28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

যেকারণে বিশ্ব সূচকে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম নেই

Must read

আহমেদ ইউসুফ আকাশ: 

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কিউএস (কোয়াককোয়ারেল সিমন্ডস) বিশ্বের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করেছে। এতে ২০২১-এ বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা পেয়েছে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি।

তবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) বিশ্বসেরা ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ তালিকায় স্থান হয়নি বাংলাদেশের এক সময়কার প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)। টানা পঞ্চমবার কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ে ৮০১ থেকে ১০০০তম অবস্থানে রয়েছে দেশসেরা এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়৷ এ ছাড়া গতবারের মতো এবারও কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ে ১০০১ থেকে ১২০০তম স্থান অর্জন করেছে বেসরকারি ব্র্যাক ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাঙ্কিং মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান কিউএস গত বুধবার তাদের ওয়েবসাইটে এই র‍্যাঙ্কিংয়ের তথ্য প্রকাশ করেছে। ‘কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিংস ২০২৩: টপ গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিস’ শীর্ষক এই র‍্যাঙ্কিংয়ে সেরা ৫০০-এর পরে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুনির্দিষ্ট অবস্থান প্রকাশ করা হয় না। এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে কত নম্বরে, তা উল্লেখ করেনি ।

কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ের যে সূচকে এ তথ্য প্রকাশ করা হয় তা হলো একাডেমিক খ্যাতি (একাডেমিক রেপুটেশন), চাকরির বাজারে সুনাম (অ্যামপ্লয়ার রেপুটেশন), শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত (ফ্যাকাল্টি-স্টুডেন্ট রেশিও), শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতি (সাইটেশনস পার ফ্যাকাল্টি), আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত (ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাকাল্টি রেশিও), আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাত (ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট রেশিও), আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক (ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ নেটওয়ার্ক) এবং কর্মসংস্থান (অ্যাম্প্লয়মেন্ট আউটকামস)।

এ বছরের কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাংকিংস বিশ্বজুড়ে শীর্ষস্থানীয় এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রকাশ করেছে। যেখানে সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্তির জন্য মূল্যায়ন ও বিবেচনা করা হয়েছিল। প্রতিটি বিষয়ের ৫১টি মানদণ্ড অনুসারে কিউ এস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাংকিংয়ে বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা করা হয়।

তবে এই সূচকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান না থাকায় ইতোমধ্যে দেশব্যাপী সমালোচনা তৈরী হয়েছে। বিশেষ ব্যাক্তিবর্গ ঐ তালিকায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম না থাকায় নিদারুণ আপসোস প্রকাশ করেছেন।

তবে বস্তত ঠিক কি কারনে বিভিন্ন সূচকে আমাদের নাম আসে না! কিংবা সনামধন্য সূচকগুলোতে নাম আসার জন্য যে পরিমাণ কর্মপদ্ধতি, গবেষণা, বরাদ্দ, এবং পরিবেশের প্রয়োজন হয় সেটি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি কিনা এ বিষয়টি নিয়ে খুব স্বল্প পরিমানে আমরা কথা বলি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে চোখ বুলাতেই আমরা দেখি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, ছাত্র শিক্ষক রাজনীতির খবর। কিন্তু আদতে বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সাথে দেশীয় চিন্তাচেতনা, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দক্ষতা এবং সমপরিমাণ ইচ্ছাশক্তি আমাদের কতটুকু আছে এটি প্রশ্ন রেখে যায়।

পরিবেশের কথাটি একারণে উল্লেখ করা যে, উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন আর বিদেশী শিক্ষক চাকরি করতে আসেন না। একই কারণে আগের মতো বিদেশী শিক্ষার্থীরা আমাদের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে আসতে চায় না। এর আরেকটি কারণ, হালনাগাদ তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইট আমাদের নেই। লক্ষণীয়, ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাকাল্টি (বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী) রেশিও এবং ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট রেশিও কিন্তু কিউএস র‌্যাংকিংয়ের দু’টি মেট্রিকস বা মাপকাঠি। অতএব, এই দুই মেট্রিকসের স্কোরে আমাদের পিছিয়ে পড়তে হয়। ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে অন্যান্য যেসব মাপকাঠি বা ক্রাইটেরিয়া বিবেচিত হয়, সেসব ক্ষেত্রে আমরা অনেকদূর পিছিয়ে থাকি।

এর বিপরীতে আমরা লক্ষ করি, পাশ্চাত্যের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে সবমহলে সমাদৃত অনেক ফ্যাকাল্টি (শিক্ষকমণ্ডলী) সায়েন্টিস্ট ও স্কলার। রয়েছে উপযুক্ত অবকাঠামো ও তহবিলের পর্যাপ্ত জোগান। এই তহবিল শুধু এরা গবেষণার পেছনেই ব্যয় করে না, খরচ করে দেশে-বিদেশের পণ্ডিতজনদের তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নেয়ার জন্য। এর মাধ্যমে এরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ট্যালেন্টপুল গড়ে তুলতে চায়। সেখানে করপোরেট জগৎ ও বিশ্ববিদ্যালয় ফ্যাকাল্টির মধ্যকার সহযোগিতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে করে তোলে অধিকতর শক্তিশালী।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকার আরেকটি বড় কারন হতে পারে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তথ্যের অভাব এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধতা। এক্ষেত্রে তথ্যের অভাব বলতে কিউএস র‌্যাঙ্কিংয়ে স্থান পেতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সক্রিয়ভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য পাঠাতে হবে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি তথ্য না পাঠায়, র‌্যাঙ্কিংয়ে স্বভাবতই তাদের স্থান হবে না।

আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধতা বলতে র‌্যাঙ্কিংয়ের বড় একটা অংশ আসে গবেষণার হিসাব থেকে। গুটি কয়েক বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার চল তেমন নেই। আগ্রহী শিক্ষকদের তেমন কোনো প্রণোদনা নেই। গবেষণা খাতে বরাদ্দ এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণার জন্য অনুদান দেওয়ার প্রথা বিরল বলে স্বভাবতই গবেষণা খুব কম হয়। কাজেই যেকোনো র‌্যাঙ্কিংয়ের একটা বড় অংশে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তেমন ভালো স্কোর করতে পারবে না, যত দিন না আমরা স্নাতকোত্তর গবেষণার ওপরে জোর দিচ্ছি।

একইসাথে বাংলাদেশের জন্য দরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বেসিক পলিসি প্রণয়ন। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি সম্পন্ন করে বেসিক পলিসি প্রনয়ন সম্ভব নয়। বরং নিয়োগ এবং পদোন্নতিতে ক্রাইটেরিয়া পরিবর্তন করা জরুরী। বিভিন্ন পদে ভালো এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড এবং ভিসি-প্রোভিসিসহ প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দিতে হবে। একইসাথে গবেষণার ফান্ডিং করা উচিত প্রপোজাল ও গবেষকের ট্র্যাক রেকর্ড দেখে।  তাহলে পরিবত‍র্নের আশা করা যেতে পারে।

সর্বপরি, আমাদের এডুকেশন সেক্টরে একজন ভালো নেতা প্রয়োজন। যিনি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবেন। টেকসই শিক্ষা কাঠামো গড়ে তুলবেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article