জুবায়ের রহমান:
সময়টা এখন বর্ষার। পানির ছলছল বয়ে চলা আর কলকলানি ঢেউ প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের কাছে টানে। মেঘমুক্ত নীল আকাশ, সাদা মেঘেদের দুরন্ত ছুটে চলা, তপ্ত রোদের উজ্জ্বল চাহনী প্রকৃতিকে করে তুলে আরও উৎকণ্ঠা। আবার পানির সাথে বয়ে আসা হিমেল হাওয়া নদীর পাড়ে বসা ক্লান্ত পথিককে দেয় প্রশান্তির ছোঁয়া।
প্রকৃতির এমন নির্মলা মেলবন্ধন মানুষ ছুঁতে চায় প্রতিনিয়ত। শহরের ব্যস্ততা আর কোলাহলকে দূরে ঠেলে ঘন সবুজ দ্বীপে আনন্দঘন সময়টুকু কাটাতে কার না ভালো লাগে। যেখানে পাহাড়, নদী, নীল আকাশ, পাখির কিচিরমিচির শব্দ, পানির কলতান এক হয়ে প্রকৃতিকে আরও আবেদনময়ী করে তোলে। সেখানেই ক্লান্ত পথিকের আড্ডাখানা গড়ে ওঠে।
তেমনি প্রকৃতিপ্রেমীদের এক আকর্ষণীয় স্থান রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই লেক৷ যার হাত ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন শিল্পের প্রসার এবং আদিবাসী বাস্তুচ্যুতের সূচনা ঘটে পাকিস্তান পিরিয়ডে। তবে বর্তমান সময়ে এসে প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যে চাপা পড়েছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিরব আর্তচিৎকার। কারণ নদটি কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি হলেও এতে কৃত্রিমত্রার ছোঁয়া বোঝা দায়৷ ফলে এর প্রেমে মত্ত হয়ে প্রকৃতিকে উপভোগ করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন পর্যটকেরা।
কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ হৃদ এই কাপ্তাই লেক। লেকটিতে বিস্তৃত পাহাড় ছুয়েছে আকাশ, ঘন সবুজ উর্বর দ্বীপ দিয়েছে নির্জনতা, পাখি দিয়েছে তাঁর কিচিরমিচির শব্দ। পানিতে বাস করা জীবগুলো জানান দেয় তাদের অস্তিত্বের কথা। তাই কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট হলেও লেকটির এমন সাজে নেই কোন কৃত্রিমতার ছোঁয়া।
১৯৫৭ সালে কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় কাপ্তাই লেকের সৃষ্টি হয়। একসময় এই কাপ্তাই লেকের নিচে তলিয়ে থাকা ভূমিগুলো ছিলো সমতল, ভেসে থাকা চরগুলো ছিলো ছোট-বড় পাহাড়। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের ৪০ শতাংশ আবাদি কৃষি জমি ছিলো এই লেকটি।
মনুষ্যসৃষ্ট এই নদটি কর্ণফুলী নদীর পানি দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য ততকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৯০৬ সালে সর্বপ্রথম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই করে। ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৬২ সালে এ নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ৬৭০ দশমিক ৬ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৫৪ দশমিক ৭ মিটার উচ্চতার বাঁধটি নির্মাণ করে ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ও উটাহ ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেটেড। প্রায় ২ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ লেকটির বিস্তৃতি সমগ্র রাঙামাটি জুড়েই। জেলাটির রাঙামাটি সদর, কাপ্তাই, বরকল, নানিয়ারচর, লংগদু, জুড়াছড়ি, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি পর্যন্ত লেকটির জলসীমা অতিক্রম করেছে।
পাকিস্তান সরকারের আমলে তৈরি করা এই প্রকল্পে ১৮ হাজার আদিবাসী পরিবারকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়। এতে আনুমানিক ১ লক্ষাধিক মানুষের স্থানান্তর ঘটে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ইতিহাসে উন্নয়ন ধারণার সাথে প্রান্তিকীকরণ ঘটনা এটিই প্রথমে ঘটেছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প দেশের বিভিন্ন স্থানের আদিবাসীদের বাস্তুচ্যুত করে। যার ফলস্বরূপ আদিবাসীদের বৃহৎ একটি অংশ আবাসস্থল পরিবর্তনে বাধ্য হয়।
এই বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩৬১ টি মৌজার মধ্যে ১২৫ টি মৌজা পানির নিচে তলিয়ে যায়। বাঁধ নির্মাণের পূর্বে ২৫০ বর্গমাইল এলাকা ডুবে যাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হলেও নির্মাণের পর ৩৫০ বর্গমাইল এলাকা ডুবে যায়।
১৯৭০ সালে ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ এর একটি প্রতিবেদনে কর্ণফুলী প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করা হলেও তৎকালীন পাকিস্তান সরকার মাত্র ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেন।
কাপ্তাই লেক নির্মাণের আগে আদিবাসী নেতারা এই প্রকল্পের বিরোধিতা করেছিল। কারণ আদিবাসীরা পাহাড়ে জুম চাষ থেকে সরে এসে তখন সমতল ভূমিতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। এছাড়াও পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে তারা ইচ্ছুক ছিলো না। উর্বর ভূমির সংকটে বছরের একটা সময়ে পাহাড়ে ভাল উৎপাদনও হয় না।
ক্ষতিগ্রস্ত উপজাতিদের প্রায় ৭০ শতাংশের অধিক ছিলো চাকমা। চাকমা রাজার পুরাতন বাড়ি ও প্রাচীন রাঙামাটি শহর সেখানে অবস্থিত ছিলো। রাজার প্রাচীন ইট-সুরকির বাড়ির অস্তিত্ব এখনো পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। বাঁধ নির্মাণের পরে চাকমাদের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুহারা হয়ে ভারতের অরুণাচলে আশ্রয় নেয়। ফলে শরনার্থী হিসেবে এখনো ভারতে অবস্থান করছে তারা। বাংলাদেশ কিংবা ভারত রাষ্ট্র থেকে তারা কখনও নাগরিকত্ব পায়নি। ফলে জাতীয় পরিচয় সংকটের মধ্যদিয়ে বাস্তুচ্যুত আদিবাসীদের যেতে হচ্ছে বছরের পর বছর।
বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ী রাজনৈতিক দল, সন্ত্রাসী দলের নাম দেশীয় গণমাধ্যমে উঠে আসে। যারা অধিকাংশ সময় সেখানে পার্বত্য অঞ্চলে নৈরাজ্য সৃষ্টি ও বাঙালি হত্যাকাণ্ড চালায়। তাদের এসকল নৈরাজ্যমূলক কাজের অন্যতম কারণ কাপ্তাই লেকসহ বিভিন্ন সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় আদিবাসীদের বাস্তুচ্যুতের ঘটনা। নিজেদের ভূমি কেড়ে নেওয়ার প্রতিশোধমূলক আচরণ থেকেই পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে তারা এই নৈরাজ্য সৃষ্টি করে থাকে। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে শিক্ষিত আদিবাসীদের লিখালিখিতে উঠে আসে বিভিন্ন ধরণের ক্ষোভের কথা।
কাপ্তাই লেকের বর্তমান পরিস্থিতি
ক্ষয়ক্ষতির ছাপ কাটিয়ে কাপ্তাই লেক এখন রাঙামাটির গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই জলাধারে ৫৮ প্রজাতির মাছের চাষ হয়। এখানে বার্ষিক ৭ হাজার টনেরও বেশি মাছ উৎপাদন করা হয়। এই লেকের মাধ্যমে একটি বৈচিত্র্যময় দীর্ঘ জলপথের সৃষ্টি হয়েছে। হৃদ সৃষ্টির পূর্বে এই পাহাড়ি জনপদ পেরোতে যেখানে একদিনেরও বেশি সময় লাগত, বর্তমানে সেখানে স্পিডবোট বা লঞ্চে কয়েক ঘণ্টায় যাওয়া যায়। পাশাপাশি নৌভ্রমণের মধ্যদিয়ে পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্পটে পরিণতে হয়েছে অঞ্চলটি।
লেকটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে আরো বেশ কয়েকটি বিনোদন কেন্দ্র৷ এগুলোর মধ্যে ঝুলন্ত ব্রীজ, শুভলং ঝরণা অন্যতম। ক্যাবল তারে যাওয়া যায় শেখ রাসেল ইকোপার্কে। যা দর্শনার্থীদের এডভেঞ্চারের তৃপ্তি দেয়। এছাড়াও আরো আছে কাপ্তাই বাঁধ, কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র, নেভি ক্যাম্প পিকনিক স্পট, ওয়াগগাছড়া পিকনিক স্পট, চিতমরম বৌদ্ধ মন্দির ইত্যাদি জায়গা।
আবার এসবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন হোটেল রিসোর্টের ব্যবসা। যারমধ্যে দিয়ে পাহাড়ী খাবার পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের দৌড় ঘোরায়। নির্মাণ হয়েছে অসংখ্য রাস্তাঘাট। ফলে লেকের আশেপাশে বসবাসরত পার্বত্য আদিবাসীরা নিজেদের অবস্থান অনেকটাই পালটে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। কখনো হোটেল, কখনো ট্যুর গাইড আবার লেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের রসদ খুঁজে পাচ্ছে এখান থেকে। এছাড়াও এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষায়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেকেই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে দেশ-বিদেশে ছুঁটে বেড়িয়ে চলছে অবিরত।
এখানে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি হাসপাতাল, ক্লিনিক, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে দিনদিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।