28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

‘ঘাস মারার বিষ’ জনপ্রিয়তার কারন ও পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব

Must read

মোঃ রনি খান:

গ্রামের হাটে বাজারে যেকোনো সার বা কীটনাশকের দোকানে গিয়ে আপনি ঘাস মারা বিষের খোজ করলেই পেয়ে যাবেন খুব সহজে এক প্রকার বিষ যা ঘাস মারার কাজে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অতি সহজলভ্য হওয়ার কারনে এই বিষের ব্যবহার যত্রতত্র বেড়েই চলেছে দিনকে দিন। মানুষজন এর ক্ষতিকর প্রভাব না জেনেই ফসলের মাঠ, রাস্তার ধারের জঙ্গল, ক্ষেতের বা পুকুরের আইলে গজানো ঘাস গুলোকে মেরে ফেলতে চিন্তা ভাবনা ছাড়াই এটি ব্যবহার করছে। কাজেই সাধারণ মানুষদেরকে পরিবেশে এই বিষের ব্যাপক ও সূদুরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক না করলে এক সময় আমাদের দেশের পরিবেশ সংকটের সম্মুখীন হতে পারে।

এই বিষ ব্যবহারের ফলে পরিবেশের নানা প্রকার ক্ষতি হচ্ছে। একদিকে যেমন অসংখ্য উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরী হচ্ছে অন্যদিকে প্রকৃতিতে বসবাস করা বন্য প্রাণীগুলোও হারিয়ে যেতে পারে এই বিনাসী উপাদানের ব্যবহার লাগামহীন ভাবে হতে থাকলে।পরোক্ষভাবে এর ক্ষতিকর প্রভাব মানব স্বাস্থের উপরও পড়তে পারে।

এই বিষ জনপ্রিয় হওয়ার কারন:
প্রথমত কৃষকরা আগাছা দমনের জন্যই এই বিষ ব্যবহার করত ফসলের মাঠে। কিন্তু ধীরে ধীরে আগাছা দমনের জন্য এখন এর ব্যবহার সব যায়গান হচ্ছে।কারন সবাই খুব কম ব্যায়ে আগাছা দমন করার এক নতুন পদ্ধতি হিসেবে এই বিষকে ব্যবহার করছে।

যেখানে কয়েকজন শ্রমিকের সারাদিন লাগত একটি বড় জমির আগাছা পরিষ্কার করতে এবং প্রীতিজনকে দিতে হত গড়ে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা, সেখানে শুধু কয়েকশ টাকার বিষ এনে ছিটিয়ে দিলেই সব কাজ শেষ। এ কাজ করতে কোনো শ্রমিকেরও দরকার হয় না আর সময়ও লাগে খুব কম। অর্থ ও সময় দুটোই বেঁচে যায় বহুগুনে। তাই সব মানুষই এই বিষের প্রতি ঝুঁকছে আরও প্রবলভাবে। দ্বিতীয়ত এই বিষের কার্যকারিতাও খুব ভালো অর্থাৎ এই বিষ ব্যবহার করলে সব ধরনের উদ্ভিদ খুব সহজে মারা যায়। এমন ভাবে মারা যায় যে খুব দ্রুত এই মারা যাওয়া উদ্ভিদ গজাতেও পারে না সহজে। ঝোপ জাতীয়, লতানো বা ছোট গাছ সব ধরনের উদ্ভিদের ক্ষেত্রে সমানভাবে কার্যকারী এই বিষ। তাই ভিন্ন ভিন্ন উদ্ভিদ নিধনের জন্য আলাদা আলাদা কোনো ব্যবস্থা নিতে হয়না। এর ফলে কৃষকরা এই বিষ ব্যবহারে আরও উৎসাহী হয়ে উঠছে।

আরেকটি কারন হিসেবে বলা যেতে পারে এর সহজলভ্যতা। এই বিষ খুবই সহজলভ্য একটি উপাদান হয়ে গেছে সব স্থানেই। ব্যবহারের কোনো বিধি নিষেধ না থাকায় দোকানদাররা মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে এই পরিবেশঘাতী বিষাক্ত পদার্থ।

বিষাক্ত এই পদার্থের অবাধব্যবহারের পেছনে আরেকটি প্রধান কারন হলো বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের পরিবেশ বিষয়ে অজ্ঞতা।
পরিবেশ বিষয়ে শিক্ষা না থাকার কারনে তারা নিজের অজান্তেই নিজেদের ক্ষতি সাধন করছে। তারা মনে করছেন এসব আগাছা গুরুত্বহীন কিন্তু এই বিষ ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের যে ভয়ংকর রকম ক্ষতি করছেন সে বিষয়ে তেমন কোন জ্ঞান নেই।

তবে দোকানদার এবং অনেক সাধারান মানুষ মনে করছেন যে যেহেতু তারা এই বিষ স্বল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করে থাকেন এবং এর ফলে তারা উদ্ভিদকে সমূলে ধ্বংস করেও দিচ্ছে না তাই এটি ততটা ক্ষতিকর নয়। যার ফলে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিবেশে কোনোও অসুবিধা হচ্ছে বলে তারা মনে করছে না।

ঘাসের বিষ ব্যবহারের কয়েকটি নেতিবাচক দিক:
ঘাসের বিষ প্রয়োগের নানা রকম নেতিবাচক দিক
পরিবেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে । এর মধ্যে
প্রধান কয়েকটি কারন আলোচনা করা হল-

উদ্ভিদ বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা:

আগাছা হিসেবে যেসব উদ্ভিদকে বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলা হচ্ছে সেসমস্ত উদ্ভিদের বাস্তুতন্ত্রে রয়েছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ক্রমাগত বিষপ্রয়োগের ফলে অনেক উদ্ভিদ সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে না, এতে করে এদের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। অনেকসময় দেখা যায় উদ্ভিদ যখন ফুল ও ফল ধারন করে ঠিক সেই সময় বিষ প্রয়োগ করা হয় তখনও এদের বংশবিস্তারের হার কমে যায় অনেকগুন। সঠিকসময় যদি উদ্ভিদ বাড়তে না পারে এবং বংশবিস্তার না করতে পারে তখন পরিবেশ থেকে স্বভাবতই হারিয়ে যাবে এরা।
জলজ উদ্ভিদও এর থেকে বেচে থাকতে পারবে না কারন বৃষ্টির পানির সাথে মিশে খুব সহজে বিষ জলাশয় গুলোতে গিয়ে সেখানে থাকা জলজ উদ্ভিদকেও ধ্বংস করতে পারে। এভাবে স্থলে এবং জলে সমানভাবে উদ্ভিদকে সমূলে ধ্বংস করে আমাদের সুস্থ পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলবে।

বন্য প্রানীদের সংকট তৈরী:
হাজারো কিট পতঙ্গ আছে যারা উদ্ভিদ খেয়ে বেচে থাকে আর সাপ, ব্যাঙ, শিয়াল, বনবিড়ালসহ আরও নানা রকম প্রাণী আবার এসব ছোট কীটপতঙ্গ খেয়ে বেচে থাকে। তাই ঘাস যদি হারিয়ে যায় তাহলে এসব প্রাণীর সংখ্যাও দিন দিন হারিয়ে যাবে। তাছাড়া এই বিষ বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরী হওয়াতে সরাসরি তা নানা রকম কীটপতঙ্গের জীবন নাশের কারন হতে পারে। যেমন কেচো, শামুকের মত উপকারী অনেক প্রানীর বেচে থাকার আশ্রয় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। মাটিতে এই বিষ অধিক মাত্রায় ব্যবহার করার ফলে যেসব পাখি নানা রকম ঘাস এর বীজ খেয়ে ও লতা বা গুল্মের ফল খেয়ে জীবন ধারন করে থাকে তাদেরও খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।

আমাদের দেশীয় ও পরিযায়ী পাখি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এই বিষক্রিয়ার ফলে। বন্য প্রানীদের খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের বাসস্থানের ক্ষেত্রেও সংকট দেখা দিবে কারন এসব প্রানী ছোট ঝোপ ঝাড়ে লুকিয়ে থাক বা ঝোপের নিচে গর্ত করে বসবাস করে কিন্তু বিষ প্রয়োগের ফলে ঝোপের সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে যার ফলে বন্যপ্রানীও পড়ছে বাসস্থানের সংকটে।

প্রকৃতির খাদ্যচক্রে দেখা দিবে ভয়াবহ এক সংকট যার ফলে আমাদেন পরিবেশের দূষণের মাত্রা আগের তুলনায় বেড়ে যাবে।

বিনামূল্যের খাদ্য উৎসে সংকট:

গ্রামের অনেক মানুষ এখনও প্রকৃতিতে কুড়িয়ে পাওয়া শাক, নানা রকম সবজিসহ শস্য দানা সংগ্রহ করে থাকেন। যা একেবারেই বিনামূল্যে তাই তারা খুব সহজে নিজেদের চাহিদা ও পুষ্টির অভাব পূরণ করতে পারেন এসব খাবার থেকে। কিন্তু এই বিষ ব্যবহারের ফলে কোনো প্রকার খাদ্য উপাদান তারা সংগ্রহ করতে পারেন না ।শুধুমাত্র এই বিষ ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক এসব খাদ্য ভান্ডার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজারো মানুষ। এতে দেখা দিবে পুষ্টি ঘাটতিও।

বিনামূল্যের খাদ্য সকল মানুষ কেবল খাদ্য হিসেবে নয় এর নানা প্রকার ঔষুধী গুণের কারনে খেয়ে থাকেন ।কিন্তু এখন তা দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ছে। কারন রাস্তার ধারেই হোক বা পুকুর পাড়েই সবত্রই মানুষ এই ঘাসের বিষ ব্যবহার করছে এতে করে প্রাকৃতিক খাদ্যের বিনামূল্যের ভান্ডার খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে আমাদের আশেপাশের পরিবেশ থেকে।

আমাদের পরিবেশকে আমাদেরই বাচাতে হবে। তাই
আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে এই পরিবেশ বিধ্বংসী
উপাদান ব্যবহারের ক্ষেত্রে। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রেই এই বিষ ব্যবহারের বিধি তৈরী করা উচিত। সবচেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জনগনকে এই বিষ সম্পর্কে বুঝানো। এর ক্ষতিকর দিক নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করা এখন সময়ের দাবি। এই বিষ ব্যবহারের ফলে পরিবেশের উপর যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে তা থেকে বাচতে হলে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং সেই সাথে সচেতন করতে হবে আমাদের আশেপাশের সবাইকে যেনো তারাও এর ব্যবহার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তা না হলে বাংলাদেশের প্রাণ বৈচিত্রকে টিকিয়ে রাখা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। এজন্য সবাইকে সাথে নিয়ে রুখে দিতে হবে এই বিষের ব্যবহার। সবুজ শ্যামল এই বাংলার প্রকৃতিকে বাঁচানোর জন্য হলেও আমদের পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক:  শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article