মুতাসিম বিল্লাহঃ
একটি জাতির গৌরব, অতীত ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে সাংস্কৃতিক সম্পদ। শেকড়ের টানে প্রজন্মকে আগ্রহী করে, একনজরে একটি দেশের পরিচয় তুলে ধরে, তাদের অবদান সম্পর্কে জানান দেয়। আবার গোটা বিশ্বেই সাংস্কৃতিক সম্পদ নিয়ে ব্যবসা হাল আমলে একটি ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক ব্যবসায় পরিনত হয়েছে। এক্ষেত্রে বৈধ উপায়ে ব্যবসার পাশাপাশি অবৈধ উপায়ে ব্যবসাও দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জাদুঘর, সরকারি ও বেসরকারী উদ্যেগে গড়ে ওঠা সংগ্রহশালায়, ধর্মীয় ভবনে, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে।
সুদূর কাল থেকে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে শিল্পবস্তু চুরির নিকটতম ঘটনা ঘটে একাদশ শতব্দীর প্রথম কোয়ার্টারে। এ সময় চোল রাজা রাজেন্দ্র চোলের সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশ থেকে দক্ষিন ভারতে নাটরাজা শিবের একটি ইউনিক ব্রোঞ্চ মূর্তি যুদ্ধ ট্রপি হিসেবে গুম করে নিয়ে যায়। তামিল নাডুর একটি মন্দিরে বর্তমানে এই অনুপম ব্রোঞ্চ মূর্তিটির উপাসনা করা হয়।
চাপাইনবাবগঞ্জের ছোট সোনা মসজিদের অলংকৃত মেহরাবটি সুলতান আলাউদ্দিনের সময়কালে নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সেটি ব্রিটিশরা স্বদেশে নিয়ে যায়। এই মসজিদ সংলগ্ন বাংলাদেশের ইসলামী শিল্পকলার চমৎকার ২৯টি খন্ড বর্তমানে লন্ডনস্থ এডিনবার্গের ’দ্যা রয়েল স্কুটিশ মিউজিয়াম’ এ আছে। এছাড়াও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আরও কিছু সজ্জিত পাথুরে কর্ম সংরক্ষিত আছে।
বাংলায় তাল পাতার উপর ক্ষুদ্র চিত্রলিপির অঙ্কনে পুঁথির পান্ডুলিপি তৈরি পালযুগে একটি ফ্যাশন হয়ে উঠে। এই তাল পাতার উপরে প্রাচীনকালে মহাযান বৌদ্ধধর্মের ধর্মগ্রন্থ লেখা হত। অস্টসহারিকা প্রজ্ঞাপারমিতাও তাল পাতায় লেখা ছিলো। বার শতকের অস্টসহারিকা প্রজ্ঞাপারমিতার ছয়টি চিত্রলিপিসহ একটি পান্ডুলিপি বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত অবস্থায় বিদ্যমান। কিন্তু লেনিনগ্রাদের হারমিটেজ জাদুঘর, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, ব্রিটিশ জাদুঘর, লজ এঞ্জেলস কন্টি মিউজিয়াম আর্ট, নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন জাদুঘর, বদলিয়ান জাদুঘর, বরদা স্টেট মিউজিয়াম প্রভৃতি জাদুঘর, পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সম্পদ বিশেষত প্রাচীন পান্ডুলিপি দ্বারা অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে।
সাংস্কৃতিক সম্পদ যে কোন সশস্র যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখিন হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক ব্যাবসায়ী বাংলাদেশে সক্রিয় ছিল। দেশে বিদ্যমান অরাজক পরিস্থিতিতে এ ব্যবসায়ীরা সৈনিকদের সহায়তায় এদেশ থেকে হাজার হাজার মন্দিরে থাকা মূর্তি চুরি করে নিয়ে যায় এবং তারা অসংখ্য মন্দির লুট করে।
এ সময়কালে ময়নামতি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর থেকে ২৪টি ব্রোঞ্জ মূর্তি চুরি হয়েছিল। এই মূর্তিগুলো এখনো সনাক্ত করা হয় যায় নি। পাশাপাশি দিনাজপুর জাদুঘরকেও একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সাংস্কৃতিক সম্পদ পাচার পুরোদমে অব্যহত থাকে। এ ক্ষেত্রে সবার নাম ছাপিয়ে আলোচনায় আসে জনৈক ডেভিড নালিন এর নাম। ড. পারভীন হাসানের লেখায় দেখা যায়, ড. ডেভিড নালিন বিখ্যাত ‘বিষ্ণু ফ্রম শিয়ালদি’ মূর্তিসহ প্রায় ২০০ টি পুরাকীর্তি পাচার করে।
‘বিষ্ণু ফ্রম শিয়ালদি’ কালো ব্যাসল্ট পাথরে তৈরি করা হয়েছিল, এটি একটি লাইফ সাইজ ইমেজ, ৫-৬ ফুট লম্বা, যেটি পাল-সেন শিল্পকলার একটি গুরুত্বপূর্ণ মূর্তি। এই মূর্তিটির কথা নলিনীকান্ত ভট্রশালীর ১৯২৯ সালে ঢাকা জাদুঘরে আইকোনোগ্রাফি অব বুড্ডিস্ট অ্যান্ড ব্রাহ্মনিক্যাল স্কাল্পচার ক্যাটালগে উল্লেখ আছে।
ডেভিড নালিন এর নেওয়া পূরাকীর্তির একটি অংশের বিবরণ পাওয়া যায় ১৯৮৫ সালে ‘মিডিয়াভেল স্কাল্পচারস ফ্রম ইস্টার্ন ইন্ডিয়া: সিলেকশন ফ্রম দ্যা নালিন কালেকশন এ প্রকাশিত বিবরণে।
এই আর্টিকেলে প্রকাশিত ৬১টি ভাষ্কর্য এবং রিচুয়াল অবজেক্টের মধ্যে ৪৫টি বাংলাদেশ থেকে নেওয়া আর বাকীগুলো সম্ভবত বিহার এবং উড়িষ্যা থেকে নেওয়া। বিখ্যাত ‘বিষ্ণু ফ্রম শিয়ালদি’ বিবরণ আছে ওই আর্টিকেলে। তবে পরবর্তীকালে ড. নালিন এই ভাষ্কর্যটি ক্যানভেরাতে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় জাদুঘরে বিক্রি করে দেন।
তার ক্যাটালগে থাকা একটি ‘গরুড় ভাষ্কর্য’ বর্তমানে আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে অবস্থিত ’রিচমন্ড মিউজিয়াম অব আর্ট’ জাদুঘরে রয়েছে। ড. নালিন নিউইয়র্কের ব্রুকলিন মিউজিয়ামে একটি বিষ্ণু মূর্তি দান করেছিলেন। ড. নলীন কতৃক অবৈধভাবে চুরিকৃত বাংলাদেশের এসকল মূল্যবান সংগ্রহ বর্তমানে আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত অবস্থায় বিদ্যমান।
বাংলাদেশ সরকার এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কতৃক অনুমতি ব্যতিত পাচার হওয়া সাংস্কৃতিক সম্পদ দেখা যায়, লসঅ্যাঞ্জেলস কান্টি মিউজিয়াম অব আর্ট, ফগ আর্ট মিউজিয়াম অব হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ক্লিভল্যান্ড মিউজিয়াম অব আর্ট, বস্টনের মিউজিয়াম অব ফাইন আর্ট, দেনভার আর্ট মিউজিয়াম, সানফ্রান্সিসকোর মিউজিয়াম অব এশিয়ান আর্ট, ব্রæকলিন মিউজিয়াম, উইলিয়াম রকহিল নেলসন গ্যালারি অব আর্ট, ওরচেস্টার অ্যান্ড রিচমন্ড মিউজিয়াম অব আর্ট, ব্রিটিশ মিউজিয়াম, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি, ক্যামব্রিজ বদলেইয়েন মিউজিয়াম, অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়াম, ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়াম, রয়াল স্কটিশ মিউজিয়াম, এডিনবার্গ মুসিও গুইমেট হারমিটেজ মিউজিয়াম, রয়াল অরিয়েন্টাল মিউজিয়াম, টরেন্টো মিউজিয়াম অব ইন্ডিয়ান আর্ট, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়াম, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, ভিক্টোরিয়া ম্যামোরিয়াল হল, গুরুসদয় মিউজিয়াম, বরোদা স্টেট মিউজিয়াম, ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের জাদুঘরে। এর বাইরেও অনেক অবজেক্ট চুরি হয়েছে যা আজও আমরা সনাক্ত করতে পারিনি।
বাংলাদেশ থেকে চুরি হওয়া সাংস্কৃতিক সম্পদের মধ্যে ময়নামতি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর থেকে ১৯৭১ সালে ২৪টি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য, শীলাইদহ জাদুঘর থেকে ১৯৭৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮টি চিত্রলিপি, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর থেকে ১২টি স্বর্ণালঙ্কার, ১৯৮২-১৯৯৩ সালের মধ্যে ময়নামতি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর থেকে ৯৩টি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য, বরিশাল শেরে বাংলা জাদুঘর থেকে ১৯৮৮ সালে একটি বুদ্ধ মূর্তি, জয়নুল আবেদিনের সংগ্রহশালা থেকে ২০টি চিত্রলিপি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ২৪টি মুদ্রা, ২টি মুদ্রা ১৪টি প্রাণীজ অবশেষ, ২টি পাথুরে ভাষ্কর্য, দিঘাপাতিয়া দিনাজপুরের গোল্ডহ্যান্ডলসহ অন্যান্য দেড়’শ প্রত্নবস্তু চুরি হয়েছে।
বাংলাদেশ নিউমিসমিটিক কালেকটরস সোসাইটি কতৃক ২০০৯ সালের ২৭অক্টোবর ঢাকায় একটি মুদ্রানিলামের আয়োজন করে। বাংলাদেশ নিউমিসমিটিক কালেকটরস সোসাইটি বানিজ্য মন্ত্রনালয় থেকে নিলাম ডাকার লাইসেন্স নেয়। এপর্যন্ত বিএনসিএস ৩৫বার নিলামের আয়োজন করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক বুলবুল আহমেদ ঐতিহাসিক মূল্যমানের বিভিন্ন মুদ্রা নিলামে বিক্রির সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেছেন।
ঢাকা শহরে অনেক এনটিক শপ আছে, এরাও বিভিন্ন ঐতিহাসিক মূল্যমানের সাংস্কৃতিক বস্তু ক্রয়-বিক্রয় করে। এজন্য এসব এনটিক শপ ও নিলামের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বিভিন্ন সচেতনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। পাশাপাশি তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের উচিত জাতীয় আইনে এসব অবৈধ কর্মের বিচার করা।
বাংলাদেশ ইউনেস্কোর রাস্ট্রপক্ষ হিসেবে বিভিন্ন সম্মেলনের অনুমোদন দিয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে, কনভেনশন ফর দ্যা প্রটেকশন অব কালচারাল প্রোপার্টি ইন দ্যা ইভেন্ট অব আর্মড কনফ্লিক্ট (১৯৫৪), কনভেনশন অন দ্যা মিনস অব প্রোহিবিটিং অ্যান্ড প্রিভেন্টিং দ্যা ইলিসিট ইমপোর্ট, এক্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রান্সফার অব ওউনারশিপ অব কালচারাল প্রোপার্টি (১৯৭০)
কিন্তু বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত একটি কনভেনশনের অনুমোদন দেননি, সেটি হলো ইউনিডরোয়েট কনভেনশন অন স্টোলেন অর ইলিগ্যালি এক্সপোর্টেড কালচারাল অবজেক্ট ১৯৯৫, বাংলাদেশের উচিত সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের উপরে অনুষ্ঠিত সকল প্রকার কনভেনশনকে অনুমোদন দেওয়া। এমনটি সুপারিশ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বুলবুল আহমেদ। তাঁর আরও পরামর্শ প্রতিটি জাদুঘরের উচিত সংগ্রহনীতি উন্নত করা, যেখানে ক্রয়-বিক্রয়ের সকল ডকুমেন্ট থাকবে।
আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব মিউজিয়ামের একটি নৈতিক কোড রয়েছে যেটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান থেকে আত্নসাৎকৃত অথবা বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধভাবে আগত প্রত্নবস্তু গ্রহনে অস্বীকৃতি জানায়। সাংস্কৃতিক সম্পদ ফেরত দানের ব্যাপারে ইউনেস্কো ১৯৭৮ সালে ইন্টারগভর্নমেন্টাল কমিটি ফর প্রোমোটিং দ্যা রিটার্ন অব কালচারাল প্রোপার্টি টু ইঁস কান্ট্রিস অব অরিজিন অর ইঁটস রেস্টিটিউশন ইন কেইস অব ইলিসিট অ্যাপ্রোপ্রাইয়েশন নামে একটি কমিটি প্রতিষ্ঠা করে।
এই কমিটির অধীনে কৃত চুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ অন্য দেশ থেকে তাদের সাংস্কৃতিক সম্পদ ফেরত নিয়েছে। বাংলাদেশ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এসব সাংস্কৃতিক সম্পদ ফেরত আনার জন্য ইউনেস্কো বরাবর ১৯৫ পৃষ্ঠার একটি ডকুমেন্ট সাবমিট করেছে। আমরা ইউনেস্কো কর্তৃক বিষয়টি সুবিবেচনার অপেক্ষায় আছি।
(লেখাটি অধ্যাপক বুলবুল আহমেদ এর গবেষণাপ্রবন্ধ অবলম্বনে লিখিত)
It’s a true issue. If we don’t get concerns about this occurrence
,even Today Tomorrow it will occur again.we should be careful about it.