27.8 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

ঘুড়ি: দুরন্ত শৈশবের রঙিন স্মৃতি

Must read

বিডিফিচার ডেস্ক:

একটা বিশাল আকাশ, সাদা রঙের মেঘেদের খেলা। কিছুক্ষণ পরেই আবার হয়ত মেঘমুক্ত নীল আকাশ, নয়তো আবার কখনোও কালো মেঘে ঢাকা। ঋতুচক্রে সময় এখন বর্ষা। তবে আঁচ রয়েছে কিছুটা শরতের। সাদা মেঘেদের ভিড়ে কালোদের ছায়া। বাতাসও বইছে মন মাতানো। এই বুঝি একটু পর নামবে বৃষ্টি। আচমকা ঘাড় বাকাচ্ছে প্রকৃতি।

তবে সবকিছু কে ছাপিয়ে এখন মনের আবেগ জুড়ে শুধু শৈশবের স্মৃতি। মৃদু মন্দ বাতাসে যেন রঙিন প্রজাপতির মেলা। কাল্পনিক চিন্তা হলেও আকাশে ঘুরে বেড়ানো রঙিন ‘ঘুড্ডি’ গুলোকে দেখলে প্রজাপতিই মনে হবে সবার। আর এসবের ভিড়ে মনে পড়ে শুধু শৈশবের কথা। গ্রামের কোমল স্নিগ্ধতায় যারা বড় হয়েছেন, দুরন্তপনা যাদের জীবন তারা জানেন ঘুড়ির স্মৃতি কতটা মধুর।

নাটাই হাতে নেওয়ার শখ সব বয়সের মানুষের থাকলেও ঘুড়ি বানানোর জ্ঞান না থাকায় সেই শখ পূরণ করা সবার সাধ্যে কূলায় না। আবার অতি আদরের সন্তানরাও বাবা মায়ের অতি যত্নবান হওয়ার কারণে সন্তানকে ঘুড়ি উড়াতে দেয়। আর শহরে ঘুড়ি উড়ানো তো এক আকাশ কুসুম কল্পনা। টাকায় কিনা রঙিন কাগজের ঘুড়ি কেউ কেউ উড়ালে ঐ দূর প্রান্তে সুতো ছেড়ে নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজটি সবাই করতে পারে না। কারণ শূন্য থেকে শূন্যের পথযাত্রায় বহু চড়াই-উতড়াইয়ের মধ্য দিয়েই ঘুড়িকে পাড়ি দেওয়াতে হয় বিশাল পথ। এজন্য প্রয়োজন হয় দক্ষ হাতের কারসাজি!

আর সেইসব চড়াই-উতড়াই পাড়ি দিয়ে ঘুড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করাটা বেশিরভাগ হয়ে থাকে শিশু, নয়তো কিশোর। নীলিমা জুড়ে ঘুড়ি বিরাজ করলেও তাদের ব্যস্ত থাকতে হয় ঘুড়িগুলোকে চরকি খাওয়াতে, কাটাকাটি করতে, কখনো ঘুড়ির সাথে ঘুড়ির যুদ্ধ লাগিয়ে অপর ঘুড়িকে ছিনিয়ে নিতে। এইসব কিছুই একেকটা শিল্প। কারণ সবাই ঘুড়িকে বাগে আনতে পারে না। আর দমকা বাতাসে ঘুড়ি উড়ানো তো রীতিমতো যুদ্ধ নেমে যাওয়া।

শহর কিংবা গ্রামে যারা শৌখিন মানুষ, তারা তাদের সন্তানদের ঘুড়ি বানিয়ে দেয় রঙিন লিটমাস কাগজ দিয়ে। আঞ্চলিক ভাষায় একে অনেকে ‘তাওয়া’ ঘুড়ি বলে ডাকে। দেখতে বেশ সুন্দর ও মনোরঞ্জন করে এই ঘুড়ি। আরেক ধরনের ঘুড়ি ছিল পলিথিন কাগজে দিয়ে বানানো। গ্রামের শিশুদের বানানো ঘুড়ির বেশিরভাগই ছিল পলিথিনের তৈরি। বাজার করতে গেলে ফ্রিতে পাওয়া যায়। সুতা ক্রয় করা ছাড়া কোনো ব্যয় নেই।

ঘুড়ি তৈরি করা সবার আয়ত্তে নেই। ঘুড়িতে কাঠামো দিতে ব্যবহার করা হয় বাঁশের কাঞ্চি কিংবা নারকেল পাতার শলা। সেই কাঞ্চি বা শলাকে পালিশ করতে হয় খুবই সূক্ষ্মভাবে। ভারের তারতম্য হলেই আকাশে উড়বে না ঘুড়ি। আবার উড়লেও নিয়ন্ত্রণে থাকবে না সেই ঘুড়ি। চরকি খেতে খেতে গাছের ডাল কিংবা পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা বেশি।

গ্রামাঞ্চলে মূলত নাটাই তেরি করা হয় বাশের নিচের অংশ দিয়ে। এক গিঁট থেকে অন্য গিটের অংশ পর্যন্ত প্রথম কেটে রাখা হয়। পরে সেই অংশে পালিশ করে নীচ রড় বা বাশের কাঞ্চি ঢুকিয়ে এটি তৈরি করা হয়। তবে শহরের ছেলেদের হাতে অত্যন্ত সুন্দর করে কাঠ, বাঁশ, রড দিয়ে তৈরি নান্দনিকভাবে নাটাই ফুটিয়ে তোলা হয়। তবে সেই নাটাই সবাই নিজের আয়ত্তে রাখতে পারে না। সুতা ছেড়ে দেওয়া কিংবা সুতা টেনে কাছে আনার কাজটি অনেকের কাছেই দুঃসাধ্য ব্যাপারও বটে।

যাইহোহ, ঘুড়ি উড়োনোর শিশু-কিশোরদের কাছে নেশার মতো। যারা শৈশবে ঘুড়ি উড়িয়েছে তাদের কাছে ভালোবাসার আরেক নাম ঘুড়ি। সেই সাঁজ সকালে কিছু একটা মুখে দিয়ে ঘুড়ি নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার দিনগুলোতে আহারের কথা মনেই পড়ে না। দুপুরে মায়ের গালমন্দে গাছের সাথে ঘুড়ি বেঁধে রেখে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে ভোঁ দৌড়। রোদে পোড়ানো মলিন চেহারায় বাবার অনাদর শাসন এখন শুধুই স্মৃতি।

যতই দিন যাচ্ছে গ্রামগুলো শহর হয়ে উঠছে। চারদিকে মানুষের ব্যস্ততা বাড়ছে। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার নামে শিশুকে বইয়ের বোঝা ঝুলিয়ে দিয়ে কিশোরকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে কোচিং প্রাইভেটে। প্রতিযোগিতার বাজারে সবাই ব্যস্ত সবার আগে লক্ষ্যে পৌঁছাতে। মুক্ত জীবনের কি যে প্রশান্তি সেটা কখনো তাদের কল্পনাতেও আনা যায় না। সকাল হলেই স্কুল আর বিকেল হলে হলে টিউশন, রাত হলে হোমওয়ার্ক যেন একঘেয়ে করে তুলছে তাদের।

তবুও কিছু মানুষ ঘুড়ি উড়ায়। সেটাও আবার শৌখিন মানুষদের হাতে। তবে ঘুড়িকে দোল খাওয়ানো, বানানো, কাটাকাটি এসবের কোনোটিই বর্তমানের শিশু-কিশোররা করছে না। মোবাইল ফোনের আদলে বিনোদনের অসুস্থ পন্থা অবলম্বনেই ব্যস্ত সবাই। শিশুর কি প্রয়োজন সেদিকে নজর নেই বাবা মায়েরও।

এ দেশে বহুপূর্ব থেকেই ঘুড়ির প্রচলন ছিল। তবে সেটা সীমাবদ্ধ ছিল একটি বছরের বিশেষ সময়কেন্দ্রিক। এখনকার দিনেও যখন আকাশে ঘুড়ি উড়ে ফিরে পাচ্ছে শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত নাটাই, ঘুড়ি উড়ানোর পুরানো বন্ধু। কাঠপোড়া রোদে টালমাটাল ঘুড়ি সামাল দেওয়ার চিন্তাতেই ব্যস্ত সকলে। কখনো কখনো বাড়ির ছাদে ঘুড়ি উড়ালে বৃদ্ধ, পৌঢ়, থেকে শুরু করে সবাই এটি উপভোগ করে। কখনো কখনো বাড়ির মেয়েরাও বাদ যায় না।

ঘুড়ির প্রতি মানুষের নেশা কমলেও বেড়েছে ঘুড়ি তৈরির শিল্প। বিভিন্ন বাহারের ঘুড়ি আকাশে আজকাল চোখে পড়েছে। বেড়েছে বানিজ্যিক ব্যবহারও।  এমনকি রাতের আকাশে চাঁদ-তারা যখন ঝলমলিয়ে আলো বিকিরণ করে, তখন ঘুড়িতে লাইট লাগিয়ে আকাশে ছেড়ে দেওয়াও আজকাল চোখে পড়ার মত। পথে-ঘাটে-মাঠে-প্রান্তরে হয়ত ব্যস্ত শিশু-কিশোর তাদের নাটাই হাতে। তাতে সায় দিচ্ছে চারপাশের পরিবেশও। এইতো যেন জীবনের যত সুখ-প্রশান্তি আয়োজন……!

ঘুড়ির ইতিহাস

আজকের পৃথিবীতে প্রায় সব দেশেই ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন রয়েছে। তবে দেশে দেশে ঘুড়ির মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য দেখা যায়। কারণ নানা দেশের মানুষ ঘুড়ির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছে নিজেদের সংস্কৃতি, মিথ এমনকি ধর্মও। চীন, জাপান ও তাইওয়ানে ঘুড়ি উড়ানো জাতীয় উৎসব। বাংলাদেশে সাকরাইন উৎসব তার মধ্যে একটি। যেখানে ঘুড়ি কাটাকাটি করা একটি শিল্প।

ঘুড়িকে পবিত্রতার প্রতীক মনে করে মালয়েশিয়ার মানুষ। তারা ঘুড়িকে মনে করে ভূতপ্রেতের ওঝা। তাদের বিশ্বাস যে বাড়িতে ঘুড়ি ওড়ানো হয় সে-বাড়ির ধারেকাছে নাকি ভূত বা দুষ্ট জ্বিন আসে না।

নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীরা দুষ্ট আত্মা তাড়াতে মাওরি নামের এক ধরনের ঘুড়ি ওড়ায়। এই ঘুড়ির মধ্যে থাকে অনেক ছিদ্র। ওই ছিদ্রে বসানো থাকে ধাতব পাত।

চীনের ঘুড়ি

এছাড়া চীন, জাপানে ঘুড়ি এত জনপ্রিয় যে একসময় এর পেছনে দিনের অধিকাংশ সময় নষ্ট করার জন্য ঘুড়ি ওড়ানো সরকারিভাবে নিষিদ্ধই করে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

ধারণা করা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার আকাশেই সর্বপ্রথম উড়েছিল ঘুড়ি। সাম্প্রতিক সময়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ভারতে সুঁতোর আগায় গাছের পাতা বেঁধে তা ঘুড়ির মতো করে উড়ানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপেতো এখনো ঐহিত্য অনুসারে পাতার ঘুড়ি ওড়ানো হয়। বলা হয়ে থাকে যে, এক সময় পলিনেশীয় নাবিকদের দ্বারা এই ঘুড়ি এশিয়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য মহাদেশেও। অবশ্য এর আগেও ঘুড়ি আবিষ্কারের দাবি উঠেছিল।

সেই ৪শ’ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসে প্রথম ঘুড়ি ওড়ানোর দাবি করেন বিজ্ঞানী আরকিয়াতাস। আবার গ্রিসেরও অনেক আগে থেকে সেই ৩ হাজার বছর আগে চীনারা প্রথম ঘুড়ি উড়িয়েছে বলে দাবি করে। তবে যেই এর আবিষ্কারক হোক না কেন নাটাই হাতে পেলে এটি ওড়ানোর মজা এখন বিশ্বজনীন। আর তাদের বানানো ঘুড়ি শিল্পই বলে দেয় বানাতে তারা কতটা পটু। তারা মূলত যুদ্ধ, প্রতিরক্ষা ও কূটকৌশলের কাজে ঘুড়িকে ব্যবহার করত।

ঘুড়ি কাটাকাটি

ঘুড়ি উড়ানোর আসল মজা হলো কাটাকাটির খেলা। অন্যের ঘুড়িকে কেটে দেওয়ার আনন্দ উত্তেজনা কেবল ঘুড়িয়ালরাই টের পান। এর জন্য ঘুড়ির সুতায়ও জোর থাকা চাই। ঘুড়ির সুতা ধারালো করতে আমাদের দেশে মাঞ্জা দেওয়া হয়।

বাহারি রঙের ঘুড়ি

সাধারণত ভাতের মাড়, সাগু গোলা, কাচের গুঁড়ার মিশ্রণের মধ্যে সুতাকে ডুবিয়ে রোদে শুকিয়ে ধারালো করা হয়। তারপর সেই মাঞ্জা দেওয়া ধারালো সুতা নিয়ে ঘুড়িয়ালরা নেমে পড়ে তাদের আকাশ যুদ্ধ কাটাকাটির মিশনে। একটি ঘুড়ি কাটা পড়লে তার পেছনে ছুটতে শুরু করে ছোট্ট ছেলেরা। মাঠ ঘাট পেরিয়ে ওই কাটা ঘুড়ি হাতে পাওয়ার পরই যেন তাদের সান্ত্বনা।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article