তানভীর হোসাইন:
বিষন্নতা এমন একটি মানসিক সমস্যা, যেখানে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ ধরে কোনো ব্যক্তি হতাশ, মন খারাপ এবং সবকিছুর প্রতি অনীহা বোধ করে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ প্রকাশ পায়। বিষন্নতার কারণে ব্যক্তির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, শিক্ষাগত, পেশাগত ও সামাজিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং স্বাভাবিক কর্মতৎপরতা ব্যাহত হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, সারা বিশ্বে ৫ থেকে ১৭ শতাংশ মানুষ বিষন্নতায় ভুগছে।
সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে দুঃখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে রয়েছে। জুলাইয়ের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের জরিপ সংস্থা গ্যালাপ প্রকাশিত ‘২০২২ গ্লোবাল ইমোশনস রিপোর্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ১২২টি দেশের মানুষের রাগ, মানসিক চাপ ও দুঃখের এই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের স্কোর ৪৫। আর ৫৯ স্কোর নিয়ে দুঃখী দেশের তালিকার শীর্ষে রয়েছে আফগানিস্তান।
পোলিং সংস্থা গ্যালপ মূলত ২০০৫ সাল থেকে এই জরিপটি চালিয়ে আসছে। এবং ২০১৫ সাল থেকে “গ্লোবাল ইমোশন রিপোর্ট” প্রকাশ করে আসছে। সেই ধারাবাহিকতায় ২২ সালের রিপোর্টটিও প্রকাশিত হয়েছে। যেটির প্রধান উপদেষ্টা হিসবে কাজ করেছিলেন “জন ক্লিফটন”।
গ্যালাপ হলো ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক একটি পোলিং সংগঠন যা ১৯৩৫ সালে আমেরিকান পরিসংখ্যানবিদ জর্জ হোরাচ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৬ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেকে কেন্দ্র করে করা একটি জরিপের ফলে সংস্থাটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। সেই জরিপে ২টি দল তথা আলফ্রেড লনডনের রিপাবলিক এবং ফ্রেঙ্কলিন রুজভেল্টের ডেমোগ্রাফিক দলের মধ্যে কোন দলটি নির্বাচনে জয়লাভ করবে তা নিয়ে জনসাধারণের থেকে মতামত গ্রহণ। তাতে রুজভেল্টের জয়ের আগাম ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পরবর্তীতে রুজভেল্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেন এবং সেইসাথে একাধারে ৪বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করে। মূলত জরিপে রুজভেল্টের আগাম বিজয়ের তথ্য প্রচার করেই গ্যালপ তখন জনপ্রিয়তায় তুঙ্গে চলে যায়।
এছাড়াও সংঘঠনটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসা, শিক্ষা, ব্যবস্থাপনা, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিজসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এর উপর জরিপ করে এবং সে অনুযায়ী পরামর্শ দিয়ে থাকে। ১৯৪৮ সালে সংস্থাটি কয়েকটি দেশে এর শাখা স্থাপন কার্যক্রম শুরু করে এবং ১০ বছর পর সকল শাখাগুলোকে একিভূত করে একটি মডার্ন সংঘঠন হিসেবে রূপলাভ করে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী তাদের ৩০ থেকে ৪০ টি অফিস রয়েছে।
এখন স্বাভাবিকভাবে তাই আমাদের মনে প্রায় প্রশ্ন জাগে যে, আমরা কেন বিষন্ন হই? এর পিছনে কি কি কারণ রয়েছে? এটিরও প্রশ্ন জাগে কোন দেশগুলোর মানুষেররা তূলনামূলক বেশি বিষন্ন জীবন পার করছে। এমন প্রশ্নগুলোর উত্তর সামনে নিয়ে আসতেই গ্যালপ ‘গ্লোবাল ইমোশনস রিপোর্ট’ প্রকাশ করে। বর্তমানে আমরা মানষিক চাপ, দুঃখ, রাগ, দুশ্চিন্তা এবং শারীরিক অসুস্থতাকে সঙ্গী করে বিষন্ন জীবনযাপন করছি। অর্থাৎ, আমাদের প্রযুক্তির বিকাশ ও বাহ্যিক উন্নতি দিনদিন বৃদ্ধি পেলেও মানসিক প্রশান্তি সেই তুলনায় বৃদ্ধি পাওয়ার বিপরীতে জ্যামিতিক হারে হ্রাস পেয়েছে।
গ্যালাপ তাদের রিপোর্টে মোট পাঁচটি বিষয় তথা- দারিদ্রতা, অনিয়মিত যোগাযোগ, ক্ষুধা, একাকিত্ব এবং উন্নত কাজের সন্ধানকে বেশি গুরত্বারোপ করেছে। একইভাবে বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বে ২ বিলিয়নের মত মানুষকে অপর্যাপ্ত উপার্জন করে জীবনধারণ করতে হচ্ছে। আবার ২ বিলিয়ন মানুষ তাদের চাকরি নিয়ে অসন্তুষ্ট এবং অন্যকাউকে তারা একই ধরনের চাকরি করতে নিরুৎসাহিত করে।
আমরা যদি বাংলাদেশের দিকে লক্ষ করি সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অথর্বছরের জিডিপিতে প্রবিদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। যেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ২০২১ সালের অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ১১ দশমিক ৯ শতাংশ হয় যা ২০২০ সালে ১২ দশমবক ৫ শতংশ ছিল। অর্থাৎ মানুষের জীবন মান উন্নত হচ্ছে দারিদ্র্যের হার কমছে দিন দিন কিন্তু মানসিক দিকটি বিবেচনা করলে বাংলাদেশ বিষন্ন দেশ হিসেবে ৭ম স্থানে অবস্থান করছে। যেটা আমাদের জন্য এক অশনিসংকেত।
একইরকম চিত্র পৃথিবীজুড়ে দেখা যায়, মানুষ চরম খাদ্য সংকটে দিনাতিপাত করছে। ফাও (FOW) এর মতে ২০১৪ সালে খাদ্য সংকটে থাকা মানুষের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ যেটি বর্তমানে ৩০ শতাংশে পৌছেছে।
এর পাশাপাশি গ্যালাপের রিপোর্টে উঠে এসেছে, পৃথিবীব্যাপি ৩৩০ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক-যুবতীরা যারা অন্তত ২ সপ্তাহ তাদের বন্ধু-পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হীনভাবে পার করেছে। যদিও তাদের অনেকেরই বন্ধু-পরিবার রয়েছে।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) আচরন বিজ্ঞানী জর্জ ওয়ার্ড বলেন, আমাদের আচরণ আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে পরিচালিত করে এবং তিনি বিশ্বাস করেন জনগনের কাজের ধরণ দেখে বলে দেয়া সম্ভব তার ফলাফল কি হবে। অর্থাৎ আমাদের শারিরীক ও মানসিক অবস্থা আমাদের সিদ্ধান্ত ও কাজের উপর প্রভাব ফেলে। যখন আমাদের মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটে সেইসময়ে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো আমাদের জন্য অনুশোচনার কারণ হয়। আর এই নেতিবাচক সিদ্ধান্ত ভাইরাসের চেয়েও বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে থাকে এবং বেশি বিপদ ডেকে আনে। যার অন্যতম বাহক হিসেবেও ভূমিকা রাখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
তবে মানসিক বিষন্নতার এমন চিত্র শুধু বাংলাদেশে নয়, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এমন নেতিবাচক মনোভাব লক্ষণীয় হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্লোবাল পিচ ইনডেক্স এর তথ্য মতে, গত ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ২৪৪ শতাংশ রাজনৈতিক দাঙ্গা, ধর্মঘট ও বিরোধী দলের প্রতি বিরোধপূর্ণ আচরণের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং ২০২০ সালে ১৫ হাজার স্পষ্ট প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেছে।
গ্যালপের জরিপেটি ১৫ বছরের উর্ধ্বের লোকদের উপর ৫টি করে মোট ১০ টি ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়।
ইতিবাচক প্রশ্নগুলো ছিল-
- গতকালকে আপনি যথেষ্ট বিশ্রাম নিতে পেরেছিলেন কি?
- গতকাল আপনি সকলের কাছ থেকে সম্মান জনক ব্যবহার পেয়েছিলেন কি?
- গতকালকে আপনি অনেক পরিমাণে হেঁসেছিলেন কি?
- গতকালকে আপনি আকর্ষনীয় নতুন কিছু শিখেছেন বা করেছিলেন কি?
- গতকালকের দিনটি আপনার কাছে কেমন উপভোগ ছিল?
নেতিবাচক প্রশ্নগুলো ছিল-
আপনি কি গতকালকে দিনের অনেক সময় ধরে শারীরিক অসুস্থতা, বিষন্নতা, দুশ্চিন্তা, মানসীক চাপ ও ক্রোধ অনুভব করছেন?
অর্থাৎ এসকল প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে জন ক্লিফটন মূলতঃ একজন মানুষের নিত্য দিনের অনুভূতিকে প্রশ্নের মাধ্যমে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। জরিপে দেখা যায় ২০২১ সালে মানুষের মানসিক অবস্থা ২০২০ সালের চেয়ে বেশি খারাপ ছিল। এটির কারণ হিসেবে করোনায় গৃহবন্দী জীবনকে দায়ী করা হয়। জরিপটিতে ২০২১ সালের শেষ থেকে ২২ সালের শুরু পর্যন্ত মোট ১২২টি দেশের প্রায় ১লক্ষ ২৭ হাজার মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এতে মোবাইল ইন্টারভিউ ও ফেস-টু-ফেস যোগাযোগের মাধ্যমে চীনের ৩ হাজার ৫০০, ভারতের ৩ হাজার এবং রাশিয়ার ২ হাজার লোক থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আর অন্যান্য দেশগুলো থেকে ১ হাজার মানুষ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে কয়েকটি দেশ থেকে যৌথভাবে তথ্য সংগ্রহ করে।
জরিপে দেখা যায়, ৬৯ শতাংশ মানুষ ঠিক ভাবে বিশ্রাম নিতে সক্ষম হয়েছে, ৭০ শতাংশ মানুষ আনন্দ ঘন দিন পার করেছে, ৭২ শতাংশ মানুষ হেসেছে, ৮৬ শতাংশ মানুষ যথাযথ সম্মান পেয়েছে এবং ৫০ শতাংশ মানুষ তারা কিছুনা কিছু শিখেছে ও আকর্ষনীয় কিছু করেছে।
অপরদিকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় ৪২ শতাংশ, মানসিক চাপে রয়েছে ৪১ শতাংশ, শারিরীক অসুস্থতায় ভুগেছে ৩১ শতাংশ, ভারাক্রান্ত ২৮ শতাংশ এবং ২৩ শতাংশ মানুষ ক্রোধান্বিত অবস্থায় দিন পার করেছে।
জরিপ অনুযায়ী ৮৫ নাম্বার পেয়ে সবচেয়ে সুখী রাষ্ট্র হিসেবে আছে পানামা এবং ৩২ নাম্বার পেয়ে সবচেয়ে বিষন্ন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রাষ্ট্র হিসেবে প্রথম হয়েছে আফগানিস্তান। বিষন্ন রাষ্ট্র হিসেবে আফগানিস্তানের পরেই যথাক্রমে লেবানন ও ইরাকের অবস্থান। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আফগানিস্তানের ৮০ শতাংশ মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, ৭৪ শতাংশ মানসিক চাপ, ৬১ শতাংশ বিষন্নতা অনুভব করে। যা বিগত ১৬ বছরের জরিপে অন্য যেকোন দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি।
মানসিক সুস্থতা কেন দরকার?
মানসিক সুস্থতা হলো এমন একটি ইতিবাচক মানসিক অবস্থা, যে অবস্থায় একজন মানুষ তার নিজের সক্ষমতা বুঝতে পারেন, জীবনের স্বাভাবিক চাপসমূহের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন এবং উৎপাদনশীল কর্মের মাধ্যমে নিজ সম্প্রদায়ে অবদান রাখতে পারেন। মানসিক সুস্থতা একজন মানুষকে শুধুমাত্র উৎফুল্লই রাখেনা তার পাশাপাশি শারীরিক অসুস্থতা কমাতে সাহায্য করে। বিষন্নতা বিভিন্ন ধরণের রোগ যেমন, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও স্টোক এর ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষনায় দেখা গিয়েছে, মানসিক সুস্থতা একজন মানুষের শিক্ষার হার, সৃজনশীলতা, প্রোডাক্টিভিটি, সুন্দর সামাজিক ব্যবহার ও ইতিবাচক সম্পর্ককে বৃদ্ধি করে তার পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতাকে কমিয়ে আনতে সাহায্য করে।
অর্থাৎ মানসিক সুস্থতা আমাদের দেশীয় অর্থনীতিতে সরাসরি কোন অবদান না রাখলেও মূলত এটি একটি সক্রিয় অনুঘটক হিসেবে অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। মানসিক বিষাদের সাথে শারীরিক পরিবর্তন এবং একইসাথে সেটির প্রভাব ব্যাক্তির কাজে দেখা যায়। তাই মানসিক উন্নতির জন্য বিভিন্ন সংস্থা ও বিভিন্ন দেশকে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়। যেমন, ভারতীয় অভিনেত্রী দিপিকা পাডুকন ২০১৫ সালে “দ্যা লাইভ লাভ লাফ ফাউন্ডেশন” নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান চালু করেন এছাড়া কানাডাতে ২০১০ সালে “বেল লেটস টক” এবং যুক্তরাজ্য “টাইম টু চেইঞ্জ” নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে।
ওয়ার্ল্ড হেল্থ অরগানাইজেশান মানসিক উন্নতির জন্য ২০১৮ সালে ৫ বছর মেয়াদি একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে যেখানে ১২ টি দেশের ১০০ মিলিয়ন লোককে মানসিক ট্রিটমেন্ট এর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে ট্রিটমেন্টের আওতায় ৮ টি দেশ কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং তাদের পর্যাপ্ত সেবা প্রদান করছে এতে বাংলাদেশসহ ঘানা, জর্ডান, নেপাল, প্যারাগুয়ে, ফিলিপাইন, ইউক্রেন ও জিম্বাবুয়েকে যুক্ত করা হয়েছে।
তাছাড়া মানসিক উন্নতির জন্য বিজ্ঞানিরা, স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, পরিমিত ঘুম, বেশি বেশি বই পড়া, নিয়মিত ধর্ম চর্চা করা, পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটানো, ভ্রমণ করা সহ বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।