আনিসুর রহমান
আচ্ছা সাহিত্যকে বলা হয় জীবনের দর্পণ। তাহলে জীবন মানে কী? মায়ের পেট থেকে পৃথিবীতে আসা এবং মৃত্যুর মাধ্যমে আবার মাটির সাথে মিশে যাওয়াই তো জীবন। কিন্তু এই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে অপেক্ষা। তাহলে জীবনের অর্থ অপেক্ষা নয় কী? এক অনন্ত, চলমান ও ক্ষয়হীন অপেক্ষার। যেখানে থাকে জন্মের পূর্বেই জন্মের জন্য অপেক্ষা, জন্মের পরে পূর্ণতা পাওয়ার অপেক্ষা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের অপেক্ষা। এসব পূরণ হয়ে গেলে থাকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। কিংবা মৃত্যুর পর অনন্ত মুক্তির জন্য অপেক্ষা। শুধু মানুষ নয় পৃথিবীর প্রতিটা উপাদান থাকে অপেক্ষায়, প্রতিক্ষায়। এই অপেক্ষাকে কেন্দ্র করে আজকের পর্যালোচনায় থাকছে বিখ্যাত লেখক স্যামুয়েল বার্ক্লে বেকেটের অ্যাবসারডিস্ট নাটক ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ (Waiting for Godot)।
১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্ব একটি চূড়ান্ত অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে শুধু ধ্বংসযজ্ঞ। হিংস্রতা, মানবতাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। মানুষের বেঁচে থাকা হয়ে উঠেছে বেদনার, হয়ে উঠেছে অর্থহীন। ঠিক তখনি মানুষের মানসিক ভারসাম্যের অস্থিরতা, মানব অস্তিত্বের ভঙ্গুরতাকে নিয়ে উপহাসের ছলে আমাদের সম্মুখে বিচিত্র অর্থের দুয়ার খুলে দিতে ১৯৪৮ সালে বেকেট নিয়ে আসে নাট্যরীতির এক নতুন দৃষ্টান্ত ‘ওয়েটিং ফর গডো’। এটি মূলত একটি অ্যাবসার্ড ধর্মী নাটক। ১৯৫৩ সালের ৫ জানুয়ারি প্যারিসের থিয়েটার ‘ডি ব্যাবিলনে’ প্রথম প্রদর্শিত হয় নাটকটি। পরবর্তীতে এখানেই প্রায় চারশত বারের অধিক বার মঞ্চায়িত হয় নাটকটি।

দুই অঙ্কে নির্মিত নাটকটির মোট চরিত্র সংখ্যা পাঁচটি। নাটকটির প্রধান চরিত্রে রয়েছে ভ্লাদিমির এবং এস্ট্রাগন। তাদের কথপোকথনের মধ্য দিয়েই শুরু হয় নাটকটি। ভ্লাদিমির কে ছোটো করে ডাকা হয় দিদি এবং এস্ট্রাগনকে ডাকা হয় গোগো নামে। এছাড়াও রয়েছে পোজো, কৃতদাস লাকি ও সংবাদবাহক বালক। সম্পূর্ণ নাটকটিতে দেখা যায় প্রধান দুই চরিত্র সর্বশক্তিমান গডোর জন্য অপেক্ষা করছে। তারা গডোকে কখনো দেখেনি এবং গডো আদৌও আসবে কিনা তারা তা জানে না।
নাটকটির শুরু হয় সন্ধ্যা হওয়ার কিছুক্ষণ পূর্বে। শুরুতে দেখা যায় একটি গাছের তলায় বসে বৃদ্ধ এস্ট্রাগন তার জুতো খোলার চেষ্টা করছে। এমন সময়ে ভ্লাদিমির এসে বলে সে গতকাল রাতে একটি গর্তে পড়ে কয়েকজন অজ্ঞাতকারীর হাতে মার খায়। মূলত এস্ট্রাগন ও ভ্লাদিমির একে অপরকে বহুদিন ধরে চিনে। তারা প্রতিদিন এখানে আসে, অপেক্ষা করে এবং বিরামহীনভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে থাকে। তাদের বেশির ভাগ সংলাপ অর্থহীন ও হাস্যকর। তাদের এই কথা বলা এবং একটি নির্দিষ্টস্থানে বার বার ফিরে আসার পেছনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘গডো’ নামের একজনের সাথে সাক্ষাৎ লাভের অভিপ্রায়। কিন্তু তারা অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছে। তারা বারবার সেখান থেকে চলে যেতে চায় কিন্তু পারে না। কারণ তারা গডোর জন্য অপেক্ষা করছে। তারা সময় কাটানোর জন্য বিভিন্ন অর্থহীন কথাবার্তা ও কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এই যেমন একই সংলাপ বারংবার বলে যাওয়া, বারবার জুতা খোলা ও পরিধান করা, কোনো কারণ ছাড়াই মাথা থেকে টুপি খোলা ও পরিধান করা, গলায় ফাঁস দিয়ে অপেক্ষা করা ইত্যাদি। গলায় ফাঁস দিয়ে গডোর জন্য অপেক্ষা করার বুদ্ধিটা মূলত এস্ট্রাগনের মাথায় আসে। আর তা ভ্লাদিমিরেরও পছন্দ হয় কিন্তু তাদের মাঝে বিতর্ক তৈরি হয় যে কে আগে ফাঁস নিবে। অবশেষে তারা এই বুদ্ধি বাতিল করে, কেননা একজন ফাঁস নিয়ে মারা গেলে আরেকজন একা হয়ে যাবে।
এক পর্যায়ে সেখানে উপস্থিত হয় পোজো এবং তার কৃতদাস লাকি। প্রথমে ভ্লাদিমির আর এস্ট্রাগন পোজোকে গোডো ভাবে৷ কিন্তু পোজো জানায় সেও গডোর অপেক্ষায়। পোজো আর লাকি দুই অদ্ভুত চরিত্র। পোজো হচ্ছে প্রভু আর লাকি দাস। লাকি পোজোর হাতের দড়িতে বাঁধা। পোজো মাংস খেয়ে হাড় ছুঁড়ে দেয় আর লাকি সেই উচ্ছিষ্ট খেয়েই বাঁচে। পোজোর অমানবিক আচরণে ভ্লাদিমির, এস্ট্রাগন আরো ভেঙ্গে পড়ে। পোজো যা চায় লাকি তাই করে তাকে আনন্দ দিতে নাচে, গায়, কবিতা পড়ে। এমনকি কান্নাও করে। কান্নার একপর্যায়ে এস্ট্রাগন লাকির চোখের পানি মুছে দিতে যায় কিন্তু লাকির লাথি খেয়ে সে ফিরে আসে। ইতিমধ্যে একটি বালক এসে খবর দেয় গডো আজকে আসবেন না, কলকে আসবেন৷ বিষণ্ন হয়ে ফিরে যায় এস্ট্রাগন আর ভ্লাদিমির।
নাটকটির দ্বিতীয় অঙ্কটি (দুইদিন/কিছুদিন পর) একই সময় শুরু হয়। অঙ্কটির শুরুতে দেখা যায় গাছটিতে কয়েকটি পাতা গজিয়েছে। পাশেই একটি জুতা পড়ে রয়েছে। যথারীতি ভ্লাদিমির এখানে আসে এবং গান গাইতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে ভ্লাদিমিরও আসে। তারা ভুলে যায় যে এটাই সেই স্থান যেখানে তারা গতকাল এসেছিল। তারা পেজো ও লাকির কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় ফাঁস নেওয়ার কথা। তারা পুনরায় বিভিন্ন অর্থহীন কথাবার্তা ও কাজের মাধ্যমে গডোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। যথারীতি সেখানে উপস্থিত হয় পোজো ও লাকি। আজকে পেজো আসে অন্ধ এবং লাকি আসে বোবা অবস্থায়। লাকি তাদের দেখে থামলে পোজো ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। পোজো তাদের সাহায্যের বিনিময়ে এস্ট্রাগন ও ভ্লাদিমিরকে ১০ ফ্রাঙ্ক দিতে চায়। কিন্তু তারা তাদের সাহায্যের জন্য রাজি হয় না। কেননা তাহলে তারা চলে যাবে। একটি অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তারা কেউ কাউকে চিনতে পারে না। আগেরদিন যে তাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং তারা একসাথে সময় কাটিয়েছিল তা বেমালুম ভুলে যায়।
কিছুক্ষণ পর পোজো ও লাকি চলে যায়। কিন্তু এস্ট্রাগন ও ভ্লাদিমির যায় না। তারা বসেই থাকে। কারণ তারা গডোর জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর সেই বালক এসে জানায় আজও আসবেন না গডো। তিনি আগামীকাল আসবেন। ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে চায় তারা, কিন্তু কিছু দূর গিয়ে তারা থেমে যায়। কেননা তাদের গডোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তারা পুনরায় গাছের সাথে ফাঁস নেওয়ার কথা চিন্তা করে। তাই এস্ট্রাগন নিজের বেল্ট খুলে এবং দুইজন দুইপাশ ধরে টান দেয়। কিন্তু বেল্ট ছিড়ে যায়। এদিকে টানাটানির সময় এস্ট্রাগনের প্যান্ট খুলে পড়ে যায়। ভ্লাদিমির বলে আগামীকাল আমরা অবশ্যই ফাঁস নিবো যদি গডো আমাদের বাঁচাতে না আসেন। এই বলে দুইজন চলে যাওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করে। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে আবার থেমে যায়। কেননা তাদের গডোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
আমি যখন নাটকটি পড়েছি আমার কাছে মনে হয়েছে এর শুরু আর শেষ একই রকম। এতে না আছে পুরো ট্র্যাজেডি না আছে মিলন। শুধু অগ্রগতিহীন নিঃসঙ্গ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা ও অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই নেই। নাটকটির সময়কাল মাত্র দু’দিনের, অথচ এই এতটুকু সময় পার করতে চরিত্রগুলোর এত বেশি কষ্ট করতে হয় যে, মনে হয় অনন্তকাল ধরে তারা অপেক্ষা করে আছে।
আপনি যখন নাটকটি পড়বেন আপনার মনে হবে এস্ট্রাগন ও ভ্লাদিমির চিরদিনই অপেক্ষায় ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কোনোদিনই তাদের এই অপেক্ষার অবসান হবে না, এমনকি গডো কোনোদিনই আসবেন না। আগামীকালের নামে তারা এক বর্তমানের মাঝে আটকে থেকে কারো জন্য, কিছুর জন্য অপেক্ষমাণ কিন্তু সেই অপেক্ষা অনন্তকালের মতো তাদের না পাওয়ার বেদনায় বিদ্ধ করেছে। তবুও তারা অপেক্ষমাণ। একটি প্রশ্ন মাথায় আসতেই পারে যে, গডো কে? তারা কেনো গডোর অপেক্ষায় রয়েছে? তাদের অপেক্ষা করার কারণ স্পষ্ট করা না হলেও তাদের আলাপে ‘গডো’ কে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কেউ বলে মনে হয়। যেন ‘গডো’ তাদের সাথে সাক্ষাৎ করলে তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। ‘গডো’ কে নিয়ে সমালোচকরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ গডোকে ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আবার অনেকে বলেছেন, গডো হচ্ছে মানুষের বিচিত্র আকাঙ্ক্ষা। যার কোন অন্ত নেই। সেই সব অভিলাষ যার কোন সমাপ্তি নেই। গডো মানুষের প্রতিনিয়ত আশার সূচক নির্দেশক। তাদের মতে, অস্তিত্ব যেখানে শেকড়হীন হতাশা সেখানে চূড়ান্ত। এই হতাশায় মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কিন্তু একজন গডোর অপেক্ষা মানুষকে আবার নতুন করে বাঁচতে শেখায়।
এবার আসি নাটকটির সাথে মানব জীবনে সম্পর্ক নিয়ে। একটু কল্পনা করুন, আপনি একজন শিক্ষিত বেকার তরুণ। আপনি সদ্য পাশ করে বেরিয়ে প্রতিনিয়ত যখন চাকুরির ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছেন। একের পর এক ব্যর্থতার পরেও আপনি মনের মাঝে একটি আশা নিয়ে ক্লান্তিহীন ভাবে সামনে এগিয়ে চলেছেন। আপনার কিছু আশা রয়েছে। যেমন, যখন আমি কাঙ্ক্ষিত চাকরিটি পাব তার কিছু বছর পর প্রমোশন হবে। তারপর একটি বিয়ে করবো। তারপর একটি ছোট্ট বাড়ি বানাবো। ছেলেমেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করে, যখন আমি রিটায়ারর্মেন্টে যাব, আমি হবো তখন একজন সত্যিকারের সুখী মানুষ, সফল স্বামী, আর গর্বিত একজন পিতা। এখানেই কি শেষ? না। দেখা গেল যে, যখন আপনি সুখী হওয়ার কথা তখন আপনি আরো বেশি অন্যান্য আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। আপনার সাফল্যের জন্য আরো অপেক্ষা করছেন। আপনি জানেন না আপনার চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন কিংবা আশা পূরণ হবে কিনা। তার পরেও আপনি আশায় রয়েছেন। যেমনি ভাবে বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডো’ এর দুই প্রধান চরিত্র- ভ্লাদিমির এবং এস্ট্রাগন ভাবতে থাকে, গডোর সাথে সাক্ষাৎ হলে তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে জীবন সুখের হয়ে যাবে, তা কী আদৌও কখনো সম্ভব? হয়ত হ্যাঁ। হয়ত না। তেমনিভাবে, আপনার সব আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলেও, আপনি চরম সুখী একজন মানুষে পরিণত হতে পারবেন না। কেননা চূড়ান্ত সুখ প্রাপ্তির কিছু পরেই আপনি আবার নতুন কোনো আকাঙ্ক্ষার জন্য অপেক্ষায় থাকবেন। আর প্রাকৃতিকভাবেই এটা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে।
বেকেট এই রচনাটি দিয়ে এমন একটি ভাব ফুটিয়ে তুলেছেন, যেন আমরা সবাই ব্যক্তিগতভাবে কোনোকিছুর বা কারো জন্য প্রতীক্ষায় আছি, কিন্তু সেই ব্যক্তি বা ব্যাপারটি কখনোই আমাদের কাছে সহজে পৌঁছাবে না। যেমনি ভাবে ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগন গডোর দেখা পাবে না। বেকেট খুব চমৎকারভাবে এই নিশ্চয়তার মাঝের অনিশ্চয়তার বিষয়টি এবং অনিশ্চয়তার অন্ধকার দিকগুলোকে দক্ষতার সাথে উন্মোচন করেছেন। শেষ করছি এস্ট্রাগনের একটি সংলাপ দিয়ে, ‘কিছুই হয় না, কেউ আসে না, কেউ যায় না, এটা ভয়ানক!’