মোঃ রনি খানঃ
নদী বাংলাদেশের প্রাণ। নদী দ্বারা বয়ে আসা পলি ক্রমাগত সমৃদ্ধ করছে এই বাংলাদেশকে। কিন্তু একইসাথে প্রতিবছর ভয়াবহ নদী ভাঙ্গন ও বন্যার সম্মুখীন হতে হয় এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লাখো মানুষকে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে তৈরী করা হয় বাধ। কিন্তু এতে থেমে নেই বন্যা ও নদীভাঙ্গন। তাই বাধ নির্মান কতটা কার্যকরী এসব দূর্যোগ মোকাবেলায় তা এখন ভাববার বিষয়। পদ্মা নদীতে বাধ ভাঙ্গনের চিত্র এবং বাধ নির্মানের ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মিশরীয় সভ্যতায় মন্দির ও কৃষি জমি রক্ষায় বাধ নির্মান করার প্রমান পাওয়া যায়। সিন্ধু সভ্যতায় হরপ্পা শহরেও বাধ বানানোর ইতিহাস জানা যায়। বাধ বলতে সাধারনত নদীর পাড়কে পাথর বা পানি প্রতিরোধী কোনো শক্ত ও উচু বাধাকে বুঝানো হয় যা বন্যার পানির আঘাত থেকে নির্দিষ্ট একটি এলাকাকে রক্ষা করতে পারে। নদী ভাঙ্গন ও বন্যা ঠেকাতে বাধ একটি অবকাঠামোগত উন্নয়ন হিসেবে খুবই প্রচলিত। বাংলাদেশের নদী শাসন ব্যবস্থায়ও বাধ নির্মান করা হয় দেশের বিভিন্ন নদ নদীর ঝুঁকিপূর্ণ অংশে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাৎসরিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০-২০২১ সালে ৮৯০১৫.২৬ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছে শুধুমাত্র বাধ নির্মান করতে। প্রতিবছরই এমন মোটা অংকের টাকা কেবল এই বাধ নির্মাণে ব্যয় করা হয়।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাধ নির্মান প্রকল্প থেকে প্রতিয়মান হয় যে বাধ নির্মানই একমাত্র সমাধান নদী ভাঙ্গন ও বন্যার হাত থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে। তবে বাধ বানানোর ফলে কী কী বিপদ হতে পারে তা ভূমিরুপ তত্তবিদগণ তাদের বিভিন্ন গবেষণায় বিশ্লেষন করে থাকেন। প্রথমত নদীর যে অংশে বাধ দেওয়া হয় সেই অংশের নদী গর্ভের উচ্চতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে কারন নদীর পানির সাথে যে পলি আসে তা প্রাকৃতিক নিয়মে ছড়িয়ে পড়ে প্লাবনভূমির সমস্তটা জুড়ে। কিন্তু বাধের কারনে পলি ভেতরের দিকে আর প্রবেশ করতে না পারায় তা জমা হতে থাকে নদীর বাধ দেওয়া অংশে। এভাবে বছরের পর বছর এই একই প্রক্রিয়াতে পলি জমা হতে থাকে নদীগর্ভে। ফলে প্লাবনভূমির তুলনায় নদীগর্ভের উচ্চতা বেড়ে নতুন করে সৃিষ্ট হয় জলাবদ্ধতা। দ্বিতীয়ত বন্যা হলে বাধের ভিতরের জমিগুলোতে অতিরিক্ত বালি জমা হতে থাকে যার ফলে ফসলি জমির উর্বরতা ব্যাপকহারে ক্ষতি হয়। কারন বাধের অংশে যেহেতু প্রচুর পরিমানে বালি জমা থাকে তাই খুব সহজে সামান্য বন্যা হলেই বন্যার পানির সাথে অতিরিক্ত পরিমান বালি কৃষিজমিতে ঢুকে যায়। পলির পরিবর্তে বালি প্রবেশ করায় জমিগুলোতে ফসল এর পরিমার ধীরে ধীরে কমে যায়। শেষ পরিণতি হিসেবে বাধ উপচে প্রবল বন্যার সম্মুখীন হতে হয় বাধ সংলগ্ন এলাকাগুলোকে।
অতিরিক্ত বালি প্রবেশে কৃষিজমি নষ্ট, নদী ভাঙ্গন একটি প্রাকৃতিক ঘটনা । নদীর যা ভাঙ্গে তা তার দ্বারাই সৃষ্ট। তাই এই প্রাকৃতিক নিয়মকে পরিবর্তন করলে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। ভারতের একদল গবেষক অজয় নদীর তীরে বাধ সংলগ্ন এলাকায় একটি গবেষণা চালায়।এতে দেখা যায় বাধের ফাটল দিয়ে বন্যার পানি আকস্মিকভাবে প্রবেশ করছে এবং বাধ সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত করছে। আর এই প্লাবনের সময় অতিরিক্ত বালি যে সমস্ত কৃষি জমিতে প্রবেশ করে সেটি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে উঠে। এর ফলে প্লাবিত এলাকার কৃষকরা ভয়াবহ আর্থসামাজিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে ।
আবার প্লাবনভূমির উচ্চতা যদি নদীর গতিপথের উচ্চতার অধিক হয়ে যায় তাহলে ভয়ংকর বন্যা ও জলাবদ্ধতার মত সমস্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। ইতিমধ্যেই সাতক্ষীরাসহ অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে বাধ দেওয়ার ফলে জলাবদ্ধতার সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে যা সম্প্রতি দ্যা ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে । স্যার উইলিয়াম উইলকক্স ১৯৩০ সালে পূর্বভারতের বন্যার কারন খুজছিলেন। তখন তিনি এই বাধকেই প্রধান কারন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । বাধকে তিনি শয়তানের চেইন হিসেবেও উল্লেখ করেছেন এবং খাল খনন করে মূল নদীর সাথে প্লাবন সমভূমির সরাসরি ও স্থায়ী সম্পর্ক সৃষ্টির উপর জোর দেন। গবেষকদের মতে বাধ কেবল কম মাত্রার বন্যার হাত থেকে রক্ষ করতে পারলেও নদীর প্রাণবৈচিত্রের জন্য এটি হুমকির কারন। ভাঙ্গন বাড়ে বন্যার মাত্রা বাড়ে, জমির উর্বরতা নষ্ট হয় সর্বোপরি যে কল্যানের জন্য বাধ নির্মান করা হয় তাতে উপকারের অপেক্ষা অনেক বেশী ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় প্লাবন সমভূমির বসবাসকারী মানুষগুলোর।
যেহেতু বাধ ভেঙ্গে প্রবল বন্যার আশঙ্কা তীব্র এবং সম্পূর্ণ নদীকে বাধ দেওয়া অনেক বেশী ব্যায়বহুল ও অধিক অপ্রাকৃতিক, এজন্য নদী শাসনগত নীতিমালায় আরও পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি অপরিকল্পিতভাবে নদীর যেখানে সেখানে বাধ নির্মান বন্ধ না করলে ভবিষ্যতে বিপদ আরও বাড়তে থাকবে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতিমধ্যেই নদীগুলোতে দেখা দিয়েছে। কাজেই আরও সহনশীল উপায়ে নদী শাসন করতে না পারলে অচিরেই বাংলাদেশের নদীগুলো ধ্বংসের সম্মুখীন হবে এবং আরও বিধ্বংসী হয়ে উঠবে। নদীর প্রাকৃতিক গতিপথ রক্ষা ও এর আশেপাশের নদী ও প্লাবন সমভূমির সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে হবে যাতে করে পলি ও পানি খুব স্বাভাবিক ভাবে প্লাবনভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে প্রাকৃতিক নিয়মে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের মোট ভূমির আশি শতাংশ বা তার অধিক পরিমান নদী দ্বারা সৃষ্ট প্লাবন সমভূমি তাই সৃষ্টির এই ধারাকে অব্যাহত রাখতে না পারলে সংকটে পড়বে দেশ ও দেশের মানুষ।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়