28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

প্রাকৃতিক ভূমিবিন্যাসের পরিবর্তন ও সিলেটে বন্যার ভয়াবহতা

Must read

রনি খান:

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল ভয়াবহ এক আকস্মিক বন্যার সম্মুখীন হয়। প্রতিবছর অঞ্চলটি এরকম বন্যার সম্মুখীন হলেও এ বছরের বন্যার ভয়াবহতা ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশী। বর্ষাকালে ভারতের আসাম, মেঘালয়, এবং অরুণাচল প্রদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টির পানি বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করায় অঞ্চলটিকে এমন ভয়াবহ আকস্মিক বন্যার কবলে পড়তে হয়। 

ঊজান থেকে দ্রুত বেগে পানি নেমে এসে এখানকার বেশীরভাগ এলাকাকে খুব অল্প সময়ে প্লাবিত করে। ফ্রেন্ডশীপ নামের একটি  সংগঠন যারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষজনের পাশে দাঁড়ায়। তারা তাদের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, বন্যায় সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৭২ শতাংশ পানির নিচে তলিয়ে যায়।

বন্যার ব্যাপক বিস্তৃতি ও পানির ঊচ্চতা বৃদ্ধির কারনে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও ছিল অন্য বছর গুলোর তুলনায় অনেক বেশী। এছাড়াও তারা “বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ” থেকে বন্যার নানা ক্ষতির পরিমাণ ঊপস্থাপন করেন। বন্যার কারনে প্রায় ১২ হাজার ৭০৩ একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এতে আর্থিকভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় এ অঞ্চলে বসবাসকারী লোকজনকে।

“রিলিফ ওয়েব” এর তথ্যমতে ৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে । বিবিসি তাদের জরিপে জানায়, বন্যার কবলে পড়ে ২১ জুলাই এর মধ্যে সর্বমোট  ৩২ জন মানুষ মারা যায়।  

“যুক্তরাষ্ট্রে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্লাবনভূমি ব্যাবস্থাপনা” এই শিরোনামে এক গবেষণায় দেখা যায় বৈশ্বিক উষ্ণতার কারনে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমান খুব দ্রুত বেড়ে যায় এবং সেই সাথে বাষ্পায়নের হারও বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীর সামগ্রিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারনে ভারী বৃষ্টি হয়ে আকস্মিক বন্যার  ঘটনা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আরও জানা যায় এই পরিবর্তন এখন পানির ক্ষীণ প্রবাহকে তীব্র প্রবাহে রুপান্তর করছে। আর সেই ঘটনারই যেনো পুনরাবৃত্তি হয় সিলেটে এবারের বন্যায়। 

তবে সিলেটে বন্যার এমন ভয়ংকর রুপ ধারণের পিছনে আরও কিছু কারন জড়িয়ে আছে যা আমাদের জানা উচিত। প্রাকৃতিক ভূমি ব্যাবহারের ক্ষেত্রে যে অনিয়ম দেখা গেছে এবারের বন্যায় সিলেটবাসী  তারই ফল ভোগ করছে।  বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভয়াবহ বন্যার পেছনে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া একটি বড় কারন।

সিলেটের সুরমা, কালনীসহ আরও অনেক নদীর নাব্যতা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। এর প্রধান কারন নদীপাড়ের ভুমির অপরিকল্পিত ব্যাবহার। আবার নদীগুলো প্লাবনভুমির সাথে ভালোভাবে যুক্ত না হওয়ায় পানির সাথে বয়ে আসা পলির সঠিক বন্টন হচ্ছে না। এতে পলি জমে নদী গর্ভের নাব্যতা কমে যাচ্ছে। 

যার ফলে নদীতে পানির ধারন ক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পেয়েছে। অল্প পানিতেই পাড় উপচে বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে এলাকাবাসী। এছাড়াও উজানের পানি বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাও হারাচ্ছে সিলেটের নদীগুলো।কাজেই আকস্মিক বন্যার হাত থেকে বাচতে নদী ব্যাবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদের খুবই সতর্ক থাকা উচিত।  

কিন্তু এখানে দেখা গেছে তার উল্টো চিত্র। নদীপথের যেখানে সেখানে সুইচ গেট, ব্রিজ, বড় এবং উঁচু রাস্তা চোখে পড়ে। এসব অবকাঠামো পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে ভীষণভাবে বাধা দেয়। ফলে উজানের পানি এসে সহজে ভাটির দিকে নামতে পারছে না। ফলে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণও বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে।

আরেকটি তথ্যমতে সিলেটে অতিরিক্ত পরিমান পাথর উত্তলনের কারনে এই অঞ্চলের ভুমির সাম্যাবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অধিক মাত্রায় খনিজ তুললে যে কোনো অঞ্চলে ভূমিরূপে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পাথর মাটির উপরের স্তরকে অর্থাৎ টপ সয়েলকে ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। পাশাপাশি এটি একটি বিস্তীর্ণ এলাকাকে পানির প্রচন্ড আঘাতের হাত থেকেও রক্ষা করতে সক্ষম। কিন্তু সিলেট অঞ্ছলে  অতিরিক্ত পরিমানে পাথর উত্তলনের কারনে আকস্মিক বন্যার ফলে স্থানীয় পরিবেশ আরো বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। কারন বৃষ্টি বা বন্যার ফলে ভুমিক্ষয়ের মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। 

এদিকে হাওড় অধ্যুষিত এই এলাকার অতিরিক্ত পানি মুলত মেঘনা নদী ও যমুনা নদী হয়ে বঙ্গপসাগরে পতিত হয়। কিন্তু হাওড়ের বিভিন্ন এলাকায় অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। যতই আকস্মিক বন্যা আসুক যদি সুষ্ঠভাবে পানি প্রভাহ থাকে তাহলে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কম হয়ে থাকে। কিন্তু পানির সঠিক প্রবাহ না থাকায় আকস্মিক বন্যার ভয়াবহতা বেশি ছিল। ভবিষ্যতে এই মাত্রা আরও বাড়াতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।  

এছাড়াও সিলেটের প্রাকৃতিক জলাধারের পরিমানও দিনকে দিন হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ  করে বড় ও ছোট শহরের আশেপাশে এসব প্রাকৃতিক পানির উৎস ভরাট করে বাড়ি-ঘর এবং অন্যন্য অবকাঠামো নির্মাণের কারনে ঐ সমস্ত এলাকায় সামান্য পানি প্রবেশ করলেই ধারণক্ষমতা না থাকায় সেটি বন্যায় রুপ নেয় এবং পানি আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করে।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এবারের বন্যায় পানি প্রবাহের মাত্রা অনেক বেশী ছিল, আর পানির পরিমানও অধিক ছিল। যার ফলে শহর এলাকায় এই  বন্যায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এতে বেশিরভাগ মানুষজন শহর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এ সমস্যার সমাধানে প্রাকৃতিক জলাধার পুনরুদ্ধার এবং সংরক্ষণই একমাত্র বিকল্প। অন্যথায় এবছরের মত ভয়াবহ বন্যাকে প্রতিবছর স্বাগতম জানাতে হবে সিলেটবাসীকে।

সিলেটের প্রাকৃতিক ভুমিরুপের মধ্যে এখানকার পাহাড় বা টিলাগুলোও অন্যতম। কিন্তু গত কয়েকবছরে এই এলাকার অনেক পাহাড় ও টিলা কেটে ফেলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ভূমিবিন্যাসের অবক্ষয়ের কারনে সিলেটের বন্যার ভয়াবহতা আরও বেড়েছে। কারণ পাহাড় কেটে ফেলা হলে ভুমির বৈচিত্র নষ্ট হয়ে যায় উচ্চ ভুমি আর নিম্ম ভুমির পার্থক্য থাকে না এতে পানি প্রবাহের দিক ও পরিবর্তিত হয়ে যায়। পাহাড় কাটার ফলে ভূমি ক্ষয়ের প্রবণতাও অনেক বেড়ে যাবে যা নদীর নাব্যতা হ্রাস করতে আরও সহযোগিতা করবে। সর্বোপরি পাহাড় কাটার নেতিবাচক প্রভাব সিলেটের বন্যাকে পরোক্ষভাবে হলেও তীব্রতর করেছে।

২০০৭ সালে “ইকোসিস্টেম এন্ড ল্যান্ড ইউস চেন্জ” শিরোনামে একটি গবেষণায় বলা হয়, ভুমির সঠিক ব্যাবহার নিশ্চিত করাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হয়ে পড়বে। পৃথিবীতে এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানবসৃষ্ট কারনের মধ্যে এই ভূমিরূপের পরিবর্তন অন্যতম। এজন্য প্রাকৃতিকভাবে তৈরী হওয়া ভূমির সঠিক ব্যাবহার ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে না পারলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও বিধ্বংসীভাবে আমাদের উপর আঘাত হানবে। যার প্রমান আমরা এবার সিলেটের বন্যায় হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।

সিলেটে আমরা যেমন সুবিশাল প্রাকৃতিক জলাধার দেখি সেইসাথে পাহাড় টিলার অবস্থানও এই অঞ্ছলকে বৈচিত্রময় করেছে ভুমিরুপের ক্ষত্রে। এই বৈচিত্র শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধিই করছে না, বরং একইসাথে এই অঞ্চলের পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করে চলেছে। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারনে সিলেটের বন্যায় নানা দিক থেকে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এজন্য এই এলাকাকে সম্ভাব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই এখানকার বৈচিত্রপূর্ণ ভূমিকে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি।

“জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা” (FAO) জানায় ভুমিকে এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যেন তা থেকে প্রয়োজনীয় উৎপাদন করা যায় এবং সেইসাথে তার সঠিক সংরক্ষণও নিশ্চিত হয়। এতে করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করা বা ক্ষতিকে  হ্রাস করা সম্ভব হবে।

মনে রাখতে হবে, কোনো নির্দিষ্ট এলাকার ভুমিরুপ তৈরী হওয়ার পিছনে বিশেষ কিছু কারন থাকে যা ঐ নির্দিষ্ট এলাকার বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এবং দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করতেও সাহায্য করে থাকে। 

তাই সিলেটের নদনদী, পাহাড়, হাওড়-বাওড়, ছোট-বড় প্রাকৃতিক জলাশয় সবই সংরক্ষণ করা এখন খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে দাড়িয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে দেখেছেন। তিনি এক বক্তব্যে বলেন এই অঞ্চলে অপ্রয়োজনীয় রাস্তা, সেতু না বানাতে। এমনকি যেখানে বন্যার পানি বাধা পাবে সেখানে রাস্তা কেটে ফেলার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এভাবেই সবার প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা সিলেটকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের  ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পারি।
লেখক:শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article