ফিচার ডেস্ক:

 

সময়টা ২০০৩। সেবার দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে এবং কেনিয়ায় যৌথ আয়োজনে ওয়ানডে ক্রিকেটের ৮ম তম আসর জমেছিল। চমক জাগানিয়া সেই বিশ্বকাপে চমক লাগিয়েছিল আইসিসি’র সহযোগী সদস্য দেশ কেনিয়া। ক্রিকেট পরাশক্তির দেশ না হয়েও সেইবার বিশ্ব ক্রিকেটের মাথাব্যাথার কারণ হয়েছিল আফ্রিকার এই দেশটি। তবে সেই বিশ্বকাপের পর থেকেই অধঃপতন শুরু হয় তাঁদের। সাবেক ক্রিকেটার স্টিভ টিকোলো মনে করেন, সেই সাফল্যই কাল হয়েছিল কেনিয়ান ক্রিকেটের জন্য।

এরই মধ্যে ২০১৪ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক মর্যাদা হারিয়েছে কেনিয়া। পাঁচবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করা আফ্রিকার এই পরাশক্তির বাছাই পর্বে অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা হারিয়ে ২০১৮ সালে নিজেদের ক্রিকেট বোর্ডের কমিটিকেও বিলুপ্ত ঘোষণা করে দেশটির ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।

২০০৩ সালের সেই ওয়ানডে বিশ্বকাপে চমক লাগিয়ে প্রথম ও শেষবারের মতো আইসিসি’র কোনো সহযোগী দেশ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠেছিল। যাদের কাছে পরাস্ত হয়েছিল শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ে, কানাডা ও বাংলাদেশ।

তবে সেই রঙিন স্মৃতি মলিন একযুগ সময়ও লাগেনি। ১৯৯৭ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটির স্ট্যাটাস পাওয়া দলটিকে একসময় বাংলাদেশের শক্ত প্রতিপক্ষ ভাবা ক্রিকেট দল কেনিয়াকে। কারণ ১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশ প্রথম আইসিসি ট্রফি জিতে, তখন স্টিভ টিকোলোর অনবদ্য ১৪৭ রানের কল্যাণে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ৭ উইকেট হারিয়ে ২৪১ রান করে কেনিয়া। বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের টার্গেট হয় ২৫ ওভারে ১৬৬ রান। শেষ ১ বলে দরকার পড়ে বাংলাদেশের ১ রান। ক্রিজে ছিলেন পেসার হাসিবুল হোসেন শান্ত। এছাড়াও ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ৭টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে কেনিয়া ও বাংলাদেশ। সেখানে কেনিয়া জয় পায় ৬টি ম্যাচে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে নিয়মিত দেশ কেনিয়াকে ছাড়িয়ে ওপরে উঠে এসেছে নামিবিয়া, স্কটল্যান্ড, পাপুয়া নিউ গিনি, হল্যান্ড ও নেপালের মতো দল। একসময় কেনিয়ার চেয়ে ক্রিকেটীয় সামর্থ্যে অনেক পিছিয়ে থাকা আফগানিস্তান ও আয়ারল্যান্ড এখন টেস্ট খেলুড়ে দেশ।

যে দেশটি টেস্ট মর্যাদা চাচ্ছিল, তারাই কীভাবে খেলাটাই ভুলে গেল, এর উত্তর নাইরোবির নেশন পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে স্টিভ টিকোলো বলেছেন, ‘কেনিয়ান ক্রিকেট প্রশাসকরা গোটা নব্বইয়ের দশক জাতীয় ক্রিকেট দলকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। পৃষ্ঠপোষক, আইসিসি থেকে পাওয়া অর্থ যে ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নয়নে ব্যয় করতে হয়, সেই ব্যাপারটিই ভুলে গিয়েছিলেন তারা। সে কারণেই নতুন প্রতিভা তৈরি হয়নি দেশটিতে।’

২০০৩ সালের কেনিয়া ক্রিকেট দল

কেনিয়ায় ক্রিকেট খেলার শুরু হয় ১৮৮০ এর দশকে ব্রিটিশ উপনিবেশিকদের হাত ধরে। জানা যায়, ১৮৯৯ সালে মোম্বাসায় এই সেটেলাররা প্রথম একটা ম্যাচ খেলেছিল। এরপর ১৯১০ সালে ‘অফিশিয়াল বনাম সেটেলার’ একটা তিন দিনের ম্যাচ শুরু হয়। ১৯৫১ সালে কেনিয়ার একটি জাতীয় দল গঠিত হয় এবং তারা তানগানিকার (পরে তানজানিয়ায় একীভূত দেশ) বিপক্ষে একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে। ১৯৫৩ সালে কেনিয়ান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়। এটা ছিল কেনিয়ার প্রথম সব বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত কোনো সংগঠন।

এ সময়ে কেনিয়াতে দক্ষিণ আফ্রিকা, এমসিসিসহ বিভিন্ন দল সফর করে। এককভাবে কেনিয়াই হয়ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করতে পারতো। কিন্তু তারা ১৯৬৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো একটি দল গঠন করে। ইস্ট আফ্রিকা নামে এই দলে আরো ছিল তানজানিয়া ও উগান্ডা। এই দলটি আইসিসির সদস্যপদও লাভ করে। মূলত কেনিয়ার ক্রিকেটাররাই ছিল এই দলের সিংহভাগ সদস্য।

এই ইস্ট আফ্রিকা দল ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপে অংশ নেয়। এখানে ১৪ জন খেলোয়াড়ের ৭ জনই ছিল কেনিয়ার ক্রিকেটার। এরপর ইস্ট আফ্রিকা ১৯৭৯ সালের আইসিসি ট্রফিতে অংশ নেয়। কিন্তু ফলাফল ভালো করতে পারেনি। যার ফলে ১৯৭৯ বিশ্বকাপে খেলা হয়নি তাদের।

১৯৮১ সালে ইস্ট আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসে কেনিয়া। সে বছরই আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ লাভ করে তারা।

১৯৮২, ১৯৮৬ ও ১৯৯০ সালের আইসিসি ট্রফিতে কেনিয়া নিজের নামেই অংশ নেয়। তবে কোনোবারই বিশ্বকাপে পৌঁছতে পারেনি। অবশেষে ১৯৯৪ সালে সেই বাঁধা টপকে গেল কেনিয়া। বাংলাদেশের জন্য মহা শোকের সেই আইসিসি ট্রফির আসর বসেছিল কেনিয়ার নাইরোবিতেই। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ফাইনালে হেরে গেলেও টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরা দল হিসেবে অংশ নেয় ১৯৯৬ বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপের আগে দারুণ প্রস্তুতি নিয়েছিল কেনিয়া। এখানে এসে প্রথম অভিযানেই চমক দেখায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৭৩ রানে হারিয়ে। এর মাঝে ১৯৯৮ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে ভারতকে ৬৯ রানে হারিয়ে শোরগোল ফেলে দেয় আবার।

এরপর ২০০১ সালে কেনিয়া আবার একটি ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে ভারতকে হারায়। তখন কেনিয়া ধীরে ধীরে আধুনিক ক্রিকেটে এক উঠতি পরাশক্তি বলে বিবেচিত হচ্ছিল। আর এর চূড়ান্ত প্রমাণ মেলে ২০০৩ বিশ্বকাপে এসে। এই বিশ্বকাপে কেনিয়া খেলে ফেলে সেমিফাইনাল! আর সেই সাফল্যই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সে সময় কেনিয়ার বিপক্ষে কয়েকটি ব্যাপার কাজ করেছিল। কেনিয়ার কয়েকজন সিনিয়র খেলোয়াড় অবসরে চলে গেলেন। সেই সাথে অন্যতম সেরা পারফরমার মরিস ওদুম্বে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অপরাধে নিষিদ্ধ হলেন। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, টাকা পয়সার টানাপোড়েনে থাকা কেনিয়ার ক্রিকেটাররা একের পর এক ধর্মঘট শুরু করলেন। যার ফলে কেনিয়ার পারফরম্যান্সে অধোগতি পরিষ্কার টের পাওয়া গেল। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল অবধি তারা আর কোনো ম্যাচই জিততে পারেনি। এখানে আইসিসিরও কিছু নীতিগত সমস্যা ছিল। ওয়ানডে স্ট্যাটাস থেকে আর উত্তরণ না ঘটায় আইসিসির থেকে তারা বাজেটও কম পাচ্ছিল। আইসিসির নতুন নীতির ফলে সহযোগী দেশগুলোর জন্য বরাদ্দও কমে যায়। তার প্রভাবও পড়ে দেশটির ক্রিকেটে। সর্বশেষ তারা ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলে ২০১১ সালে।

ক্রিকেট বোর্ডে দুর্নীতি ও অন্তর্কোন্দলের কারণে কেনিয়ার ক্রিকেট সাফল্য এখন ইতিহাসের অংশ, তবে আশার কথা, ধীরে ধীরে দেশটিতে ফিরছে ক্রিকেট সংস্কৃতি। হারানো জনপ্রিয়তা ফিরে পাচ্ছে খেলাটি।

এর নেপথ্যে রয়েছেন কেনিয়া ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের অন্যতম কাণ্ডারি তিন ভাই। কেনেডি ওটিয়েনো ওবুইয়া, ডেভিড ওবুইয়া ও কলিনস ওবুইয়া মিলে শুরু করেছেন ওবুইয়া ক্রিকেট একাডেমি (ওসিএ), যা আবারও পথ দেখাচ্ছে নাইরোবির তরুণদের।

২০০৬ সালে নাইরোবির অভিজাত এলাকা ল্যাভিংটনে শুরু হওয়া একাডেমিটির সদস্য সংখ্যা শতাধিক। তাদের অধিকাংশের বয়স পাঁচ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো নাইরোবির এনপিসিএ সুপার লিগে নিজস্ব দল খেলায় ওসিএ।

ওবুইয়া বলেন, ‘পরবর্তী প্রজন্মের ক্রিকেট খেলোয়াড়দের আমরা অনুপ্রাণিত করতে পারছি, এ বিষয়টা আমাদের কাছে অত্যন্ত আনন্দের।’

এখন তিন ভাইয়ের লক্ষ্য তাদের অ্যাকাডেমির কার্যক্রম রাজধানী নাইরোবির বাইরে ছড়িয়ে দেয়া। যদি ক্রিকেট আবার ফিরে আসতে পারে সেটা হবে তাদের জন্য ফিনিক্স পাখির আরেকটি নতুন গল্প…….

 

VIAজুবায়ের রহমান
Previous articleটিকটক: নৈতিক অবক্ষয়ের আদ্যোপান্ত
Next articleঘুড়ি: দুরন্ত শৈশবের রঙিন স্মৃতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here