28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

তালিপাম: শতবর্ষে একবার ফুল

Must read

ক্রমশ বৃদ্ধিমান। খুবই ধীরে ধীরে ডাল মেলছে। প্রথম দেখায় যে কেউ বলে উঠবে এটি তালগাছ। তবে কাছে যেতেই বলে উঠবে বিদেশ থেকে আনা কোনো গাছ। নাম কি তার? পাশাপাশি দুজন বলাবলি করলেও নাম জানে না কেউই। তবে আপন মনে ভেবে নেয় ‘এটা কোন এক ধরনের বিদেশি প্রজাতির গাছ। আর যাই কিছু হোক এটা কোনোভাবেই তালগাছ হতে পারে না।’

বলছিলাম কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে স্ব-মহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা বিলুপ্ত প্রজাতির তালিপাম গাছের কথা। বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট ও পর্যটকদের অনেকেই মনে করেন এটি বিদেশি প্রজাতি কোন উদ্ভিদ৷ তবে সেরকম কোনো কিছুই নয়। বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার ও থাইল্যান্ড ব্যতীত পৃথিবীর আর কোথাও এই গাছ জন্মে না। গাছটির যে গুণ সবচেয়ে চমকপ্রদ সেটি হলো গাছটিতে শতবর্ষে একবার ফুল ফোটে। ফুল থেকে কয়েক হাজার ফল হয়। আর ফুল ফোটার কয়েক বছরের মধ্যেই গাছটি মারা যায়।

২০১২ সালে গাছটি রোপণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আমির হোসেন খান।  সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কোষাধ্যক্ষ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ৭টি গাছ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে উপহার দেন। তবে অযত্ন ও অবহেলায় বাকি ৬টি মারা গেছে বলে জানা গেছে। তবে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র তালিপাম গাছটির অনন্য বৈশিষ্ট্য সবাইকে মুগ্ধ করে।

এই গাছের শেকড়ের সন্ধান পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপ-উপাচার্য ভবনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা বুনো প্রজাতির একটি গাছ থেকে। ২০০১ সালের এই গাছটিকে পৃথিবীর একমাত্র তালিপাম গাছ হিসেবে চিহ্নিত করেন বাংলাদেশের উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা। পরে ২০০৮ সালে গাছটিতে ফুল আসলে অসংখ্য ফল দিয়ে ২০১০ সালে গাছটি মারা যায়।

গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছেন কর্মচারীরা

জানা যায়, ১৮১৯ সালে ভারতের পূর্বাঞ্চলে তালিপাম গাছের সন্ধান পেয়েছিলেন ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী উইলিয়াম রক্সবার্গ। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের পাশে ১৯৫০ সালে আরেকটি গাছ শনাক্ত করেন অধ্যাপক এম সালার খান। সে সময় পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে আরেকটি গাছ ছিল। সেই গাছে ১৯৭৯ সালে ফুল আসে। শতবর্ষী সেই গাছে হঠাৎ ফুল দেখে স্থানীয়রা চমকে যায়। ‘ভুতের আছর’ ভেবে ফল ধরার আগেই গাছটি কেটে ফেলেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গাছটি বুনো তালগাছ নামে পরিচিত ছিল। সরকারি বাংলা কলেজের তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক আখতারুজ্জামান চৌধুরী তাঁর পিএইচডি গবেষণার কাজ করতে গিয়ে একটি পুস্তকে এই বইয়ের সম্পর্কে জানতে পারেন। পরে যখন গাছে ফুল ধরে তখন এই গাছের ফল সংগ্রহ করতে শুরু করেন তিনি। পরে তার প্রচেষ্টায় সেই গাছের ফল থেকেই চারা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।

তবে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্মানো তিনশো চারার মধ্যে ২০১০ সালে বিতরণ করা হয় ১২০টি চারা। এর মধ্যে ১০০ চারা দেওয়া হয় বন বিভাগকে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে সাতটি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’টি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’টি, বেইলি রোডের সামাজিক বন বিভাগকে দু’টি করে চারা দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় নাগরিক গৌতম রায়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে সে দেশে নয়টি চারা উপহার দেওয়া হয়।

ধারণা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গাছটি রোপণ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মের আগে। সে সময় ব্রিটিশ গার্ডেনার রবার্ট প্রাউডলক রমনা জোনকে সাজানোর দায়িত্ব নিয়ে ঢাকা আসেন। এ এলাকায় তখন অনেক দুর্লভ গাছ রোপণ করা হয়। গবেষকদের মতে, প্রাউডলকই হয়ত তালিপাম গাছটি রোপণ করেছিলেন।

তালিপাম গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Corypha taliera। এটি Arecaceae গোত্রের সদস্য। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-৪ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। জেনে রাখা ভাল যে, আগামী ৮০ থেকে ৯০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর কোথাও এই গাছের ফুল ও ফল হবে না। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে ২০১২ সালে টাঙ্গাইলের সার্কিট হাউজে রোপনকৃত তালিপাম গাছে মাত্র ৯ বছরে ফুল এসেছে। অকালে ফুল আসায় গাছটি নিয়ে গবেষণা চলছে।

টাঙ্গাইলের সার্কিট হাউজে

এমন বিলুপ্তি প্রজাতির গাছ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যবর্ধন কমিটির আহ্বায়ক সোহরাব উদ্দীন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিলুপ্ত প্রজাতির গাছ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এতে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য যেমন বৃদ্ধি পাবে, মানুষেরা বিলুপ্তি প্রজাতির গাছের সম্পর্কে এখানে জানতে আসবে। এখানে এসে তাঁরা ছবি তুলবে, গাছতলায় বসে আড্ডা দিবে। আগামীতে এমন বিলুপ্তি প্রজাতির গাছ আনার বিষয়ে কাজ করব।

লেখক: শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article