধাবিত করলাম। এমনকি স্বাধীনতা অর্জনের জনগনের মূল ইচ্ছাশক্তির অন্যতম উপাদান হিসেবে শিক্ষা প্রধানতম উপলক্ষ ছিল। সেখানে সমান শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রের সুবিধা আমাদেরকে স্বাধীনতা অর্জনের পথে এগিয়ে দেয়।
কিন্তু এই একই পথে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমরা কতটুকু এগিয়ে যেতে পেরেছি। আদতে আমরা শিক্ষা অর্জন করার পরে সেটির মান নিশ্চিতে কতটুকু মনোনিবেশ করেছি? কতটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছি? এ প্রশ্নটির উত্তর মিলবে যখন প্রতিবছর আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্ব র্যাংকিংয়ে অবস্থান যাচাই করি।
আশার দিক হলো, মানবসম্পদের দিক থেকে বিশ্বের অনেক দেশের থেকে বাংলাদেশ অনেক বেশি এগিয়ে। কাজেই মানবসম্পদের উন্নয়নের জন্য শিক্ষার গুরুত্বটাও এখানে বেশি দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড-এটি আমরা সবাই জানি; কিন্তু আমাদের মেরুদণ্ড সোজা রাখার দায়িত্ব যারা কাঁধে নিয়েছেন, তারা সে দায়িত্ব কতটুকু নিষ্ঠার সাথে পালন করছেন সেটি মাঝেমধ্যে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়।
২০১৪ সালের একেবারে শেষের দিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত ‘জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ সূচকে এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থানবিষয়ক এক জরিপে দেখা যায় যে এশিয়ার জরিপকৃত ২৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭তম (১.৪৯)। অর্থাৎ তালিকার দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। আমাদের নিচে শুধু মিয়ানমার (০.৯৬)। এ ছাড়া আলাদাভাবে তিনটি সহসূচক যথা: উদ্ভাবন, শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোতে বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে ২৬, ২৫ ও ২৪তম। মূলত, জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির জন্য অন্যতম যে চারটি মূল উপাদান অর্থাৎ শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবন, তথ্যপ্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা—এর প্রায় সব কটিতেই বাংলাদেশের অবস্থান আশাব্যঞ্জক নয়।
প্রসঙ্গত, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এই তালিকায় এশিয়ার প্রথম দুটি দেশ ছিল জাপান (৮.৭৭) ও সিঙ্গাপুর (৮.৫২)।
যদিও শিক্ষার হার বিবেচনায় বরাবরই আমাদের দেশ অন্য অনেক দেশের তুলনায় হয়তো এগিয়ে। জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে বর্তমান জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটির বেশি। গত ১১ বছরে দেশে বেড়েছে ২ কোটি ১১ লাখ ১৪ হাজার জন। সাক্ষরতার হার ৫১.৭৭ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪.৬৬ শতাংশে।
তবে, স্বাক্ষরতার হার ক্রমবর্ধমান হলেও সম্প্রতি আমরা লক্ষ করেছি আমাদের সমাজে শিক্ষার সাথে নৈতিকতার বড় ব্যাবধান দৃশ্যমান। প্রতিনিয়ত আমরা গণমাধ্যমে দেখি সমাজের হিংসা, বিদ্বেষ, পরাশ্রীকাতরতা, মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানি, জুলুম-নির্যাতন, ব্যভিচার-ধর্ষণ প্রভৃতি অসামাজিক কর্মের খবর প্রচারিত হচ্ছে। বিষয়টি খবরের পাতায় যতটুকু প্রচার হয় এর বড় একটি অংশ প্রচারণার বাহিরে থেকে যায়। সেক্ষেত্রে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যাক্তিগত মর্যাদার বিষয়টি প্রধান হয়ে দেখা যায়।
আবার গত এক দশকে সমাজে ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আসক্তি নতুন করে আমাদের ভাবাচ্ছে। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় জানা গেছে, করোনাকালে ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিনগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তাদের ৮০ শতাংশই শিক্ষার্থী।
পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে ভিডিও কন্টেন্ট নির্মাতা বাড়াতে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটক নানা অফারও দিয়ে আসছে। আর সেসব অফারে থাকছে নগদ অর্থ উপার্জনের সুযোগ। ফলে শিক্ষার্থীরা কোনকিছুর বিচার না করেই এসকল কাজে নিজেদের জড়িয়ে নিচ্ছে। এছাড়াও সময় কাটানো, বিনোদনের এবং অর্থ আয়ের পাশাপাশি এসব প্লাটফর্মে চলছে ভার্চুয়াল খ্যাতি অর্জনের এক অশুভ প্রতিযোগিতা। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চিরায়ত ধারণা পাল্টে দিচ্ছে এসব ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম। যার ফলে বৈশ্বিক নেতৃত্ব এবং দক্ষতার কৌশল প্রতিযোগিতায় আমরা দারুণভাবে হেরে যাচ্ছি। আমাদের শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমনি নৈতিকতার অবক্ষয় দেখা যায় কুমিল্লা নগরীর টমসম ব্রিজ এলাকায় অবস্থিত ইবনে তাইমিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজে।গত ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ওই কলেজটির পাঁচ ছাত্রী শ্রেণিকক্ষে পরনে স্কুল ড্রেস ও চোখে কালো চশমা নিয়ে ১ মিনিট ২০ সেকেন্ডের নাচের ভিডিও তৈরি করে সেটি ছড়িয়ে দেয়।যেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল এবং সবমহলে সমালোচনার জন্ম দেয়।
এছাড়াও গত মে মাসে গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার সফিউদ্দিন সরকার একাডেমি অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ৩ শিক্ষার্থী টিকটকে ধুমপানের ভিডিও করে সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে।
ভিডিওতে দেখা যায়, স্কুলের পাশের একটি গলিতে একটি কোচিং সেন্টারের কাছে তিন ছাত্রীর একজন জলন্ত সিগারেট মুখে নিয়ে ফুঁকছে। আরেকজন দিয়াশলাই দিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছে। এ সময় অপর একছাত্রী হাস্যজ্বল ভঙ্গিতে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ধূমপানের দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও ধারণ করেন অন্য আরেক ছাত্রী। বিষয়টি নিয়ে ৩ শিক্ষার্থীকে স্কুল কতৃপক্ষ বহিষ্কার করে।
এমন চিত্র বর্তমানে আমাদের উঠতি বয়সী তরুণ তরুণীদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ আমরা সামাজিকভাবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উভয় স্থানে মারাত্মক নৈতিকতা সংকটে দিনাতিপাত করছি।
একটি দেশের উন্নয়নে তারুণ্য শক্তির ভূমিকাই মুখ্য। তরুণেরা সমাজ বিনির্মাণে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে কিংবা তরুণদের ওপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্র প্রগতির দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু তরুণেরা যখন আদর্শ ও মূল্যবোধ ভুলে গিয়ে হয়ে ওঠে ধর্ষক, মাদকাসক্ত কিংবা সন্ত্রাসী তখন তাদের কাছ থেকে আর কি প্রত্যাশা করা যায়? শিক্ষার মৌলিক কাজে মনোনিবেশ বাদ দিয়ে আমাদের আগামীর প্রজন্মরা যদি রংঢং এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশি ব্যাস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে আগামীর ভবিষ্যত ঘোর অন্ধকারের দিকে আমরা দৌড়াচ্ছি। এটি অবলীলায় উপলব্ধি করা যায়।
কাজেই আমাদের তরুণদের আলাদা যত্ন নেবার সময় হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি আমাদের নতুন প্রজন্মকে নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে। সর্বোপরি এই তরুণ প্রজন্মকে ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নৈতিক ও মানবিক গুণাবলীর বিকাশের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ববোধ ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে একটি শক্ত ভিত গড়ে তুলতে হবে। ফলে তারা বিপথগামী হওয়া থেকে বিরত থাকবে। সেইসঙ্গে তাদের মননশীলতার বিকাশ ও ঘটবে। আমরা স্বপ্ন দেখি এক উন্নত সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের যেখানে তরুণ তরুণীরা তাদের নৈতিকতার সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মাধ্যমে বিশ্বের বুকে রোল মডেল হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।