নাঈমুর রহমান রিজভী
ব্যস্ত সড়ক, প্রখর রোদ, ঘামে ভেজা শার্ট, আর হাতে একটি নীল ছাতা নিয়ে সড়কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জননিরাপত্তায় কাজ করে যাচ্ছেন এক লোক। রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝা যা-ই থাকুক না কেন, প্রতিদিন একই নিয়মে রাস্তায় নামতে হয়। সাধারণ মানুষ যাতে নিরাপদে রাস্তা পারাপার হতে পারে সেটা নিশ্চিত করায় তার কাজ। ব্যস্ততম সড়কে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানা সময়ে বিড়ম্বনার মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে। দিনভর অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও জ্যামের জন্য শুনতে হয় কটু কথা। কিন্তু সবকিছু তুচ্ছ করে যান ও জনতার চলার গতি স্বাভাবিক রাখতেই তার জীবন সংগ্রাম। নাম তার ট্র্যাফিক পুলিশ।
সাধারণ পথচারী কিংবা গন্তব্যমুখী মানুষ যেখানে দিনে দু-একবার রাস্তা পারাপারে হিমশিম খান, সেখানে সকাল-সন্ধ্যা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঝ রাস্তায় দায়িত্ব পালন করতে হয় ট্র্যাফিক পুলিশদের। এতে নানা সময়ে ঘটে ছোট-বড় দুর্ঘটনাও। কখনো জীবনহানিও ঘটে। অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। কেউ কেউ আহত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে আবারও দাঁড়িয়ে যান সড়কে।
গণমাধ্যম ঘেটে জানা যায়, এ বছরের ১৫ জানুয়ারি যশোরের আরবপুর মোড়ে কর্তব্যরত অবস্থায় হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করে মনিরুজ্জামান নামে এক ট্র্যাফিক পুলিশ। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। একই ঘটনা ঘটেছে পহেলা ফেব্রুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁওয়ে। কর্তব্যরত অবস্থায় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শফিকুর রহমান মুকুল।
২০২২ সালের ১৪ জানুয়ারি উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকোয় দ্রুতগতির একটি ট্রাককে আসতে দেখে একে থামানোর নির্দেশ দেন ট্র্যাফিক কনস্টেবল মোহাম্মদ নাসির। কিন্তু তা না করে সরাসরি পুলিশের ওপর দিয়েই ট্রাক চালিয়ে দেন চালক। ঘটনাস্থলেই মারা যান নাসির।
২০২১ সালের পহেলা আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁওয়ে হাসপাতালের ভেতরে থাকা গাড়ি বের হওয়ার জন্য মিরপুর সড়কের গাড়িগুলোকে থামার সংকেত দিয়েছেন ট্র্যাফিক পুলিশ সদস্য হেলাল। এরই মধ্যে নবীনগর থেকে আসা একটি মাইক্রোবাস সংকেত অমান্য করে চলে যাওয়ার সময় কনস্টেবল হেলালকে ধাক্কা দেয়। এতে হেলাল পড়ে গেলে চালক তার উপর দিয়ে মাইক্রোবাস চালিয়ে চলে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।
প্রতিনিয়ত ট্র্যাফিক পুলিশদের এমন দুর্ভোগের কথা জানতে কথা হয় কুমিল্লার টমছম ব্রিজ পুলিশ বক্সের দুইজন দায়িত্বরত ট্র্যাফিক পুলিশের সাথে।

এএসআই আবদুল লতিফ ১৮ বছর ধরে আছেন এই পেশায়। তার বাড়ি উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড় জেলায়। থাকেন পুলিন লাইন কোয়ার্টারে। চাকুরি জীবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, রোদের মধ্যে অনেক কষ্ট হয়। সবসময় শব্দের ভিতরেই থাকি। বিশেষ করে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করলে বেশি শব্দ দূষণ হয়। আমাদের বেশিরভাগ সদস্যেরই কানে সমস্যা হয়। যার প্রভাব বয়স হয়ে গেলে বেশি পড়ে। ধুলোবালি চোখে গেলে চোখের সমস্যা হয়, পাওয়ার কমে যায়। কিছুক্ষণ এই মোড়ে কিছুক্ষণ ওই মোড়ে। রোদে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কারণে ঘাম হয়। আর এই ঘাম থেকে হয় চর্মরোগ। যার ফলে হাত পা চুলকায়। টমছম ব্রিজ কুমিল্লা শহরের টার্নিং পয়েন্ট। এখানে ৪ জন ট্র্যাফিক পুলিশ পর্যাপ্ত নয়। জনগণের নিরাপত্তার জন্য আমরা এতকিছুর পরেও নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যায়। তাও জনগণের কটুকথা শুনতে হয়।
আরেক দায়িত্বরত ট্র্যাফিক কনস্টেবল ফজলুল হক। ২৩ বছর ধরে করে এই পেশায় যুক্ত আছেন তিনি। তার আবাসস্থল ফেনীতে। তিনি বলেন, জীবিকার তাগিদে রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমরা যানজট নিরসনে কাজ করি। আমাদের মূল লক্ষ্যই হলো মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে যানজট নিরসন। অনেক সময় ধুলোবালির কারণে শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা হয়। শব্দ দূষণের কারণে আমাদের অনেকে বৃদ্ধ বয়সে কানে কম শুনে। ধুলোবালিতে দায়িত্ব পালন করার কারণে চোখে বেশি সমস্যা হয়। চশমা দিলে স্পষ্ট দেখা যায় না তাই আমরা এটাও ব্যবহার করতে পারি না। টমছম ব্রিজ যানবাহনের অনেক চাপ থাকে তাই অনেক সময় হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। জনগণকে নিরাপদে রাখতে গিয়ে পরিবারের সাথে দুই তিন বছরেও ইদ করার সুযোগ পাই না। শরীরে ঘাম ও গরমের কারণে অনেক ঘাটতি দেখা দেয়। শরীর ফুলে যায়। অনেক সময় সাধারণ মানুষের গালি শুনা লাগে। তারপরও আমরা জীবিকার তাগিদে সব সহ্য করে যায়। যথাসময়ে যাতে পরিবহনগুলো যথাস্থানে পৌঁছাতে পারে সেইজন্য আমরা নিজেদেরকে বিলিয়ে দেয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়