28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

নালন্দা বিহার ধ্বংসের মধ্য দিয়েই কি বৌদ্ধ ধর্ম হারিয়ে গিয়েছে!

Must read

মুতাসিম বিল্লাহ 

উত্তর ভারতে প্রতিষ্ঠিত নালন্দা আদি ৫ম শতাব্দীর এক স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যা পরবর্তী সময়ে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘১২০২ সালে মুসলিম সৈনিকদের অতর্কিত আক্রমনে এ বিহার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এর মধ্য দিয়ে ভারতে একসময়ের দাপুটে বৌদ্ধ ধর্মের পতন ঘটে।’ এ বয়ানটি ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম হারিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও জনপ্রিয়। এর পাশাপাশি ভারতে বৌদ্ধদের নাই হয়ে যাওয়া গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্রে থাকে মুসলিমদের নাই করে দেওয়ার বিবরণ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে এনটিসিবির সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়েও একই অভিযোগ তোলা হয়েছে; কিন্তু অনেকগুলো কারণে বিষয়টি সমস্যায়িত বলে আলাপ তুলেছেন পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির দর্শনের শিক্ষক জন এলভার্সখগ তাঁর বুড্ডিজম এন্ড ইসলাম অন দা সিল্ক রোড বইয়ে। এর পাশাপাশি রাহুল সাংস্কৃত্যয়নও তুলে ধরেছেন তাঁর বই- ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান ও পতন এ বহুমাত্রিক অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কারণ।

বুড্ডিজম এন্ড ইসলাম অন দা সিল্ক রোড বই।

প্রথমত, ইতিহাসের বিভিন্ন নিদর্শন প্রমাণ করে যে, নালন্দা ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির আক্রমণের পরেও ১৩ শতক পর্যন্ত এর গতিধারা বজায় রাখতে পেরেছিলো। এমনকি মুসলিম ও বৌদ্ধরা এশিয়াতে কম হলেও ১ হাজার বছর পাশাপাশি বসবাস করেছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।

বরং নালন্দা ধ্বংস আমাদের কাছে একটা বয়ানকে সামনে নিয়ে আসে সেটা হলো কে ভালো কে মন্দ। যে বয়ানটি অরিয়েন্টাল বয়ান। যেখানে বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান ও পতনের ক্ষেত্রে জটিল অর্থনৈতিক, পারিবৈশিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ইতিহাসকে না টেনে খুব সহজে মুসলিমদেরকে দোষী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ব্রাহ্মন্যবাদের সহযোগিতায় অরিয়েন্টালচর্চিত ইতিহাসের বয়ানে বৌদ্ধধর্মকে গুড, র্যাশনাল, পোস্ট এনলাইটমেন্ট ফিলোসফি, পিস, ট্রাঙ্কুয়ালিটি এবং ইন্ট্রোসপেকশন শব্দ দ্বারা উপস্থাপন করা হয়। অপরদিকে ইসলামকে উপস্থাপন করা হয় ভায়োলেন্ট এবং ইরেশনাল ধর্ম, অন্ধ বিশ্বাসের ধর্ম হিসেবে। বৌদ্ধ ধর্মকে হিমালয় থেকে আসা স্বচ্ছ প্রস্ফুটিত আর ইসলামকে নোংরা গ্রাম থেকে, বোরকা পড়া থাকাদের ধর্ম হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মকে আধুনিক ধর্ম, বিজ্ঞানভিত্তিক ধর্ম আর ইসলামকে ব্যাকডেটেড, মধ্যযুগীয় ধর্ম হিসেবে দেখা হয়। অরিয়েন্টালদের ১৯শতকের ইতিহাস চর্চায় এমনকি বৌদ্ধ ধর্মকে আধ্যাত্নিক ধর্ম আর ইসলামকে এভিল ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বর্তমানে যেকোনো সমস্যার সমাধানে বৌদ্ধ ধর্মকে এর ফিলোসফিকে বলে দেওয়া হয় পৃথিবীর সকল সমস্যার সমাধান এর মধ্যে নিহিত। আর ২০০১ সালের ৯/১১ এর পর তালেবান যখন আফগানে বামিয়ান বৌদ্ধমন্দির এ হামলা করে তখন আবার নালন্দাকে নিয়ে এসে এর মধ্য দিয়ে সকল স্টোরিটাইপকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চূড়ান্ত সুবর্ন সুযোগটা কাজে লাগায় ওরিয়েন্টাল প্রজেক্টের সংশ্লিষ্টরা।

ইতিহাসের সূত্র বলে, বৌদ্ধধর্মের উত্থান পতন ক্রম-অনুসারে ঘটেনি; ঘটেছে পাশাপাশি সমান্তরালভাবে। ঐতিহাসিকদের মতে খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতক থেকে বৌদ্ধধর্মের বিলোপ শুরু হয়।

ইতিহাস আমাদের জানায়, মৌর্য সম্রাট ছিলেন  বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী। তাঁর আমলে নির্মিত হয়েছিলো হাজার হাজার স্তুপ, সঙ্ঘারাম। শ্রেষ্ঠীদের অর্থানুকুল্যে তৈরি হয়েছিলো বড় বড় স্তুপ, সঙ্ঘারাম। সেখানে ভিক্ষুরা সুখে-স্বাচ্ছন্দে বাস করতেন এবং ধর্মপ্রচারে মগ্ন থাকতেন। খ্রি.পূ. দ্বিতীয় শতকে মৌর্য সেনাপতি পুষ্যমিত্র (খ্রি.পূ.১৮৫-১৪৯) শেষ সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করেছিলেন এবং নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে শুঙ্গ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এই নতুন রাজবংশ রাজনৈতিক দৃষ্টির দিক থেকে ব্রাহ্মণ্যধর্মের শুধু অনুসারী নন, অকৃত্রিম অনুসারীও ছিলেন। একই সঙ্গে অব্রাহ্মণ্য ধর্মে বিদ্বেষীও ছিলেন। ফলে তাঁরা বৌদ্ধধর্মকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করলেন। এই সময়কাল বৌদ্ধদের পক্ষে উপযোগী ছিল না।

মহাভাষ্যকর পতঞ্জলির পৌরহিত্য বহু শতাব্দীর পরিত্যক্ত অশ্বমেধ যজ্ঞ পশুবলি প্রথা পুনরায় শুরু হয়েছিলো এ কালে। এ সময়ই ব্রাহ্মণদের মহাত্ন্য গ্রন্থ মনুস্মৃতির রচনারও সূত্রপাত ঘটে।

কুষাণ আমলে সম্রাট কনিষ্কের সময় (খ্রিষ্টিয় ৭৮-১০৩ অব্দ) অর্থ্যাৎ বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের চার শতবছর পর, সর্বপ্রথম বুদ্ধমূর্তি নির্মিত হয়। মহাযানপন্থীরা ধর্মপ্রচারের সাথে সাথে আড়ম্বরপূর্ণ বুদ্ধ-প্রতিমার পূজা-অর্চনা শুরু করেন। এই জাঁকজমকপূর্ণ বুদ্ধ-প্রতিমার পূজা বৌদ্ধধর্মের মূল সূত্র থেকে সরে গিয়েছিলো। এ সময়ে ব্রাহ্মণ্যদেব দেবীর মতো এইসব বোধিসত্ত্বের কাছে কামনা-বাসনা পূরণের জন্য প্রার্থনা করা শুরু হয়। দেব দেবী ও বোধিসত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরি হলো বড়ো বড়ো মন্দির, সৌধ, সৃষ্টি হলো বহুস্তোত্র। মহাযানীরা বুদ্ধের পঞ্চ ধ্যানী মূর্তি, ধ্যানী বুদ্ধের পঞ্চশক্তির মূর্তি আরাধনা করতে শুরু করলেন।

বৌদ্ধধর্মের পতনের দ্বিতীয় অভ্যন্তরীণ কারণ হলো ধারণী। ধারণী হলো কতগুলি অর্থহীন মন্ত্রধ্বনি। যেমন- ‘হুং ক্রীং ফট্ স্বহা’ ধারণীর ভাবনা এসেছে মহাযান ধর্মের (দর্শনের) সরলীকরণের সূত্র ধরে। মহাযান বৌদ্ধধর্ম আয়ত্ত করতে বা বুঝতে দীর্ঘ সময়, পরিশ্রম ও মেধার প্রয়োজন। নিম্ববর্গীয় বৌদ্ধরা সংস্কৃত ও পালিভাষায় শিক্ষাহীন। ফলে এই ভিক্ষুরা মহাযানী দর্শনশাস্ত্র আয়ত্ত করতে পারতেন না। মহাযানী সিদ্ধাচার্যরা সহজপথ বের করলেন। সেই পথটি হলো ধারণী স্মৃতিধার্য করা ও ধারণী জপ করা। যে বৌদ্ধধর্ম বিজ্ঞান, মাধ্যমিক করুণা, শূণ্যতার মতো দার্শনিক পরিমন্ডলের শীর্ষভূমিতে পৌঁছৈছিল তা ক্রমশ রূপ নিল আচার-সর্বস্ব ধর্মে। এরপরে নিম্ববর্গীয় ভিক্ষুরা ধারণী স্মৃতিধার্য করতে পারল না বা কঠিন হয়ে উঠল তখন তৈরি হলো এক অক্ষরবিশিষ্ট বা দুই অক্ষরবিশিষ্ট মন্ত্র। ‘ধনু ধনু ক্রীং ফট স্বহা’। বৌদ্ধধর্ম আক্ষরিক অর্থে মন্ত্রচারীর ধর্ম হিসেবে টিকে রইল।

ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, গুহ্যসাধনা হলো তান্ত্রিক বৌদ্ধদের সাধনা। এর অর্থ হলো গোপনভাবে পূঁজা করা। এই মূর্তিগুলো হলো শম্বও; অর্থ্যাৎ নগ্ন নারী মূর্তি। এই মূর্তিগুলো ‘মুদ্রা’ ‘মন্ডল’ যোগ সাধনা দ্বারা পূজিত হতো। মঞ্জুশ্রীমূলকল্প তন্ত্রের জন্য উপায় উদ্ভাবন করে দেওয়া হলো। গুহ্যসমাজ ভৈরবী চক্রের সাহায্যে স্ত্রী সম্ভোগের দ্বারা আরও সহজ সরল পথ নির্মাণ করল। বৌদ্ধ মহাসুখবাদ ও গুহ্যতান্ত্রিক সাধনার সঙ্গে তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্য শক্তিবাদের পার্থক্য কমে এলো। ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক সাধনার মূল লক্ষ্য হলো, ‘মোক্ষ’; বৌদ্ধ গুহ্য সাধন প্রক্রিয়ায় এর ছাপ পড়ল। দুটি ধারা সহজেই মিলে গেল। আস্তে আস্তে বৌদ্ধতন্ত্র মার্গী সাধনার সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র মার্গ সাধনা এক হয়ে গেল। তান্ত্রিক বৌদ্ধ সম্প্রদায় মহাযানীদের মধ্য থেকেই বের হয়েছিলো। রাহুলের মতে, খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে ভারতের সমগ্র বৌদ্ধসমাজ মহাযানপন্থীদের অনুসারী হয়ে গিয়েছিলো। বুদ্ধের সহজ সরল শিক্ষা থেকে তারা বিচ্যুত হয়েছিলেন। মনগড়া অলৌকিকতায় তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করলেন।

বৌদ্ধধর্মের নৈতিক অবনতি ঘটাল সহজিয়া সাধনা। বজ্রযানের সাধনাই সহজরূপে দেখা দিল। রাহুলের মতে যা পূর্ববর্তীকালে ছিল বজ্রযান, পরবর্তীকালে তাই হলো সহজযান। সহজযানের প্রধান ভূমিকা হলো গুরুর। তাঁদের চোখে সমগ্র জগৎ ব্রহ্মান্ড দেহের মধ্যেই আছে। দেহেই আছে আকাশ, কাম, ধাতুরূপ, ধাতুঅরূপ, সমেরু সবই। বোধিচিত্ত নির্বাণ দেহের আধারে নিমজ্জিত। সিদ্ধাচার্য নামে তারা স্থিত। দেহের মধ্যেই প্রকৃতি, প্রজ্ঞা, বোধিসত্ত্ব। দেহেই ঘটবে নির্বাণের মহাসুখ সম্ভোগ। গুরু নির্দেশিত পথে চরম কাম্য বস্তুলাভ করা যায়। বৌদ্ধ সহজযানের সামাজিক ব্যাভিচার বৌদ্ধধর্মের অধঃপতনের পথকে প্রশস্ত করেছিল। রাহুল দেখিয়েছেন কীভাবে সহজযানপন্থী চৌরাশি সিদ্ধাগণ ছিলেন মদ-মত্ত; এঁরা বাস করতেন শ্মশানে বা বনজঙ্গলে। সঙ্গে রাখতেন মানুষের মাথার খুলি। এঁরা নিজেদের অদ্ভুত ক্ষমতা, দিব্যশক্তির অধিকারী বলে মনে করতেন। প্রকাশ্য নারী সম্ভোগে লিপ্ত হতেন।

এই পাঁচশত বৎসর ধরে (অষ্টম থেকে দ্বাদশ) আস্তে আস্তে ভারতীয় সমাজে পচন ধরল। সিদ্ধাচার্যদের খপ্পরে পড়ে সাধারণ মানুষ কামুক, মদ্যপ এবং অন্ধবিশ্বাসী হয়ে উঠল। দেবমন্দিরে সর্বদা বলি পূঁজা অর্চনা হতে লাগল। ব্রাহ্মণ্যধর্ম অনুসারীরা ক্ষয়ে যাওয়া ভ্রষ্ট সাধারণ মানুষের উপর নিজের ধর্মমত চাপিয়ে দিতে লাগল। ভারতীয় জনসাধারণ অন্ধবিশ্বাস ও দুরাচারের গভীরে আকণ্ঠ ডুবে গিয়েছিল।

খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে একাদশ পর্যন্ত পূর্বভারতের বঙ্গ ও বিহারে রাজত্ব করতেন পাল রাজারা। চীনা পরিব্রাজক হু-য়েন-সাঙ ভারতভ্রমণে এসেছিলেন খ্রিষ্টীয় ৬২৯-৪০ সালে। তাঁর দেওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে বাংলাদেশে একলাখের বেশি বৌদ্ধ, বিভিন্ন সংঘারাম ও বিহারগুলিতে বসবাস করতেন। এরাঁ নিম্নবর্গীয় মানুষ। পাল রাজারা ছিলেন ধর্মসহিষ্ণু। ব্রাহ্মণবাড়িতে যজ্ঞে উপস্থিত থাকতেন। হোমের ফোঁটা দিতেন। ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করতেন। সংঘ ভোজন করাতেন। স্তুপ বিহার নির্মাণ করতেন। পাল বংশীয় রাজারা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হতেন ব্রাহ্মণ্য বংশীয় রাজকুমারীদের সঙ্গে। যেমন বৌদ্ধ ধনদত্ত বিবাহ করেছিলেন শৈব রাজকুমারীকে। পাল বংশের পতনের (খ্রিষ্টীয় ১১৬২) পর শুরু হয় ব্রাহ্মণ্য ধর্মালম্বী সেন রাজত্ব। হিন্দুরাজা বল্লাল সেন (খ্রিঃ ১১৬-৭৯) এবং লক্ষণ সেন (খ্রিঃ ১১৭৮-১২০৬) উভয়ে ছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদী। বৌদ্ধদের তারা অনুদান করেননি।
বুদ্ধের নির্বানের দীর্ঘ সময়  পর ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের মধ্যে বিবাহপ্রথা চালু হয়। ফলে বুদ্ধ দর্শনের মূল সূত্র প্রতীত্য সমুৎপাদ, অনাত্নবাদ, নির্বাণ ইত্যাদি থেকে লৌকিক বৌদ্ধসমাজ সরে আসতে শুরু করে। তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে তা ব্যাভিচারে রূপ নেয়। একই সময়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বৌদ্ধ দেবায়নকে কুক্ষিগত করে নিল। বৌদ্ধ দেবদেবী ব্রাহ্মণ্যদেবদেবীর রূপান্তরিত রূপ নিয়ে আত্নপ্রকাশ করল। নালন্দার মতো বিহারে বৌদ্ধ দেবদেবীদের সঙ্গে পুজিত হতে লাগলেন শিব-পার্বতী, বিষ্ণু, গণেশ, এমনকি লৌকিক মনসা পর্যন্ত। বৌদ্ধ ধর্মে হিন্দু পুরাণ যেমন মৎস্য বায়ু বিষ্ণু পুরাণের মতো গ্রন্থ উচ্চ শ্রদ্ধার আসন পেল। বুদ্ধ হয়ে উঠলেন হিন্দু দেবতা। তাঁকে বলা হলো বিষ্ণুর দশ অবতরের নবম অবতার।

হিউ এন-সাঙ এবং ইৎ-সিং এর বিবরণে দেখা যায় মহাযানীরা বিনয় পিটকের মতবাদ অনুসরণ করছে। এবং নালন্দা মহাবিহারে সর্বাস্তিবাদকে অনুসরণ করা হচ্ছিল। যেহেতু মহাযানীরা প্রথমে বিনয় পিটকের নির্মাণকার্য করেননি, সুতরাং তাঁরা পুরানো পিটক ও উপসম্পদা ও কর্মবিধি মেনে নিয়েছিলো।  মহাযানীরা হীনযানীদের বিরুদ্ধে যে যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন ঠিক একই যুক্তি মহাযানীদের বিরুদ্ধে বজ্রযানীরা সাজালো। দ্বিতীয়ত, বজ্রযানীরা উন্মুক্ত প্রতিবেশে ভিক্ষুদের শিক্ষাদান করত না। কারণ তাদের গুঢ় সাধনতত্ত্বে নারী ও মদ অনিবার্য উপাদানরূপে কাঙ্খিত হয়ে উঠেছিল। তাঁদের শিক্ষানীতিগুলি জৈবিক কারণে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল।

সপ্তম শতাব্দীর পর থেকেই এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। অষ্টম শতাব্দীতে এসে সমগ্র ভারতের বৌদ্ধসমাজ বজ্রযানপন্থী হয়ে উঠল। এই বজ্রযানপন্থীদের সৃষ্টি হয়েছে মহাযানপন্থীদের থেকে। বুদ্ধের সহজ সরল শিক্ষা তাঁদের কাছে গ্রহণীয় ছিল না। তাঁরা মনগড়া হাজার হাজার অলৌকিক ক্রিয়ায় স্থিত হলেন। বজ্রযানপন্থী মেধাবী ও প্রতিভাশীল পদকর্তারা নানা বেশে ঘুরে বেড়াতেন। এঁদের পেশাভিত্তিক নামকরণ  হতো। যেমন পহ্ণহী পা, কমরী পা, ডমরু পা, ওখরী পা ইত্যাদি। এরা ছিলেন মদ-মত্ত। এরা প্রকাশ্যেই নারী সঙ্গ ও মদ উপভোগ করতেন। রাজা মহারাজার পর্যন্ত এদের লিপ্সা তৃপ্ত করতে নিজেদের কন্যাদের উৎসর্গ করতেন। এরা সম্মোহন বিদ্যায় সরল সাধাসিধে মানুষদের বোকা বানাতেন। কখনো হাত সাফাই করে কখনো কণ্ঠস্বর বিকৃত করে জনতাকে অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ দেখাতেন। প্রায় পাঁচশত বৎসর ধরে সারা দেশ জুড়ে ব্যভিচার চলতে থাকল। ভারতের সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে কামুক, মদ্যপ এবং অন্ধবিশ্বাসী হয়ে উঠল। মন্দিরে মন্দিরে চলল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উপাচার, বলি-পূজা অর্চনা, ভারতীয় জনতা যখন অন্ধ বিশ্বাসে আকণ্ঠ ডুবে গেল, তখন ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি জাতিভেদ প্রথার পুঞ্জ পুঞ্জ বিষ গোটা জাতির জীবনকে গৃহদ্বন্দে¦ জীর্ণ করে তুলল। বেশিরভাগ অনুসরণকারীরা এই ক্রিয়াচার আকর্ষিত হত ইন্দ্রিয়লালসা তৃপ্তির জন্য। অষ্টম শতাব্দীর পর নালন্দা বিক্রমশালীর মতো বৌদ্ধ বিহারগুলি বজ্রযানীদের কেন্দ্রস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। খোদ অষ্টম শতাব্দীর পর উত্তর ভারতে বৌদ্ধধর্মের মধ্যে বুদ্ধের আদর্শ শিক্ষা ও বাণী খুব ক্ষীণভাবে টিকে রইল। প্রতিটি বিহারে ভিক্ষুরা জাদু মন্ত্র, এমন কি নকল দৈববাণীর অনুশীলন করত। এই বিহারগুলি শত শত বোধিসত্ত্ব প্রতিমায় পরিপূর্ণ এবং ভয়ঙ্কর দর্শন দেবদেবীর অশ্লীল মূর্তিতে ভরা। যে চুরাশিজন সিদ্ধাচার্য খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত ব্যাপ্তীতে ভরে উঠেছিলো, তাঁরা এই ক্রিয়াচারে বিপুল অনুপ্রেরণা যোগালেন। দীর্ঘ অনুশীলনের পর তাঁরা আবিষ্কার করলে কিছু আধ্যাত্নিক অলৌকিক যোগ। তাঁরা এই সাফল্যের ফসল জীবনভর ভোগ করে গেছেন। ভারতের উচ্চশিক্ষিত থেকে নিরক্ষর, রাজা থেকে হত দরিদ্র সবাই এই নিগুঢ় তত্ত্ববিদদের সম্মান করত। তাদের সাধন প্রণালীতে শ্রদ্ধান্বিত ছিল। তাঁদের সাধনায় ও অনুশীলনে রাজাদের এতটাই বিশ্বাস ছিল যে, তাঁরা রাজ্যের প্রশাসন পরিচালনায় তাঁদের সৈন্যবাহিনীর চেয়েও এই তান্ত্রিকদের উপর বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে ভারতবাসীরা এতটাই কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসে লিপ্ত হয়েছিল যে তাঁরা ঘৃণ্য ক্রিয়াচারে দ্বারস্থ হতে দ্বিধা করেনি। ব্রাহ্মণ্যশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় বর্ণাশ্রম প্রথা জাতির মর্মমূলে অনুপ্রবেশ করেছিলো। জাতি তখন নানা শ্রেণিতে বিভক্ত। একই শ্রেণির মানুষ একই বর্ণের হয়েও একেরসঙ্গে অপরের পদমর্যাদা নিয়ে সংঘাত লেগে থাকত। এ সময়ে সেন রাজারাও এতটাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলেন, যে বিরাট সৈন্যবাহিনীর ব্যয়ভার বহন করার চেয়ে জাদু মন্ত্রবাদীদের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। এর পরিণামে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার খিলজি রাজধানী দখল করে নিয়েছিলেন।

উপরোক্ত  প্রেক্ষিতে এ সময়ে একদিকে মুসলিমরা যখন আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করল, জাতিপ্রথার বদলে প্রত্যেক মানুষ ভাই ভাই বিশ্বাসের প্রচার প্রসার করল, সূফীরা যখন লঙ্গরখানাগুলো খুলে দিয়েছিলো, তখন আরেকদিকে বৌদ্ধদের অর্থনৈতিক, নৈতিক, পারিপার্শ্বিক, আধ্যাত্নিক পরাজয়, নিজ ধর্ম থেকে ধীরে ধীরে সরে আসা, মদ, ব্যাভিচার, রাহ্মণ্যবাদের আচার অনুষ্ঠানে লীন হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম তাঁর জৌলুশ হারিয়েছে, নালন্দা বিহার ধ্বংস একটা ধর্মকে একটা জাতিকে নাই করে দেয়নি, তাহলে হিন্দু ধর্ম ও হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো, মন্দির ও তো অনেক সময়ে আক্রান্ত হয়েছে। বরং ওরিয়েন্টালদের বহুল প্রচলিত এই মিথ বৌদ্ধদের নিজভূমি থেকে হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাসের অনেকগুলো ঘটনাকে আড়াল করে দিচ্ছে। খোদ যে বিষয়টি নিয়ে ইন্ডিয়া থেকে গোটা বিশ্ব গবেষণায় ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে সে রকম একটা বিতর্কিত বয়ান কিশোর শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক থেকে অপসারণ হওয়া খুব বেশি জরুরি।

লেখক- শিক্ষক ও গবেষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, মেইল: [email protected]

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article