মুতাসিম বিল্লাহঃ
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একজন মহামানব, যার প্রতিটি কথা, কাজ অনুসরণ শুধুমাত্র একজন মুসলিমকে নয় বরং যে কোনো মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোকিত মানুষের শীর্ষে পৌছে দিতে পারে। তিনি এমন একজন মানুষ যার প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ক্ষনের কর্মকান্ডের বিস্তারিত বিবরণ তাঁর মৃত্যুর দেড় হাজার বছর পরেও হুবহু পাওয়া যায়। যা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। তাঁর প্রতিটি নির্দেশনার অনুসরণ একজন পথ হারাকে দেয় পথের দিশা। শারীরিকভাবে রাখে প্রাণবন্ত, মানসিকভাবে দেয় প্রশান্তি। নিজ, পরিবার, সমাজ, রাস্ট্র, আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে পৃথিবীর সামগ্রিক ভারসাম্য রক্ষায় তাঁর মাত্র ২৩বছরের নবুয়াতি জীবন পৃথিবীর জন্য শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। যার কারণে সমগ্র পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ তাঁর চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো, পোশাক পড়া; তথা তাঁর প্রতিটি কর্মকাণ্ডকে অনুসরণ করে। তাঁর দৈনন্দিন অভ্যাস, যাপিত জীবন অনুসরণে যে কোন মানুষকে আধ্যাত্মিক, দৈহিক, নৈতিক ও সামাজিকভাবে সেরা মানুষে পরিণত করে। যার কারণে অমুসলিম হয়েও বিখ্যাত লেখক মাইকেল এইচ হার্ট তাঁর লেখা ১০০জন প্রভাব বিস্তারকারী মানুষের তালিকায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ১ নম্বরে স্থান দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। মাইকেল হার্ট লিখেছিলেন- আমি আমার পছন্দের তালিকায় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালি মানুষ হিসাবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু এর নাম লিখেছি যা আমার অনেক পাঠক কে অবাক করেছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন কেন আমি তাকে প্রথম তালিকায় রেখেছি?এর জবাব হলো পৃথিবীর ইতিহাসে তিনি একমাত্র মানুষ, যিনি ধর্মীয় ও বৈষয়িক উভয় জগতে সর্বোচ্চ সফলকাম।
একজন মানুষের দৈনন্দিন রুটিন, অভ্যাস, কর্মকাণ্ড তাকে সেরা মানুষে পরিণত করে। ঠিক এমন সেরা কাজই ছিলো মুহাম্মাদ সাঃ এর গোটা জীবনে। তিনি মরুপ্রান্তরের একজন আরব হওয়া সত্ত্বেও, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়া সত্ত্বেও, তিনি বাইজেন্টাইন সভ্যতার নাগরিক না হওয়া সত্ত্বেও, এমনকি তিনি একজন এতিম হওয়া সত্ত্বেও, যার কিনা মা মারা গেছেন তার জন্মের ৬ বছরের মধ্যে, বাবাকে হারিয়েছেন জন্মের আগেই এবং তিনি তার জীবনের একটি বড় অংশ কাটিয়েছেন দারিদ্র্য অবস্থায়, তারপরেও তিনি সফল হয়েছেন। তিনি তার মিশনে শতভাগ সফল ছিলেন। যদিও এই মিশনের তাঁকে ঘর বাড়ি ছাড়তে হয়েছে, প্রিয় স্বদেশ ছাড়তে হয়েছে, কাছের আত্নীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব হারিয়েছেন, সত্যের বার্তা দেয়ার কারণে তাকে নানা ধরনের জুলুম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, কিন্তু তবুও তিনি অনড় ছিলেন, স্থির ছিলেন নিজের কর্মসম্পাদনায় এবং দিনশেষে সফল হয়েছেন। বর্তমানে কোটি কোটি মানুষ তার অনুসারী, তাকে ভালবাসে হৃদয় থেকে, এবং তার বার্তা চৌদ্দশ বছর পরেও সে আগের মতই অবিকৃত, অবিকল অবস্থায় আছে।
বর্তমান আধুনিক জীবনে আমরা শুধুমাত্র প্রযুক্তিতে উন্নত করেছি, আমাদের মানবিকতায় আমরা উন্নত করতে পারি নাই, এজন্য বোধহয় মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, আমাদের বৈজ্ঞানিক শক্তি আমাদের আধ্যাত্মিক শক্তি কে শেষ করে দিচ্ছে, আমরা মিসাইল যেন ঠিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে সে উপলক্ষে অতি সূক্ষ্ম টেকনোলজি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি, কিন্তু মানবতাকে উপেক্ষা করার কারণে, মানবিকতা আজ গতিপথ হারিয়েছে।
আমরা যদি বিশাল অট্টালিকা বিত্ত-বৈভব নিয়ে বসবাস করা মানুষের জীবন দেখি, অনেক সময় আমরা বিভ্রান্ত হই, কিন্তু যদি আমরা তাদেরকে আরেকটু গভীরভাবে কাছ থেকে দেখি, তাহলে আমরা দেখতে পাই জীবনে গরিব ও ধনী উভয়ই একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়, সুতরাং জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে, আমাদের নানা কাজে ভারসাম্য আনয়ন করতে, নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক বাড়াতে, ভালোবাসা হাসি-কান্না রাগ দুঃখ ক্ষোভ সবকিছুর মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে পেতে, একজন মানুষকে মডেল হিসেবে নিতে পারি, তিনি হলেন রাসুল সাঃ তার স্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, ‘খুলুকুল কুরআন’ সমগ্র কুরআন ই তার চরিত্র ছিল। কুরআনের বর্ণিত বৈশিষ্ট্যসমূহ তাঁর জীবনে আমরা দেখতে পাই।
আমরা মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যে রুটিন দেখি তাতে দেখতে পাই বর্তমান দুনিয়ার নয়টা- পাঁচটা রুটিনের মতো তাঁর রুটিন ছিলো না বরং তার রুটিন ছিল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সাথে। তিনি কোন সময়ের অপচয় করেন নি বরং প্রতিটি সময়ের সবচেয়ে সেরা ব্যবহার করেছেন। ইসলাম প্রচারে তাঁর প্রাথমিক ভূমিকা ছিল মানবতাকে সংরক্ষণ করা, তাদেরকে আল্লাহর পথে ডাকার মাধ্যমে মানুষের গোলামী থেকে বাঁচিয়ে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে গড়ার দাওয়াত দেওয়া, এটাই ছিল তাঁর সার্বক্ষণিক কাজ। এর বাইরেও তিনি ছিলেন একজন সফল বাবা, একজন সফল নানা, একজন সফল স্বামী, এবং সর্বোপরি একজন সফল নেতা। আমরা রাসুলুল্লাহ সাঃ এর মদিনা জীবনের দৈনন্দিন রুটিন থেকে সেই সব বিষয়ে দেখি সাধারণত, তাঁর দৈনন্দিন কাজের শুরু হতো ফজরের নামাজের আগে থেকে। মধ্যরাতে দীর্ঘ ইবাদত করে এসময় তিনি ‘ন্যাপ’ নিতেন। অর্থাৎ তার চোখ বন্ধ থাকতো কান সজাগ থাকতো। বিলাল রাদিআল্লাহু যখন আযান দিতেন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম তখন চোখ খুলতেন, তাঁর প্রথম কাজ ছিলো মেসওয়াক করা, ঘুম থেকে জেগে উঠার দোয়া পড়তেন, নিজেকে নামাজের জন্য তৈরি করতেন, বাড়িতে তিনি সুন্নত নামাজ পড়তেন, এরপর ডান দিকে কাত হয়ে বিলাল রাঃ এর নামাযে ডাকার অপেক্ষা করতেন। এ সময় তাঁর স্ত্রী আশেপাশে থাকলে তিনি তাঁর সাথে কথা বলতেন, ভালোবাসতেন, রোমান্টিকতা থাকত সে সময়টাতে। দিনগুলো তিনি প্রশান্তি নিয়ে শুরু করতেন। তিনি কিভাবে এ সময়গুলো কাটাতেন তা তাঁর কথায় বোঝা যায়। তিনি বলেছেন, ‘যে একদিনের জন্য শারীরিকভাবে সুস্থ থাকে, এক দিনের খাবার যার থাকে, তার মনে করা উচিত তাকে সমগ্র দুনিয়া দান করা হয়েছে।’
যখন বেলাল রাদিয়াল্লাহু দেখতেন মানুষেরা— সবাই নামাজের জন্য একত্রিত হয়েছেন তখন তিনি নবী সঃ ইসলামের নিকট এসে তাকে সালাতের জন্য ডাকতেন, তখন রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তেন, আকাশের দিকে তাকিয়ে দোয়া পড়তেন, তারপরে তিনি ডান পা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতেন। এরপরে ইকামত হতো, সাহাবীরা নামাজের পেছনে দাঁড়াতেন তার নেতৃত্বে সবাই ফজরের নামাজ আদায় করত, নামাজের পরে দোয়া পড়তেন, এরপর সাহাবীদের দিকে ফিরে বসতেন। যখন কিনা সাহাবীরা ঘুম থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সতেজ সালাত আদায় করতেন তখন তিনি তাদের সাথে কথা বলতেন, এ সময়ে মাঝে মধ্যে তিনি তাদেরকে শিক্ষনীয় কথা বলতেন যা শুনে তাদের চোখের কান্না চলে আসত, কখনো আবার সৃজনশীলতা সৃষ্টিশীলতা বাড়াতে প্রশ্ন করতেন, কখনো আবার সাহাবীদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতেন, কখনো বা সাহাবীরা জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্ন বিষয়ে মনোযোগী হয়েছেন। সূর্য উদয় হওয়ার আগ পর্যন্ত সাহাবীদের সাথে তিনি অবস্থান করতেন।
সূর্যোদয়ের পর তিনি বাসায় ফিরে যেতেন, বাসায় ফিরে ডান পা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেন। এ সময় তিনি দোয়া পড়তেন, বাসায় ফিরে আবার মেসওয়াক করতেন, পরিবারের সবার সাথে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন, তিনি বাসায় ফিরে জিজ্ঞেস করতেন ঘরে কোন খাবার আছে কি না? যদি থাকতো খেতেন না থাকলে তিনি বলতেন আমি রোজা। আমরা তার সকালের দৈনন্দিন রুটিন থেকে দেখতে পাই তিনি সূর্যোদয়ের আগে উঠতেন, এটি প্রায় প্রত্যেক সফল মানুষের জীবনী থেকে আমরা দেখি, তারা সকলেই ভোরে উঠত।
এ বিষয়ে মুহাম্মদ সাল্লাহু সাল্লাম বলেছেন আমার জাতির জন্য দিনের শুরুতে বরকত আছে। তিনি দিনের শুরুতে উঠে সকাল সকাল মিসওয়াক করতেন, নামাজের জন্য অপেক্ষা করতেন, দিনের শুরুটা সকলের সাথে হাসিখুশিভাবে কৃতজ্ঞতার সাথে শুরু করতেন, প্রত্যেকটা দিনকে গিফট হিসেবে মনে করতেন, যেন ঘুমিয়ে পড়া মুহূর্ত কে মৃত্যু মনে করে একটি দিনকে নতুন একটি জীবন মনে করতেন। তিনি ভেতরে প্রবেশ করার সময় ডান পা দিয়ে প্রবেশ করতেন, মসজিদ থেকে বের হতেন বাম পা দিয়ে। সবকিছুর জন্য দোয়া পড়তেন। এরকম নিয়ম নীতি যে কাউকে আধ্যাত্মিকভাবে ভালো রাখে।
তার জীবনে প্রথম কাজ ফজরের নামাজ, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, এরপরে জীবনের লক্ষ্য কি সে বিষয়ে আলোকপাত করতেন। আমাদের জীবন যেমন শুরু হয় ফেইসবুকিং কিংবা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে, কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সূর্যোদয়ের আগে তাঁর সঙ্গী সাথী প্রিয়জনের সাথে সম্পর্ক নবায়ন করতেন, পরিবার প্রতিবেশী সবার সাথে অর্থবহ আলোচনা করতেন, সকালে খাবার পেলে খেতেন, না পেলে রোজা রাখতেন।
আমরা সকালে চা কফি বা অন্য কোনো নির্দিষ্ট আইটেম দিয়ে শুরু করি, যেন আমরা এর বাইরে জীবনকে চিন্তাই করতে পারি না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করতেন- আমরা দেখি বাড়ি থেকে পরিবারের সবার সাথে সাক্ষাৎ করে তিনি আবার মসজিদে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়তেন তার পরে তিনি মসজিদে বসতেন এবং সাহাবীরা তাকে ঘিরে বসতেন। এ সময়টাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মসজিদে থাকতেন সাহাবীরা কমবেশি জানতেন। এ সময় যারা প্রয়োজন বোধ করতেন তারা ইসলামের কথা শোনার জন্য, কোন কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য তাঁর কাছে আসতেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ প্রদত্ত আয়াত শেখানোর জন্য সময় ব্যয় করতেন এর পাশাপাশি তিনি তাঁর কমিউনিটির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক সম্পর্কগুলি নবায়ন করতেন।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কাছের ও দূরের মানুষের কাছ থেকে আসা প্রতিনিধিদলের সাথে সাক্ষাৎ করতেন কখনো বা নব মুসলিমদের সময় দিতেন, বা যারা এখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কে ভালবাসেন এমন মানুষদের কে, তাঁর অতিথিদের সম্ভাষণ দিতেন। তাদের খোঁজখবর নিতেন। তাদের কিভাবে সহযোগিতা করতে পারেন সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেন। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তাদেরকে নিয়ে তাদেরকে ঘিরে বসতেন এ সময় তার নির্দিষ্ট কোন আসন ছিল না, ছিল না আসনের নির্দিষ্ট কোন প্রতীক । ফলে ওই সময়ে নতুন কোনো আগন্তুক আসলে তারা রাসূল সাল্লাহু সাল্লাম কে শনাক্ত করতে সময় লাগত।
মুহাম্মদ সাল্লাহু আলাইসালাম এর জন্য খাবার আসলে তার আশেপাশের সবাইকে নিয়ে বসতেন, অনেক সময় অল্প খাবার তাদের সবার জন্য যথেষ্ট হত। উপস্থিত সাহাবীরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ঢেকে রাখা খাবারকে বারাকাহ হিসেবে নিতেন । সূর্যোদয় থেকে দুপুর পর্যন্ত এই সময়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো আবার তাঁর আত্মীয় স্বজনদের সাহাবীদের বাড়িতে সফর করতেন। কখনো বা মেয়ে ফাতেমার কাছে যেতেন। নাতি নাতনির সাথে সময় দিতেন। ওদের সাথে খেলাধুলা করতেন। কখনো বা কোন সজন সাহাবীদের বাড়িতে যেতেন। যে কিনা অসুস্থ বা যার পরিবার তার প্রিয় কাউকে হারিয়েছেন এমন মানুষের পাশে দাড়াতেন। কখনো বা এই সময়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মার্কেটে যেতেন, যাদেরকে দেখতেন মুচকি হাসি দিয়ে সালাম দিতেন। শিশু-কিশোরদের সাথে কথা বলতেন, কেউ যদি তাকে থামতে বলতেন, তাহলে তিনি থেমে তাদের কথা শুনতেন, এবং তাদেরকে সহায়তা করার চেষ্টা করতেন, জানতে চাইতেন কিভাবে তাদেরকে সহায়তা করা যায় । সঙ্গী সাথীদের সাথে রাখতেন।
দুপুরের আগে মুহাম্মদ সাঃ বাসায় ফিরতেন। বাসায় ফিরে তিনি আবার মিসওয়াক করতেন, পরিবারের সবাইকে সালাম দিতেন, বাসায় কয়েক রাকাত সালাত আদায় করতেন, এরপর খাবারের অনুসন্ধান করতেন যদি না পেতেন তাহলে আবার রোজা কন্টিনিউ করতেন, ঠিক এ সময়ে মদিনার নারীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আসতো তারা এ সময় রাসূল সাল্লাহু সাল্লাম কে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞেস করত যা পুরুষ সাহাবীদের সামনে জিজ্ঞাসা করতে সুযোগ পেত না, তারা তাই এ সময় আসত।
এ দুপুরের সময় তিনি তার পরিবারকেও সহযোগিতা করতেন, তাদের কাজে কর্মে সেবা সাহায্য করতেন। এ সময় তিনি নিজের জুতা জামাকাপড়ের কোন অংশ জোড়া দেওয়া লাগলে তার জোড়া দিতেন, ভেড়া ও ছাগলের দুধ দহন করতেন, নিজেরও ঘরের টুকটাক কাজ সারতেন। এ সময় তিনি তাঁর পরিবারের মাঝে হাসিখুশি প্রাণবন্ত সময় কাটাতেন। কখনোবা এই সময়ে তার খুব কাছের যারা তাঁরা তাঁর বাসায় আসতেন।
এরপর জোহরের নামাজ আদায় করা পর্যন্ত ন্যাপ নিতেন। মানে চোখ বন্ধ কিন্ত কান সজাগ। যখন জোহরের নামাজের সময় হযরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু তায়ালা নামাযের জন্য আযান দিতেন, তিনি ন্যাপ থেকে উঠে অজু করে চার রাকাত ঘরে নামাজ আদায় করতেন, এরপর জোহরের নামাজের জন্য অপেক্ষা করতেন, তারপর তিনি মসজিদে গেলে বিলাল ইকামত দিতেন জোহরের নামাজের পরে কোন আধ্যাত্মিক নৈতিক বা সামাজিক বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলে বলতেন, এরপর তিনি বাসায় ফিরে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। তারপরে সাহাবীদের সাথে আসরের দিকে বেরিয়ে পড়তেন যদি কোন দায়িত্ব পালনে বের হওয়ার প্রয়োজন হতো, নয়তো মসজিদে থাকতেন।
আসরের নামাজ পড়ার পরে বিকেলের সময়টুকু পরিবারের মাঝে দিতেন। আনন্দঘন পরিবেশ করে রাখতেন। মাগরিবের নামাজের পরে সাধারণত মদীনার ঘরবাড়িতে রান্নার ধুম পড়ে যেত, ইশার সালাত আদায়ের আগেই খাবার খাওয়ার রীতি ছিলো। মুহাম্মাদ সাঃ কখনো একাকী খেতেন না, হয় পরিবারের সদস্যদের সাথে, কিংবা মেহমানদের সাথে অথবা মসজিদে নববীতে অবস্থান করা আসহাবে সুফফার সদস্যদের সাথে খাবার খেতেন।
এশা সালাত আদায়ের পরে কখনো কখনো তিনি মদীনার অলিতে গলিতে একাকী বের হয়ে মানুষের অবস্থার খোঁজ-খবর রাখতেন, তবে অধিকাংশ সময়েই তিনি ইশার সালাত শেষ করে খুব বেশি সময় না করে ঘুমিয়ে পড়তেন, এবং গভীর রাতে জেগে ওঠতেন। এ সময়টাতে তিনি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে নিবিড়ভাবে রবের ইবাদাতে মশগুল হতেন। কখনো কখনো ভোররাতে মদীনার মারা যাওয়া মানুষের জন্য কবরের নিকট গিয়ে দোয়া করতেন। এভাবে তাঁর প্রতিটি দিনে নিজ, পরিবার, সমাজ, রাস্ট্র, মৃত্যুব্যক্তিদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা, আল্লাহর ইবাদতে সময় কাটিয়েছেন। সময়ের সঠিক ব্যবস্থাপনা, সম্পর্কের ভারসাম্যর অতুলনীয় দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন। যার কারণে মাত্র ২৩ বছরের নবুয়াতি জিন্দেগীতে পুরো পৃথিবীতে এমন এক পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন যা তাঁর আগে কেউ পারেনি, না পরবর্তীতে কেউ পেরেছে।
মুহাম্মাদ সাঃ এর কর্মপন্থায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো দুটো জিনিসের মধ্যে সমন্বয়। প্রথমত, তাঁর দৈনন্দিন কার্যাবলী, যা বিভিন্ন ঘটনা ও বাস্তবতার সাথে জড়িত এবং যা নির্ধারিত হয় স্থান ও কালের প্রয়োজন দ্বারা। দ্বিতীয়ত ভবিষ্যত পর্যন্ত বিস্তৃত সীমাহীন দিগন্ত। রাসুল সাঃ কে বর্তমানের পাশাপাশি ভবিষ্যতকে মাথায় রেখে তাঁর জন্যও দিকনির্দেশনা তৈরি করতে হয়েছিলো। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে মুহাম্মাদ সাঃ অতীত ঐতিহ্যের ভালো দিকের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে কাজ করতেন এবং এতে প্রতিস্থাপিত খারাপের মোড়কটিকে ছুঁড়ে ফেলতেন। তিনি এমন এক পন্থা অবলম্বন করেছেন যেটি ভালো ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে না, বরং উত্তরাধিকার হিসেবে গ্রহণ করে নেয় এবং আঁকড়ে ধরে, সেটা আগের নবী রাসূলদের প্রচলিত ভালো ঐতিহ্যই হোক অথবা যেকোনো জাতির মানুষ দ্বারা যেকোনো সময়ে প্রচলিত ভালো ঐতিহ্য।
রাসূল সা. এর কৌশলগত কর্মপদ্ধতি কখনো ধ্বংসাত্নক ছিল না। কুরাইশ ও বাকি আরব গোত্রগুলোর সাথে লেনদেনের পুরো সময়টাতেই তিনি চেয়েছেন তারা যেন পরাজিত না হয়েই তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব বহনে শরীক হয়। তাঁর স্ট্রাটেজির একটি উদ্দেশ্যই ছিল তাদের অবস্থার উন্নতি করা ও তাদের মর্যাদার হেফাজত করা এবং তাদেরকে তাদের কুসংস্কারমুলক চিন্তা ও বিশ্বাসের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা।
এরপর রাসুল সাঃ যে মূলনীতিকে জরুরী ভিত্তিতে অনুসরণ করতেন সেটি হচ্ছে তৎক্ষনাত ও তড়িৎ কর্মপন্থার বদলে দীর্ঘমেয়াদী ও ক্রমধারাময় কর্মপন্থা অনুসরণ করা, যদিও তখন মক্কার অবস্থা ছিল তিক্ত, নিরাশাময় এবং ভবিষ্যতহীন। কিন্তু এরপরেও রাসুল সা. এর এ ধরণের কর্মপন্থা ছিল দীর্ঘক্লেশাক্ত পথে বিরামহীন পথ চলা ও তড়িৎ পরিবর্তনের মূলনীতি পরিহার করার ফলাফল।
তাঁর আরেক মূলনীতিটি ছিল বর্তমানের সংকীর্ণতা ও এর খুঁটিনাটির মধ্যে ডুবে যাওয়ার পরিবর্তে গভীর আশাবাদ পোষণ ও ভবিষ্যতের অপার সম্ভাবনার দিকে তাকানো। এইটাই রাসুল সা. কে কৌশলগত ধৈর্য, স্থীরতা এবং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সাহায্য করেছে।
মুহাম্মাদ সাঃ কখনো তাঁর অনুসারীদের বিভিন্ন দলে-উপদলে ভাগ হতে দেননি। বরং তিনি সবসময়ই একতা বজায় রাখা এবং নতুন নতুন সন্ধি গঠন ও শক্তিশালীকরণের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। এটা যে শুধুমাত্র তিনি তাঁর সাহাবী ও ঈমানদারদের মধ্যে করতে চাইতেন তা নয় বরং পুরো মদীনার সমাজ ও এই রাষ্ট্রে শরীক অমুসলিমদের জন্যও তাঁর একই নীতি বরাদ্দ ছিল।
রাসূল সা. এর মাঝে অনুকরণীয় পথের উপর চলার প্রচেষ্টা ছিল তবে কিছুতেই তা রাসুলুল্লাহকে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে বিরত রাখতে পারেনি। মুশরিক চাচা আবু তালিবের আশ্রয় নিয়েছেন, দাদা আব্দুল মুত্তালিব কর্তৃক বনু খুজাআদের সাথে মৈত্রী করেছেন। হাবশার ন্যয় পরায়ন বাদশাহর সাথেও যোগাযোগ রেখেছেন নিসঙ্কোচে। ইয়াসরিবে বনু নাজ্জারের মামাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে দ্বিধা করেননি। প্রথা ও রীতির প্রতিও ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। গোত্রগত নিয়ম ও লোকাচার অক্ষুন্ন রেখেছেন। এছাড়াও ওমানের দুই বাদশাহকে ইসলাম গ্রহণের পর আপন আপন জায়গায় বহাল রাখেন। একই আচরণ করেছেন বাহরাইন ও ইয়ামেনের পারসিক রাজার সাথেও।
রাসূল সা. যেকোনো প্রকল্পেই মানুষের মাঝে একটা নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতেন। প্রতিটি মানুষকেই সেই প্রকল্পে অংশিদার ও মালিক করে দিতেন। কারণ প্রতিটি মানুষের স্ব-স্ব ভূমিকার গুরুত্ব বুঝতে পারতেন, এছাড়াও ঈমানী তাড়ণাও তাঁর ছিল। বংশ, সম্পদ ও বিত্ত-বৈভব কিংবা প্রভাব প্রতিপত্তির ভিত্তিতে একের উপর অন্যের শ্রেষ্ঠত্য ছিল না। এই সম্পর্কটাই সাধারণ সাহাবাদের মাঝে সৃষ্টিশীলতা, কর্মনৈপুণ্য ও উদ্যোগের জোয়ার এনেছিল। গোলাম কোনো চমকপ্রদ নতুন চিন্তা ও আইডিয়া ‘শেয়ার’ করেছে আর মনিব তা অবলীলায় গ্রহণ করেছে। গোলামের প্রস্তাব গ্রহণ করতে উচ্চবংশীয় মনিবের কোনো কষ্ট হচ্ছে না। নও মুসলিম নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রবীণ সাহাবারা। উঠতি বয়সি যুবক কথা বলছে আর প্রবীণ বৃদ্ধ কান পেতে শুনছে সে কথা।
রাসুল সাঃ এর কর্মকৌশল ও এর দিকনির্দেশনায় ইসলাম একটি বিশ্বজনীন ধর্মে পরিণত হয়েছে। তাই এ দাওয়াত জাতিগত, ভাষাগত ও নৃতাত্ত্বিকগত সকল স্থানিক সীমাবদ্ধতা এবং সাময়িক প্রয়োজনীয়তা ও জরুরতমন্ডিত সকল কালিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রান্ত করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু দীর্ঘদিন সাম্রাজ্যবাদীদের উপনিবেশ হিসেবে থাকা জ্ঞানচর্চা থেকে দূরে থাকার কারনে জ্ঞানের আপডেট বিষয়গুলো এর সুগভীর ব্যাখ্যাগুলো মুসলমানদের জন্য কঠিন হয়ে গেছে। জ্ঞানের রাজ্যেও মুসলিমরা পিছিয়ে গেছে।
এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে মুসলিমদের উসকে দিকে আন্তর্জাতিক একটা চক্র বরাবরই মুহাম্মাদ সাঃ কে আঘাত করার মধ্য দিয়ে মুসলিমদের সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত। যে মানুষটির দৈনন্দিন জীবন, চলার পথের কৌশল, মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে, স্বাভাবিক জীবনকে বিসর্জন দিয়েছেন। সম্পদ দু হাতে বিলিয়েছেন, মানুষ-পশু-পাখি তথা সবলদের পাশাপাশি দুর্বলের মাঝে সমতা সাধনে চেষ্টা করেছেন সেই মহামানবকে আমরা নিজ জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। অন্ধকারের শক্তিদের জানা দরকার, কোনো অপচেষ্টা, চক্রান্তে পৃথিবীর সেরা মহামানবকে কোনো কালিমালেপন করা যাবে না, বরং নিজেদের লেজকাটা শেয়ালের চরিত্রের খারাপ দিকগুলোই প্রকাশ হয়ে যাবে। যে মহামানবের কথা ও কাজের সাথে গোটা জীবনে কোনো অমিল পাওয়া যায়নি। সে মহামানব, মানবতার মুক্তির দিশারী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমরা আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোন, মান-মর্যাদার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। তাঁর জন্য আমরা আমাদের জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত।
নোক্তাঃ বেশ কয়েকটি সীরাতগ্রন্থ অবলম্বনে প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে।