আহমেদ ইউসুফ আকাশ:
প্রাকৃতিক পরিবেশে কিংবা বসতবাড়ির আশপাশের সবুজ গালিচায় এমনি এমনি যে মাশরুম জন্মায়, তাকে আমরা ব্যাঙের ছাতা বলে কতই-না তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল করি। কুসংস্কার আর অজ্ঞতার বশে অনেকেই সেগুলো হাত দিয়ে ছুঁতেও ভয় পাই। অজানা অসবুজ এই উপাদান আসলে মোটেই তুচ্ছ নয়। প্রকৃতিতে অল্প সময়ের জন্য এর আবির্ভাব হলেও দেহের পুষ্টিগুণ এবং জনগোষ্ঠীর খাদ্য জোগানে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি একটি অর্থকরী ফসল হিসেবে বর্তমানে সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।
মাশরুম হলো খাবার উপযোগী ছত্রাকের ফলন্ত অঙ্গ যা অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ঔষধিগুণসম্পন্ন। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ মুখোরোচক খাবার হিসেবে মাশরুম গ্রহণ করে আসছে এবং বর্তমান বিশ্বে সব দেশের মানুষই মাশরুম খেয়ে থাকে।
ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১০৯০ জন মানুষ বাস করে এবং প্রতি বছরে ১.৩৭% হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এদেশে চাষের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়িয়ে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ক্রমবর্ধমান এ জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি জোগানের জন্য এমন একটি ফসল দরকার যা পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন এবং যা আবাদের জন্য কোন উর্বর জমির প্রয়োজন হয় না। সেক্ষেত্রে মাশরুম সবজি চাহিদা পূরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশেও মাশরুম চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এটি মানুষের অন্যতম প্রধান সমস্যা অপুষ্টি দূরীকরণ এবং রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। একইসাথে মাশরুম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকারত্ব দূরীকরণ-শিক্ষিত যুবক, কিশোর-কিশোরী এবং বিশেষ করে মহিলাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব।
তবে স্থানীয় বাংলার মানুষের কাছে মাশরুম ‘ব্যাঙের ছাতা’ হিসেবে পরিচিত হলেও মাশরুম চাষের ৪০ বছরের বেশি সময় যাবত ধীরে ধীরে এটি উৎপাদন এবং ব্যবহারের জন্য মানুষের দ্বারা গৃহীত হয়েছে। মাশরুম ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন এক লাখেরও বেশি কৃষক মাশরুম উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত এবং দেশে ২০২০ সালে প্রায় ৪০ হাজার টন মাশরুম উৎপাদন হয়েছে।
যেহেতু আমাদের কৃষি জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। কিন্তু জনসংখ্যা বাড়ছে এবং মাশরুম চাষের জন্য জমি, সার এবং কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না বরং উলস্নম্ব সম্প্রসারণের জন্য একটি দুর্দান্ত সুযোগ রয়েছে। সুতরাং, কেউ সামান্য পরিমাণ মূলধন এবং শ্রম দিয়ে মাশরুম চাষ শুরু করতে পারেন। দারিদ্র ও ভূমিহীন মানুষ সহজেই মাশরুম চাষ করে তাদের স্বাবলম্বী করে তুলতে পারেন। এছাড়া বড় আকারের উৎপাদনের জন্য শিল্পপতি বা উদ্যোক্তারা মাশরুম শিল্প স্থাপন করতে পারেন। তারা মাশরুম রপ্তানি করতে পারেন এবং প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারেন।
দেশে খাবার উপযোগী এবং অধিক চাষযোগ্য বিভিন্ন প্রজাতির মাশরুম:
প্রকৃতিতে মাশরুমের কয়েক হাজার জাত রয়েছে এদের মধ্যে কয়েকটি জাতের বাণিজ্যিক চাষাবাদও হয়ে থাকে। বাংলাদেশের তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আদ্রতা মাশরুম চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। দেশে খাবার এবং অধিক চাষপযোগী মাশরুমের জাতগুলো হলো-
স্ট্র মাশরুম- ধানের খড়, শিমুল তুলা, ছোলার বেসন ও চালের কুড়া ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহার করে সাধারণত স্ট্র মাশরুম চাষ করা হয়ে থাকে। এ জাতের মাশরুম মূলত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চাষ করা হয়।
অয়েস্টার মাশরুম- এই জাতের মাশরুম সবচেয়ে বেশি চাষ হচ্ছে। সারাবছরই এই মাশরুম চাষ করা যায় তবে শীত ও বর্ষাকালে এর ভালো ফলন হয়ে থাকে। অয়েস্টার বা ঝিনুক মাশরুম খুব অল্প জায়গার সহজেই চাষ করা যায়।
ইয়ার মাশরুম- সাধারণত বর্ষাকালে প্রাকৃতিকভাবে আম গাছে ইয়ার মাশরুম পাওয়া যায়। ইয়ার মাশরুম দেখতে অনেকটা কালচে রঙের। এই মাশরুম সারাবছর চাষ করা গেলেও মূলত বর্ষাকালে এর ফলন ভালো হয়ে থাকে।
বাটন মাশরুম- বর্তমানে এই মাশরুমের চাষ শুরু হয়েছে। সাধারণ মাশরুম উদ্যোক্তা ও মাশরুম চাষিরা প্রতি শীতে অর্থাৎ নভেম্বর থাকে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রচুর বাটন মাশরুম উৎপাদন করতে পারবে।
এছাড়াও ঝিনুক মাশরুম বা Oyster mushroom, দুধ মাশরুম বা Milky mushroom বা , কান মাশরুম বা Wood ear mushroom, বোতাম মাশরুম বা Button mushroom, তাপ সহনশীল বোতাম মাশরুম বা Heat tolerate button mushroom, শিতাকে মাশরুম বা Shitake mushroom, খড় মাশরুম বা Paddy straw mushroom উল্লেখযোগ্য।
মাশরুমের গুণাগুণ:
আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার খাই মাশরুমের পুষ্টিগুণ সেগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় এটি শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ সহ শরীরকে সুস্থ রাখতে খুবই সহায়ক। মাশরুমে মানবদেহে্র জন্য প্রয়োজনীয় ৯টি এমাইনো এসিডের মধ্যে প্রত্যেকটিই বিদ্যমান। প্রোটিনে ভরপুর মাশরুমে কোন প্রকার ক্ষতিকর চর্বি না থাকায় নিয়মিত মাশরুম খেলে মেদভূড়ি, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ইত্যাদি জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতি একশ গ্রাম মাশরুমে প্রোটিন ২৫-৩৫ গ্রাম, ভিটামিন ৫৭-৬০ গ্রাম ও ৫-৬ গ্রাম মিনারেল, শর্করা, উপকারী চর্বি ৪-৬ গ্রাম পাওয়া যায়। এতে আঁশের পরিমাণও খুবই সন্তোষজনক ও এর পরিমাণ প্রায় ১০-২৮%। এই পরিমাণটি অন্যান্য খাবারের তুলনায় অনেক বেশী। শুকনো মাশরুমে ৫৭-৬০% ভিটামিন ও মিনারেল থাকে যা আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খুবই কার্যকরী ভুমিকা পালন করে। এটি ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, সোডিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থাকায় মাশরুম দেহকে সুরক্ষিত রাখতেও বিশেষ ভুমিকা রাখে।
এছাড়াও মাশরুমে কোলেস্টরেল কমানোর অন্যতম উপাদান ইরিটাডেনিন, লোভাষ্টটিন, এনটাডেনিন, কিটিন এবং ভিটামিন বি,সি ও ডি থাকায় নিয়মিত মাশরুম খেলে উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেসার) ও হৃদরোগ নিরাময় হয়।
মাশরুমের সম্ভাবনা:
দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ মাশরুম উৎপাদন হয় তার আর্থিক মূল্য প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। প্রায় দেড় লাখ মানুষ মাশরুম ও মাশরুমজাত পণ্য উৎপাদন ও বিপণন সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত। পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ প্রায় সব দেশই মাশরুম আমদানি করে থাকে। বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাশরুম রপ্তানির অনেক সুযোগ রয়েছে।
এখন পর্যন্ত মাশরুমের ১৬২টি জাত দেশে এনেছে মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট। দেশের পাহাড়ি ও বনাঞ্চল থেকেও ১৪০টি জাত সংগ্রহ করা হয়েছে। আবার ইনস্টিটিউটে মান নিয়ন্ত্রণ ও মান নিশ্চিত করতে আধুনিক ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। ল্যাবে মাশরুমের পুষ্টি ও ঔষধিগুণসহ ভিটামিন, মিনারেল নির্ণয় করার সুবিধা থাকায় মাশরুমের সম্ভাবনা এখন আরও সুপ্রসন্ন।
লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।