28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

জ্ঞান ও দানের দুরবস্থা দেশের বড় সংকট

Must read

মুতাসিম বিল্লাহঃ

একটা জাতির সংকটকে শনাক্ত করতে না পারলে তাঁর সমাধান ও সম্ভাবনাকে ধরা যায় না। বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সংকট হচ্ছে ‘জ্ঞান’ ও ‘দানের’ সংকট। এটা এতোটাই ভয়াবহ অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে অতীত যেকোনো সময়ের চেয়ে তা বহুগুন। প্রকৃত জ্ঞান ও জ্ঞানের চর্চা যেমন সম্পদ অর্জনে ভূমিকা রাখে, আবার জ্ঞানের গভীরতা মানুষকে মানবিক হতে, নৈতিক হতে, সম্পদ জিইয়ে রাখার পরিবর্তে সকলের সেবায় সম্পদের সঠিক ও উপযুক্ত স্থানে ব্যবহারে ব্যক্তিকে উদ্ধুদ্ধ করে।

বর্তমান পশ্চিমা বিশ্ব জ্ঞান ও দানের প্রতিযাগিতা অংশগ্রহণ করে, জ্ঞান ও গবেষণা চর্চার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করেছে। মানুষ গড়ার কারিগড় ও জ্ঞানের নবীশদের তারা যথাযথ সম্মান ও মুল্যায়ন, তাদের যথাযথ সম্মানী দিচ্ছে, আজ তাঁরা সারাবিশ্বের মেধাবীদের মিলনমেলার তীর্থ স্থানে পরিণত হয়েছে। এর ফলাফল হিসেবে তাঁরা প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে এখনো নিজেদেরকে নব নব আবিষ্কার, সমস্যার সমাধানের মধ্য দিয়ে নেত্বত্বের আসনে অধিষ্ঠিত রাখতে পেরেছে।

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাগ-ইতিহাস এর নবোপলীয় সময় মেহেরগড় থেকে শুরু হওয়া কৃষিভিত্তিক সভ্যতা থেকে বর্তমান সময়ে আসতে আমরা প্রায় ৮হাজার ২শ বছরের ইতিহাস অতিক্রম করেছি। এরপরে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা আমরা অতিক্রম করেছি, বৈদিক যুগে এসে আর্যরা এ উপমহাদেশ নিয়ন্ত্রণ করেছে, ষোড়শ মহাজনপদ থেকে পরবর্তীতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গড়েছে, কখনো আমরা মাৎসন্যায় অবস্থা অতিক্রম করেছি। এভাবে মেহেরগড়, মহোঞ্জোদারো থেকে শুরু করে মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত, পাল, সেন, সুলতানী ও মোগল আমলে এই উপমহাদেশে আদি নৃ-গোষ্ঠী, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, মুসলিম ধর্মাবলম্বীসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস। সময়ের পরিক্রমায় কারও উত্থান ঘটেছে কারও পতন হয়েছে। তরবারি কিংবা ক্ষমতার দাপটের চেয়ে জ্ঞানের ও দানের দাপটই তাদেরকে শাসন ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী করেছে। এর বিপরীত আচরণ সাময়িক সময়ে কাউকে ক্ষমতায় আনলেও অল্প সময়ে শরীর নিয়ন্ত্রণ করলেও সে শাসকরা জনগনের হৃদয় জয় করতে পারেনি। সুতরাং পৃথিবী জুড়েই একই ঘটনা দেখা যায়, যে জাতি তার অধিনস্থ মানুষের শরীর ও মন নিয়ন্ত্রণ করেছে ইতিবাচকভাবে কিংবা দানশীল জনহিতৌষি শাসক হিসেবে, তাঁর পেছনে সে জাতির দান ও জ্ঞানের প্রতি বদান্যতা প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলায় প্রাচীন ও মধ্যযুগের অসংখ্য বিহারগুলো আমাদের ইতিহাসকে গৌরাবান্বিত করে। এদেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাবিদ হিসেবে অতীষ দিপঙ্কর, শীলভাদ্রসহ নানা বৌদ্ধজ্ঞানীগুণির অবদানকে ইতিহাস সামনে নিয়ে আসে। সোমপুর বিহার, জগদ্দল বিহার, আনন্দ বিহার, শালবন বিহারসহ অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাচীন বাংলায় বৌদ্ধদের জ্ঞানের প্রতি তাদের গুরুত্ব ও অবদানকে সত্যায়ন করে।

সুলতানী আমলে সোনারগায়ে শেখ শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামার প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশে প্রথম দরসে বুখারীর মাদরাসা যেমন ইতিহাসে অমর হয়ে আছে, ঠিক তেমনি বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ ও জালালুদ্দিন মুহাম্মাদশাহ জাতিকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার জন্য মক্কায় মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে বাংলা থেকে শিক্ষার্থীদের সেখানে পাঠিয়ে শিক্ষা দেওয়া এবং সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ তাদের সকলের পুরো খরচ এদেশ থেকে বহন করা হতো। মধ্যযুগের সুলতানি আমলের ইতিহাস জ্ঞানের প্রতি শাসকের দান আজ উপমা হয়ে আছে।

একদিকে মধ্যযুগের ইউরোপ যখন অন্ধকার বর্বর যুগ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলো ঠিক সে সময়ে মধ্যযুগের মুসলিমদের জ্ঞান ও দানের প্রতিযোগিতা তাদেরকে অর্ধপৃথিবীতে রাজত্ব ও শাসনভার পরিচালনায় নেতৃত্বের আসীনে নিয়ে আসে। সুযোগ করে দেয় জ্ঞান ও বিজ্ঞানে অবদান রাখার।

মধ্যযুগে মুসলিমরা জ্ঞান আন্দোলনে তিনটি পরিবর্তন ঘটিয়েছিলো।- প্রথমত, জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলো, সেখানে সবাই বিনামূল্যে পড়াশোনা করার সুযোগ পেত, বিভিন্ন পান্ডুলিপি থেকে প্রয়োজনীয় অনুলিপি করার সুযোগ পেত। রাষ্ট্রীয়ভাবে নানান দেশ থেকে বিদ্যার্থীদের এসব গ্রন্থাগারে আমন্ত্রণ পেত, তাদের থাকা খাওয়ায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকত। এর জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আলাদা বরাদ্দ দেওয়া হতো, যে কারণে এ সময়ে বিখ্যাত বাগদাদ গ্রন্থাগার, কর্ডোভা গ্রন্থাগার, সেভিল গ্রন্থাগার, কায়রো গ্রন্থাগার, কুদস বাব বাইতুল মুকাদ্দাস গ্রন্থাগার, দামেশক গ্রন্থাগার, ত্রিপোলি গ্রন্থাগার, সানআ গ্রন্থাগার, কায়রাওয়ান গ্রন্থাগারগুলো গড়ে ওঠেছিলো। আব্বাসিয় খলিফা মামুনের শাসন আমলে তিনি অনুবাদকারীকে অনুবাদকৃত বইয়ের ওজনের সমওজন স্বর্ন দিতেন। গ্রীক ও ল্যাতিন ভাষা থেকে সে কারণেই সে সময়ে আরবীতে অনুবাদ করার হিরিক পড়ে যায়। সে সময়ে মসজিদগুলোতেও জ্ঞানের আসর জমে উঠত। তাতে ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি চিকিৎসা বিজ্ঞান, জোর্তিবিজ্ঞান এ বিষয়গুলোও স্থান পেত। এমনকি মধ্যযুগে মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালগুলোতেও বড় বড় লাইব্রেরি ছিলো। তৃতীয়, জ্ঞানের জন্য ব্যয় করাকে সদকা ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় বলে বিবেচিত হতো। যে কারণে অনেকে শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রন্থাগার, মক্তব, মাদরাসা তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য বহু সম্পত্তি ওয়াকফ করতেন। যার প্রভাব বাংলাতেও পড়েছিলো। ব্রিটিশ শাসনামলেও এদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ভার বহন করা হতো হাজী মুহাম্মাদ মুহসীনের আল্লার নামে দান করা তাঁর সমস্ত সম্পত্তির টাকায়। দানের এমন প্রতিযোগিতা খানজাহান আলী থেকে শুরু করে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ সব ধর্মাবলম্বী অনুসারীদের মধ্যেই কম বেশি দেখা যায়। জ্ঞান ও দানের উদাসীনতা যখন থেকে আরববিশ্বসহ প্রাচ্যে দেখা গেল। তখন থেকেই পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠীর তালিকায় এদের নাম উঠে আসে।

জ্ঞান এক বিরামহীন কাজ। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি সম্পদ ব্যক্তির ‘সময়’ ও তাঁর ‘নিয়মিত শেখা’। কেননা একজন মানুষকে প্রতিমুহুর্তেই জানার জগৎ ও পরিধিকে বাড়াতে হয়, নয়তো তাঁর জ্ঞান কমে যায়। জানা থাকা কোনো বিষয়কে আবার নতুন করে আপডেট করতে হয়। কেননা প্রতিদিনই নতুন নতুন তথ্য ও চিন্তার উদ্ভব ঘটে, নতুন দর্শনের আবির্ভাব হয়, যুগের রূপান্তর-পরিবর্তনকে হাজির করে নিত্য নতুন বই। পুরোনো চিন্তার সীমাবদ্ধা জেনে নতুন চিন্তার সাথে নিজের সংযোগ সম্পর্ক না গড়লে অনেককিছুই নিজের বোঝাপড়ার বাইরে থেকে যায়। সমসাময়িক বিষয়ের নতুন নতুন শাখার ভালো ও খারাপ দিক এর সমস্যা, সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা জানতে জাতিগতভাবেই জ্ঞানের তৃষ্ণা থাকা খুব বেশি দরকার।

বর্তমান বাংলাদেশে জ্ঞান ও জ্ঞানীর অবমূল্যায়নের হার এতোটাই ভয়াবহ যে তরুন কিশোররা কেউ আর পড়তে চায় না। ‘পড়া’ আর ‘পড়ানোতে’ সম্মান নেই, যেন আছে লজ্জা। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠদানে জড়িত শিক্ষকরা তাদের শিক্ষাদানের পরিবেশ, যথাযথ পারিশ্রমিক ও প্রাপ্য সম্মানটুকু পান না। দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, তাঁদের যথাযথ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা পেলেও শিক্ষকদের জন্য তাঁর গবেষণা ল্যাব, গবেষণা ফান্ডিং, গবেষণা সহকারী, উচ্চতর গবেষণা করতে পারার সুযোগ ও গবেষণার পুরস্কার দেওয়া হয় না। একজন শিক্ষার্থী গবেষণায় আগ্রহ দেখালেও তাঁর ইচ্ছা বাস্তবায়নের পথ বেশ বন্ধুর। অর্থনৈতিক সহযোগিতা না থাকায় দেশসেরা অনেক মেধাবী অঙ্কুরেই ঝড়ে যায়। সক্রেটিস যেমন জ্ঞানী ছিলেন, তেমন জ্ঞানী ছাত্র রেখে গেছেন প্লেটোকে, প্লেটো আবার তৈরি করে গেছেন এরিস্টেটলকে। জ্ঞান গুরুমুখি বিদ্যা। তাই গুরু যদি পূর্ণরূপে, স্বাধীনচেতাভাবে নিজের মেধাকে বিকশিত না করতে পারে, ভয়ের রাজত্বে তাঁর উপলদ্ধি শিষ্যকে  জানাতে না পারে, কিংবা শিক্ষার্থীর জন্য উপযুক্ত গুরুকে যদি নির্বাচন করা না যায় তাহলে কখনোই সেখানে সেরা শিক্ষার্থী তৈরি হতে পারে না।

ঠিক বর্তমানে এ সংকটটি চলছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। এখানে গবেষণায় শিক্ষার্থীকে উৎসাহ দেওয়ার পরিবেশ নাই, সেরা শিক্ষক গবেষকের পুরস্কার নাই, গবেষণা ও নৈতিকতায় সেরা যারা তাদের ভিসি হওয়ার পরিবেশ নাই, জ্ঞান ও নৈতিকতায় সেরা শিক্ষার্থীর ছাত্ররাজনীতিতে হাল ধরার নেতা হওয়ার সুযোগ ও পরিবেশ নাই। বরং সারা বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বাজেট সে বাজেট পিকে হালদারের মতো একাই খেয়ে ফেলার পরিবেশ খুব ভালোভাবেই আছে। এমন লোভ ও ক্ষোভ জন্ম নেওয়ার পরিবেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আছে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একধরণের মাৎসন্যায় অবস্থা বিরাজমান। নৈতিক, মানবিক শিক্ষা, গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের গবেষণায় উৎসাহ দেওয়ার পরিবেশ, তাদের যথাযথ সম্মান ও সম্মানী দেশের স্বার্থেই রাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবস্থা করতে হবে। নয় তো শিক্ষক আর শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্থ হবে তা নয় বরং ক্ষতিগ্রস্থ হবে গোটা জাতি, ভবিষ্যত প্রজন্ম।

লেখক পরিচিতি- শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article