28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

মাদকের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে সমাজ

Must read

আবু শামা:

যেকোন সমাজ পরিবর্তন হয় পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে একটি নির্দিষ্ট গতিতে। এটি চিরাচরিত প্রথা। কিন্তু সেই পারিপার্শ্বিক অবস্থা যদি মন্দের উপর দন্ডায়মান থেকে পরিবর্তন হয় তাহলে অবশ্যই সেটি আশঙ্কাজনক। একইসাথে বিষয়টি সমাজের সচেতন নাগরিকদের জন্য মাথা ব্যাথার কারণ।

সম্প্রতি দেশে মাদকের বিস্তার এক ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। শহরাঞ্চলে তো বটেই, গ্রামগঞ্জে, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মাদক এখন খুবই সহজলভ্য হয়ে গেছে। মাদকের প্রভাবে আমাদের সমাজের মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। একদশক আগেও যা ছিল অকল্পনীয়। বর্তমানে তরুণ-যুবাদের পাশাপাশি এখন কিশোর-কিশোরীরাও ক্রমে বেশি করে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। একইসাথে মাদকের প্রভাবে নতুন প্রজন্মের নৈতিক অবক্ষয় ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে।

এই মাদকাসক্তির দিকে মানুষকে পরিচালিত করার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা, সামাজিক অস্থিরতা, উত্তেজনা, একঘেয়েমি, একাকিত্ব এবং পারিবারিক কাঠামো পরিবর্তনের পরিবেশে ব্যর্থতার সঙ্গে লড়াই করতে অক্ষমতা। তবে মাদকাসক্তদের সংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ হলো মাদকের সহজলভ্যতা।

মাদকের মধ্যে বিশেষ করে, গাঁজা, ফেনসিডিল, চরস, ভাং, গুল, জর্দা, হেরোইন, প্যাথেড্রিন, মদ, ইয়াবা অন্যতম। মাদক সেবনের পর ব্যাক্তি তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে।

কোন বিশেষ অঞ্চল নয় বরং বর্তমানে মাদক ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র দেশজুড়ে। শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে মাদক। তার বিষাক্ত ছোবল শেষ করে দিচ্ছে তারুণ্যের শক্তি ও সম্ভাবনা। সর্বনাশা মাদক ধ্বংস করে একটি মানুষের শরীর, মন, জ্ঞানবিবেক ও জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা তার পরিবারের সব স্বপ্নকে এবং তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে। শুধু পরিবারকে নয়, মাদকের কালো থাবা ধ্বংস করে একটি সমাজকে, একটি জাতিকে এবং পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে এটি বৃহৎ আকার ধারণ করে একটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। তরুণ তাজা প্রাণেরাে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ায় পিছিয়ে পড়ছে সমাজ।

আবার  মাদকের অর্থ জোগাড়কে কেন্দ্র করে মানুষের ঘর থেকে শুরু করে ফসলের মাঠ সবখানে বেড়েছে চুরি ছিনতাই। অনেকসময় এসমস্ত অপরাধমূলক কাজ করতে গিয়ে অপরাধীরা ধরা পড়ে আইনের আওতায় আসার পরে বিভিন্ন সময়ে ছাড়া পেয়ে আবার সেই একই কাজে লিপ্ত হবার ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়াও বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম অনলাইনেও জুয়ায় আসক্ত হচ্ছে। অনেক সময় আবার তথ্য প্রযুক্তির এই জুয়ার নেশায় সর্বস্ব হারায়। আবার এ কাজে টাকার অবৈধ লেনদেন মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টের মাধ্যমে করা হয়। ফলে সাধারণ ব্যবহারকারীদের টাকা বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের বাইরে অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায়। এক্ষেত্রে বেশি লাভের আশায় যারা অর্থ বিনিয়োগ করে একটা সময় তারা শেষ সম্বল টুকু হারিয়ে ফেলেন।

সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, তরুণ প্রজন্মের মাদক কিংবা জুয়ার দিকে আকৃষ্ট হবার প্রধান কারণ হচ্ছে পরিবার। একজন শিশু পরিবার থেকে যা শিক্ষা গ্রহন করে তা কিংবা সঠিক শিক্ষা না পেলে সমাজের মধ্যে বোঝা হয়ে দাড়ান। একজন শিশু যদি তাদের বাবা-মায়ের মধ্যে সর্বদা ঝগড়াঝাটি দেখে বড় হয়, এবং কোন সৎউপদেশ না পায় তাহলে সেই শিশু কখনো ভালো হবে না বরং ধীরে ধীরে অসামাজিক এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে। কেননা ভুল এবং নির্ভুল বিচার করবার মত হিতাহিত জ্ঞান না থাকলে ভুল কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।

অপরদিকে কোন শিশু যদি পরিবার এবং সমাজ থেকে স্নেহ, ভালোবাসা এবং সদুপদেশ গ্রহণ করে বড় হন তাহলে তার দ্বারা সমাজে অপরাধমূলক কাজ হবার সম্ভাবনা কম থাকে। তাই শিশুর বেড়ে ওঠা এবং প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে পরিবার এবং সমাজের দায়বদ্ধতা অনস্বীকার্য।

ভারতের প্রয়াত রাষ্টপতি এ পি জে  আবদুল কালাম তার একটি বইয়ে লিখেছেন,’আমার মা আমাদের জন্য রান্না করতেন। তিনি সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম করার পর রাতের খাবার তৈরি করতেন। তখন আমি ছোট। এক রাতে মা এক প্লেট সবজি আর একেবারে পুড়ে যাওয়া রুটি এনে বাবাকে খেতে দিলেন। আমি অপেক্ষা করছিলাম, বাবার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়, সেটা দেখার জন্য। কিন্তু বাবা চুপচাপ রুটিটা খেয়ে নিলেন এবং আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, স্কুলে আমার আজকের দিনটা কেমন গেছে। আমার মনে নেই বাবাকে সেদিন কি উত্তর দিয়েছিলাম, কিন্তু এটা মনে আছে মা পোড়া রুটি খেতে দেওয়ার জন্য বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, উত্তরে বাবা বলেছিলেন প্রিয়তমা, পোড়া রুটিই আমার পছন্দ। আমি ঘুমাতে যাওয়ার সময় কৌতূহল মেটাতে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম বাব আসলেই তোমার পোড়া রুটি পছন্দ? তখন বাবা আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলছিলেন বাবা তোমার মা আজকে প্রচুর পরিশ্রম করেছেন এবং তিনি ক্লান্ত ছিলেন। তাছাড়া পোড়া একটা রুটি খেয়ে মারা কষ্ট পায় না; বরং কষ্ট পায় কর্কশ ও নিষ্টুর কথায়।

আলোচ্য বিষয় হলো বর্তমান সময়ে আমাদের  সমাজে কয়জন স্বামী তার স্ত্রী সম্পর্কে এই ধরনের শ্রদ্ধাপূর্ণ মন্তব্য করতে পারে? আর না পারলে তাহলে সন্তানরা শিখবে কোথা থেকে?

এক দশক আগেও সমাজে বড়দের সম্মানের পাশাপাশি কিছু রীতি পালন করা হতো। কিন্তু বর্তমানে বড়দের শ্রদ্ধা, সম্মানের রীতিও বিরল। কেননা সেই রীতিটা পাল্টে দিয়েছে মাদক ও খারাপ বন্ধুদের সাহচর্য। এই পরিবর্তনটা শহরে দেখা গেলেও বর্তমানে গ্রামে সেটি ভয়ংকর  রুপ ধারণ করেছে। গ্রামের মধ্যে ১২-১৬ বছরের কিশোরেরা এই মাদক কারবারিতে জড়িয়ে পড়েছে।

সর্বোপরি এখনই সময় আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নৈতিক ও মানবিক গুণাবলীর বিকাশের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ববোধ ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে একটি শক্ত ভিত গড়ে দেবার। যে ভিত্তি শক্ত করে ধরে তারা বিপথগামী হওয়া থেকে বিরত থাকবে। সেইসঙ্গে তাদের মননশীলতার বিকাশও ঘটবে। তরুণ প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাতে হবে এক উন্নত সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের, যেখানে তরুণ তরুণীরা তাদের নৈতিকতার সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মাধ্যমে বিশ্বের বুকে নতুন এক বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যাল

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article