রকিবুল হাসান

বর্তমানে বিশ্বে প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে বিনোদন ব্যবস্থায়ও এসেছে পরিবর্তন। বিনোদনের খোরাক মিটাতে আমরা প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছি। অতিরিক্ত প্রযুক্তি নির্ভর হতে গিয়ে আমরা বাস্তবতাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি। যার কারণে সমাজে দেখা দিচ্ছে নৈতিক অবক্ষয়। বাড়ছে অপরাধ করার প্রবণতা। মানুষ পড়ছে ব্যক্তিত্ব সংকটে। টিকটক হচ্ছে সেইরকম একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। যার অপব্যবহারের কারণে একদিকে যেমন সামাজিক মূল্যবোধের অবনতি হচ্ছে, অন্যদিকে আঘাত হানছে ব্যবহারকারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। এছাড়াও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও এটির রয়েছে নেতিবাচক প্রভাব।

টিকটকের যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। ২০১৮ সালের প্রথম তিনমাসে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড করা অ্যাপ্লিকেশন ছিল এটি। বাংলা, আরবি, ইংরেজি, হিন্দিসহ প্রায় ৪০টি ভাষার ব্যবহার রয়েছে টিকটকে। ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ডের ভিডিও কনটেন্টের বিনোদনের অন্যতম একটি ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি। ইকোনমিক টাইমস এর প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিমাসে গড়ে প্রায় দুই কোটি মানুষ টিকটক ব্যবহার করছেন। বিশ্বজুড়ে এই অ্যাপটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫০ কোটি।

টিকটক তরুণ প্রজন্মকে বাস্তবতা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। তৈরি করছে উগ্রতা, অশালীনতা, অশ্লীলতা, কল্পনাপ্রবণতার মতো বিভিন্ন জটিল মানসিক রোগ। অতিরিক্ত টিকটকের ব্যবহারের ফলে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, বাস্তবতার প্রতি বিমুখতা, মনস্তাত্ত্বিক অবক্ষয় ও চারিত্রিক অবনতির মতো ভয়ানক জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছে।

টিকটকম কে কেন্দ্র করে চলছে নানা অপরাধমূলক কার্যকলাপ। চলছে মাদকের বিস্তার, নারী পাচার, ধর্ষণের মতো ঘটনা। গুটিকয়েক ব্যক্তি টিকটক করে পরিচিতি পেয়ে নাটকে অভিনয় এবং বিগবসের মতো প্ল্যাটফর্মে জায়গা করে নেওয়ায় অনেকে এটির প্রভাব ও বাস্তবতাকে উপলদ্ধি না করেই টিকটকে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।

এক প্রতিবেদনে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ টিকটক কে মানসিক রোগ আখ্যা দিয়ে বলেন, টিকটক একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলেও দিন দিন এর অপব্যবহার বেড়েই চলছে। টিকটকে আসক্তি একটা মানসিক রোগ। আর মানসিক রোগ মানেই নানা ধরনের সংকট বেড়ে যাওয়া। যার প্রমাণ আমরা পত্রিকা বা মিডিয়ায় দেখতে পাচ্ছি। টিকটকারদের কারণে সমাজে নানা ধরনের অপরাধ অনেক বেড়ে গেছে। তারা নিজেরাও মানসিক সংকটে ভুগছে তেমনি সমাজেও নানা অশান্তি, ঝামেলা আর বিবাদ তৈরি করছে।

তিনি আরও বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই বলছে এসব আসক্তি একটা মানসিক রোগ। সেটা মাদকে আসক্তি হোক আর টিকটকে আসক্তিই হোক। এটাকে বলা হয় আচরণগত আসক্তি। তাই তাদের সুস্থ করতে হলে উপযুক্ত চিকিৎসা করাতে হবে। মনো চিকিৎসা ও কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তাদের সুস্থ করা সম্ভব। একইসাথে তাদের বাবা-মায়েদেরও আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। সবাই মিলে এক সাথে চেষ্টা করলে এদের সবাইকে সুস্থ করা সম্ভব।

বাংলাদেশে ‘টিকটক’ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি নানা ধরনের অপরাধের অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, টিকটক ব্যবহার করে অপরাধের দায়ে মামলা হয়েছে ১৩টি। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে দুটি এবং সিলেট মহানগর পুলিশের আওতাধীন শাহপরান থানা, সুনামগঞ্জ ও বরগুনায় একটি করে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আটজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। আসামি ১০৫ জন।

প্রথম মামলাটি হয়েছিল আলোচিত টিকটকার ইয়াসিন আরাফাত অপুর বিরুদ্ধে। তাঁর বিরুদ্ধে মারধর ও বেআইনি সমাবেশের অভিযোগ উঠেছিল। বেশ কিছুদিন জেল খেটে বের হওয়ার পর তিনি এখন আবারও টিকটকে সক্রিয় হয়েছেন তিনি। এরপর `টিকটকার’ দের বিরুদ্ধে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে চারটি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পাঁচটি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিনটি মামলা হয়েছে।

ভারতের বেঙ্গালুরুতে নারী পাচারের ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় চারটি মামলা হয়। বেঙ্গালুরুতে পাচার হয়ে দেশে ফিরে আসা এক কিশোরী প্রথম আলোকে বলেন, অভিযুক্ত হৃদয় টিকটক করতেন। তাকে টিকটক মঞ্চে জনপ্রিয় হতে সাহায্য করবেন। সে কারণে বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায় গিয়ে ভিডিও ধারণ করতে হবে। টিকটক হৃদয় পরে তাকে কুষ্টিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ভারতে পাচার করে দেন। এর আগে গত বছর ভাটারা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয় দেওয়ান রসুল হৃদয়সহ দুজনের বিরুদ্ধে। তিনিও টিকটকে এক কিশোরীকে নায়িকা বানিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি করেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।

টিকটকের অত্যধিক ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য অন্যতম কারণ হলো ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা। বাংলাদেশ টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি) তাদের ওয়েবসাইটে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের তথ্য প্রকাশ করেছে। সর্বশেষ জুন ২০২২ এ তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৬২ লাখ ১০ হাজার। তাদের মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ১১ কোটি ৫০ লাখ ৭০ হাজার এবং আইএসপি ও পিএসটিএন মিলিয়ে ১ কোটি ১১ লাখ ৪০ হাজার। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী অধিকাংশই সরাসরি টিকটক অ্যাপস ব্যবহার করেন, আবার যারা অ্যাপসটি ব্যবহার করেননি কিন্তু কোন সামাজিক মাধ্যমে টিকটকে বানানো ভিডিও দেখেনি তা হতেই পারেন।

টিকটক কীভাবে দ্রুত ছড়িয়ে গেলো এবং এর কারণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মাহফুজা খানম দেখান, ‘করোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিশোর-কিশোরীরা তাদের এনার্জি লেখাপড়ার বদলে টিকটকের মতো অ্যাপে খরচ করছে। এর মাধ্যমে তারা বিনোদন ও উত্তেজনা খুঁজে নিচ্ছে। কিন্তু এসব বিষয়ে সেন্সরশিপের প্রয়োজন আছে। টিকটক কিশোর অপরাধের মতো ঘটনা উসকে দিচ্ছে। কিশোরদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তারা যে অপরাধগুলো করে তা একাকী নয়, দলগতভাবে করে থাকে। এক্ষেত্রে যেসব কিশোর-কিশোরীর চিন্তাভাবনা একই ধরনের, তারা যখন কোনো নেতিবাচক কাজ করে তা দলগতভাবেই করে। ফলে এই কম বয়সীদের মাদক গ্রহণ ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। যদি সরকারিভাবে এ ধরনের অ্যাপস নিয়ন্ত্রণ করা হতো তাহলে এর এত অবাধ ব্যবহার হতো না।’

টিকটক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘টিকটক প্রযুক্তি আমাদের তরুণদের স্থিরতার চেয়ে অস্থিরতা ও উত্তেজনায় ভরিয়েছে বেশি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অ্যাপসনির্ভর বিনোদন উৎসগুলো মানুষের অন্তর্নিহিত বাস্তবতা তুলে ধরছে। একটি জাতির সামাজিক প্রস্তুতি ও শিক্ষণ কতটা দুর্বল হলে অবক্ষয় ধরে চিন্তায়, মননে ও প্রকাশে। মানুষের মনে আকাশের ব্যাপ্তির চেয়েও বেশি ভাবনা ভর করতে পারে। তবে প্রকাশ্যে পরিমার্জন প্রয়োজন। আমাদের তরুণ সমাজের একটি অংশ উদ্ভট সংস্কৃতির আয়োজনে সাময়িক উত্তেজনায় যে সমস্ত কর্মে লিপ্ত হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া কষ্টকর। সমাজের মধ্যকার পচন, চিন্তার বিকৃতিপনা, মনুষ্য সংযুক্তির শরীরবৃত্তীয় চাহিদা টিকটকের মূল উপজীব্য। এর মধ্য দিয়ে দুই ধরনের আসক্ত ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। যারা তৈরি করছে তারা নির্মাতা আসক্ত, অন্য পক্ষটি দর্শক আসক্ত। ফলে সমাজে নৈতিকতা গঠনে ও অনুশীলনে সমাজ গৃহীত রূপ পরিত্যাজ্য হচ্ছে। প্রয়োজন সম্মিলিত প্রতিরোধ পদক্ষেপ।

তিনি আরও বলেন, অনুভূতিপ্রবণ জাতি হিসেবে আমাদের উপলব্ধি দেরিতে আসে। টিকটক প্রতিরোধে গৃহীতব্য ব্যবস্থাটি কঠিন ও কঠোরভাবে নেওয়া উচিত। অন্যথায় প্রতিটি ঘরের পাশে একটি করে থানা বসাতে হবে। এখনই সময় জেগে ওঠার, নিজেদের তৈরি করার। সমাজ রূপান্তরের সময় চলছে। ঠিক না হলে পস্তাতে হবে।’

লেখক: শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। 

Previous articleবই পড়লেই মিলবে চা
Next articleক্রিকেট থেকে কেনিয়ার হারিয়ে যাওয়ার আদ্যোপান্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here