28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

একজন মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হোসেনের গল্প

Must read

খাদিজাতুল কুবরা: 

মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি শুনলে দেশপ্রেমী বাঙ্গালীর হৃদয়ে আজও উষ্ণতার সঞ্চার হয়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মর্মান্তিকতা ও ভয়াবহতা স্মরণ করলে আজও আমাদের প্রাণ শিহরিত হয়। সেই বিধ্বংসী যুদ্ধে যারা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে দেশ মাতৃকার পরাধীনতাকে মুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা আমাদের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি কিন্তু যারা জীবিত অবস্থায় আছেন তাঁদের বর্তমান অবস্থা এখন কেমন? আসলেও তাঁরা কি পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন? এরকম বহু প্রশ্নের উত্তর পেতে আমরা আজ একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা ফারুক হোসেনের জীবনী সম্পর্কে জানবো।

দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতাসহ বিভিন্ন সুবিধা দিচ্ছে সরকার। এমনকি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকেও দেওয়া হচ্ছে ভাতা। খেতাব, শারীরিক অসামর্থ্যসহ নানা বিবেচনায় সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাতা এবং রেশন দেওয়া হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হোসেন তার কতটা পাচ্ছেন!

যশোর জেলার বাঘারপাড়া উপজেলার ৯ নং জামদিয়া ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের আদমপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ফারুক হোসেন। মরহুম মোতালেব মিয়া এবং হাজেরা বিবির আদরের সন্তান ছিলেন ফারুক হোসেন। গ্রামের মানুষের কাছে তিনি ‘ফসিয়ার’ নামেই বেশি পরিচিত। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় ফারুক হোসেন ছিলেন কিশোর। এদেশে পাকিস্তানীদের অন্যায়, লুটপাট, শোষণ দেখে কিশোর ফারুক হোসেনের মন যুদ্ধ যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করে। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ৮ নাম্বার সেক্টরে তিনি সাহসীকতার সাথে যুদ্ধ করেছিলেন।  যুদ্ধের অনেক বিভীষিকাময় স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার জীবনে। তিনি বলেন, পিস কমিটি গ্রাম থেকে ৬ জনকে ধরে নিয়ে যায় বাঘারপাড়া থানায় এবং তাদের সবার উপর ছিলো গুলির আদেশ। 

এরমধ্যে অনেক কষ্টে রাজাকারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিলেন ফারুক হোসেন। ফুটফুটে জ্যোৎস্না রাত। বিলের মধ্যে পানির ভেতর কচুরিপানার আড়ালে অতি সন্তর্পণে চলছে সে। চারদিকে রাজাকারদের ছোটাছুটি এদিক সেদিক চলছে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ। চারদিকে রাজাকাররা সব রাস্তা বন্ধ করে রেখেছিলো। এরপর অনেক বাঁধা বিপত্তি ও অসহনীয় কষ্ট সহ্য করে ফারুক হোসেন শরনার্থীদের নৌকোয় করে পাড়ি দিয়েছিলেন ভারতের উদ্দেশ্যে। 

সেই স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “যাত্রা পথে যেনো কেয়ামতের আলামত দেখতে পেলাম আমরা। চারদিকে রাজাকারদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। নৌকায় কোনো বাচ্চা কেঁদে উঠলেও আমরা ধরা পড়ে যাবো। মলমূত্র ত্যাগ সব নৌকার ভেতরেই। কেউ সন্তান সম্ভবা। নৌকার মধ্যেই প্রসব হচ্ছে সদ্যজাত শিশু! কারোর পেটে ভাত নেই সাত আট দিন। কুড়োর চাপ্টা খেয়ে কেটেছে দিন। বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন ফারুক হোসেন। 

এরপর ভারতে পৌছানোর পর মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে ভর্তি হন তিনি। সেখানকার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ঠিকমত পেটভরে খেতে দেওয়া হয়নি। বহুদিনের নষ্ট হওয়া ভুট্টার গুড়া যেটাতে জন্মাতো বড় বড় পোকা সেই গুড়া পানিতে মিশিয়ে খেতে দেওয়া হত আমাদের। মাঝে মাঝে সৌভাগ্যক্রমে শক্ত রুটির দেখাও মিলতো।

এভাবে শত কষ্ট করে ফারুক হোসেনরা ছিনিয়ে এনেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। কিন্তু বর্তমানে কোনো ধরণের কষ্ট না করেও অনেক সুবিধাবাদী মানুষ ভুয়া সার্টিফিকেটের মাধ্যমে ভোগ করছে মুক্তিযোদ্ধাদের সকল সুযোগ সুবিধা। 

ফারুক হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ঘর থেকে বেরই হয়নি তারাও অনেকে সমানভাবে ভোগ করছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জারীকৃত সুযোগ সুবিধা। তাদের বেশিরভাগেরই রয়েছে দালান বাড়ি ও অর্থসম্পদ। তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে বেশি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন বলে জানান তিনি। 

অপরদিকে যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের অবস্থা বেশি ভালো না। ফারুক হোসেনের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর সংসার চলে খুব কষ্টে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতার কুড়ি হাজার টাকার দশ হাজার চলে যায় ঋণের সুদে। বাকি দশ হাজারে চিকিৎসা সহ খাওয়া দাওয়ার খরচ জোগাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন তিনি। শরীরেও বাসা বেঁধেছে অনেক রোগ ব্যাধি। তাঁর দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে হুমায়ুন কবির শিহাব কৃষি কাজ করে কোনোরকম স্ত্রী এবং নিজের পেট চালায়। 

ছোট ছেলে অপু রায়হান পড়াশোনা শেষ করে চাকরীর সন্ধান করছে কিন্তু চাকরীতে চায় মোটা টাকার ঘুষ! এত টাকার জোগাড় করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। তবে ফারুক আহমেদ বলেন,” বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমরা আগের থেকে অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা পেয়েছি।” কথা বলতে বলতে শেষ মুহুর্তে তিনি চোখের পানি সংবরণ না করতে পেরে বলেন, “সরকারের কাছে আমার আবেদন আমার ছেলেটা যেনো একটি চাকরী পায় এবং আমার বাড়ি ঘর যেনো তিনি একটু বস বাসের উপযোগী করে দেন।”

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article