তানভীর হোসাইন:
একটি আরামদায়ক ও কর্মব্যস্তহীন দিনের আকাঙ্ক্ষা নেই এমন মানুষকে খুজে পাওয়া দুষ্কর। নিশ্চয় আপনার এই মূহুর্তে বিছানার কথা মনে পড়েছে? পড়েনি? নাকি বলতে চাচ্ছেন না? সমস্যা নেই বলতে হবে না। অর্থাৎ আরাম আয়েশ অপছন্দ করেন, এমন মানুষ এখন আর নেই।
তবে যাদেরকে আমরা সেরা ও সফল ব্যক্তিদের তালিকায় দেখি হয়ত তাদের সম্পর্কে আপনি ভাবছেন তারা কখনো বিশ্রাম চায়নি! বরং তারাও কর্মবিমূখ বা আরামদায়ক দিন চায়। শুধু তাই নয় বিশ্রাম নেয়া কোন বিলাসিতা নয় বরং এটি প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রয়োজনীয় অংশ।
কিন্তু যদি দেখেন যে আপনি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি আরাম-আয়েশ করে অলসভাবে সময় কাটিয়ে দিচ্ছেন যেটা আপনার কাজে ব্যঘাত ঘটাচ্ছে। তখন বুঝতে হবে আপনার সাথে এমন কিছু ঘটছে যেটা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেটি আপনার দৈনন্দিন কাজে আগ্রহ নষ্ট করে, নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কারে বাধার সৃষ্টি করে এবং সর্বপরি আপনার কাজ করার ইচ্ছেশক্তিকে নষ্ট করে দেয়।
তবে আপনার জন্য সুখের বিষয় হল, সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণায় এই সমস্যাগুলোর সমাধানে বিভিন্ন কর্মকৌশলের কথা বলা হয়েছে। কিভাবে এই অলসতা কাটিয়ে উঠে আরো কর্মক্ষম হওয়া যায় সে ব্যাপারে পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। এমন কিছু কাজের কথা বলা হয়েছে যেগুলো ব্যক্তিগত জীবনে মেনে চলার মাধ্যমে অলসতাকে কাটিয়ে উঠতে পারেন যেকেউ।
১. পূরণযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারন করুন
অপূরণযোগ্য লক্ষ্য কখনো ভালো ফল বয়ে আনতে পারেনা বরং আপনার কাজেকে ধ্বংস করে দিতে পারে। শুধু তাই নয় যেই কাজে আপনি চাপ অনুভব করবেন সেই কাজটি আপনার ক্লান্তিভাব, কাজের প্রতি অনিহা সৃষ্টি এবং আগ্রহ-উদ্দীপনা নষ্ট হওয়ার কারণ। তাই আপনি অধিক কাজের চাপ নিবেন না। এতে আপনার লক্ষ্যে পৌঁছাবেন খুব সহজে।
২. নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা না করা
কোন মানুষই কি কোন কাজে নিখুঁত হতে পারে? হ্যা, দক্ষ হওয়া সম্ভব তবে নিখুঁত হওয়া নয়। এই নিখুঁত হওয়া শুধু মেশিনের দ্বারা সম্ভব। যদি সেটাকে আপনি নিজের মত করে সাজিয়ে নিতে পারেন।
২০১৭ সালে একটি গবেষনায় উঠে আসে, ১৯৮৯ এবং ২০১৬ এর মধ্যবর্তী সময়ে কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের মাঝে নিখুঁত হওয়ার প্রবণতা খুব বেশি ছিল। সময়ের ব্যবধানে এই ছাত্ররাই এখন পিতা-মাতা। আর বর্তমানে এই পিতা-মাতার ছায়ায় বেড়ে উঠা সন্তানেরা প্রতিযোগীতামূলক পরিবেশ, পিতা-মাতার অধিক আশায় তাদেরকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত জীবন পার করতে বাধ্য করছে। যা আগের জেনারেশনের তুলনায় অনেক বেশি।
এই প্রতিটি কাজে নিখুঁত হওয়ার প্রবণতা মানুষের বিষন্নতা ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কারণ। তবে দিন দিন দক্ষ হওয়ার চেষ্টা অব্যহত রাখা উচিত।
৩. নিজের ব্যাপারে নেতিবাচক মন্তব্য করা
নেতিবাচক মন্তব্য আপনাকে লক্ষ্যচ্যুত করে দিতে পারে। কখনো বলবেন না. ”আপনি একজন অলস, কর্মবিমূখ মানুষ” এও বলবেন না, ”কাজটি সম্পন্ন করার কোন উপায় নেই”। বরং বলুন, কাজটি সম্পন্ন করার জন্য আমার সকল ধরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব। এতে আপনার কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়বে একটা সময় পর সম্পন্নও করতে পারবেন।
টমাস এলভা এডিসন যখন ১ হাজার বার চেষ্টা করার পর লাইট আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছিল তখন তিনি বলেছিলেন আমি ১হাজারটা পন্থা জেনেছি যেভাবে চাইলেও কাজটি সম্পন্ন করা যেতনা। সুতরাং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কাজটিকে মূল্যায়ন এবং সমাধান করার চেষ্টা করুন।
৪. একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার করুণ
একটি কাজ কিভাবে, কখন, কত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করবেন সেটার সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা করুণ। এতে আপনার কাজটি আরও সহজে সম্পন্ন করতে পারবেন। এবং কাজটি সম্পন্ন করতে আপনি আলাদা একটি উদ্দীপনা অনুভব করবেন। শুধু তাই নয় আপনি যদি কাজটি সম্পন্ন করতে একাকীত্ব অনুভব করেন বা একা সম্পন্ন করতে বাধার সম্মুখীন হন, তবুও আপনি কাজটি সম্পন্ন করতে তেমন বেগ পোহাতে হবেনা।
৫. আপনার শক্তিকে ব্যবহার করুন
সময় নিয়ে ভাবুন কোন কাজটিতে শক্তি অনুভব করছেন যখন কোন একটি কাজের পরিকল্পনা করেন এবং কাজটি সম্পন্ন করতে চান। সেটা মানসিক বা শারিরীক শক্তি উভয় হতে পারে। কাজটি বের করার পর আপনার শক্তিকে বিভিন্ন দিক থেকে ব্যবহার করার চেষ্টা করুন যাতে কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে সঠিকভাবে শক্তির দিকে মনোযোগের ফলে কর্মক্ষমতা, ইতিবাচক অনুভূতি ও কাজে দীর্ঘক্ষণ লেগে থাকার পরিমাণকে বৃদ্ধি করে দেয়।
৬. অন্যের থেকে সাহায্য চাওয়া
অনেকে মনে করে থাকে কোন কাজ সম্পন্ন করতে অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া এক ধরণের দূর্বলতা। কিন্তু হতে পারে এই সাহায্য না চাওয়াটাই আপনার কাজে ব্যর্থ হওয়ার কারণ। ২০১৮ সালে এক গবেষনায় দেখা গেছে যারা সহকর্মীদের থেকে সাহায্য চায় না তাদের কাজের মধ্যে অতৃপ্ত হওয়া এবং তুলনামূলক কম আউটফুট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কাজে সহযোগীতা চাওয়ার ফলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় তাছাড়া সহকর্মীদের থেকে উদ্দীপনা পাওয়া যায় এবং কাজটি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা যায়।
৭. ডিস্ট্রাকশন এড়িয়ে চলা
অনেক সময় আমাদের সাথে এমনটা হয়ে থাকে, কোন একটি কাজ শুরু করে কিছুক্ষণ কাজ করার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এর কথা মনে পড়ে। অবচেতন মনে আমরা তখন ঘন্টার পর ঘন্টা সেখানে নষ্ট করি। যার ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো থেকে ডিস্ট্রাকশন ফ্রি থাকার জন্য লগ আউট করে রাখি।
তাই আপনাকে কোন জিনিসগুলো বিভ্রান্ত করে সেটি বের করার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে ডিস্ট্রাকশন ফ্রি থাকার জন্য লাইব্রেরী, একটি শান্ত পরিবেশ, বা একটি খালি রুম এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অথবা এমন একটি এপ ব্যবহার করুন যেটা আপনাকে ডিস্ট্রিকশন থেকে বিরত রাখবে। যাতে করে কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে সহজ হয়।
৮. সময়সাপেক্ষ ও বিরক্তিকর কাজগুলোকে আনন্দদায়ক বানানো
আমাদের জীবনে যে কাজটি সময়সাপেক্ষ এবং বিরক্তিকর সেই কাজগুলো থেকে আমরা নিজেদের বিরত রাখার চেষ্টা করে থাকি। যেমন ধরুন বাথরুম পরিষ্কার করা, রুম পরিস্কার করা, বাজার করা ইত্যাদি। আমরা চাইলেই এধরণের কাজগুলোকে আনন্দদায়ক করতে পারি। যেহেতু আমরা চাইলেও অপরিহার্য কাজ বিধায় এড়াতে পারিনা। তাই এই কাজগুলো করার সময় শরীরের কত ক্যালরি খরচ হলো সেটার পরিমাপও করতে পারেন। এতে আপনার কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়বে এবং ভালো লাগা কাজ করবে এভাবে আপনার কাজকে আনন্দদায়ক করতে পারেন। এতে কাজও সম্পন্ন হবে এবং কাজে কোন ধরণের বিরক্তভাব আসবেনা।
৯. নিজেকে পুরস্কৃত করা
ধরুন আপনি অনেক কষ্ট করে একটি দুঃসাধ্য কাজ সম্পন্ন করলেন নিঃসন্দেহে এটি আপনার জন্য একটি পুরস্কার। যদি এটি অফিসের কাজ হয় তবে আপনি প্রমোশন ও কিছু ইনসেন্টিভ বা পুরস্কার পাবেন। আপনার বস থেকে এটি আশা করা খুবই স্বাভাবিক। তবে এর বাহিরেও নিজেকে পুরস্কৃত করুন। সেটি হতে পারে কোথাও ঘুরেতে গেলেন বা পরিবারের সাথে কোন একটি স্পেশাল জায়গায় খেতে গেলেন বা বন্ধুদের সাথে একটা পার্টি দিলেন। এতে আপনার নতুন কোন কাজ করার আগ্রহ বহুগুণে বেড়ে যাবে।
১০. নিজের কাজকে স্বীকৃতি দিন
ধরুন আপনি একটি বড় প্রজেক্টে হাত দিলেন তখন সেটাকে সম্পন্ন করতে আপনাকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করা লাগতে পারে। এই ছোট অংশে ভাগ করা কাজগুলোকে সম্পন্ন করে নিজেকে স্বীকৃতি দিন এই বলে, “ওয়েল ডান! আমিতো কাজটা করে ফেলেছি ”। এতে আপনার বাকি কাজ সম্পূর্ণ করতে উদ্দিপনা পাবেন। সম্ভব হলে আপনার এই সকল অর্জনগুলোকে কোন ডায়েরিতে লিখে রাখাতে পারেন। পরবর্তীতে এই ডায়েরি দেখে নিজেকে অনুপ্রণিত করতে পারবেন কোন বড় কাজ করার ক্ষেত্রে। এটি খুবই কার্যকরী একটি উপায় যা আপনার কনফিডেন্স ও ইতিবাচকতা বৃদ্ধি করবে এবং আপনি কাজটিকে এগিয়ে নিতে পারবেন।
এবার আপনাদেরকে জানাবো কোন স্বাস্থকর উপায়ে আপনি অলসতাকে কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
১. প্রোটিন জাতিয় খাবার গ্রহন
কিছু খাবার আছে যা আপনার শারিরিক শক্তিকে বৃদ্ধি করবে এবং আপনার ব্লাডের সুগারকে নিয়ন্ত্রণ করবে। শুধু তাই নয় আপনার অলসতাকেও কমিয়ে দিবে।
আমরা বিভিন্ন সময়ে খুজতে থাকি, এটি জানতে যে কোন খাবার আমাদের অলসতাকে কমিয়ে দিয়ে শারিরিক শক্তিকে বৃদ্ধি করবে? প্রকৃতপক্ষে সেগুলো হলো, কাজুবাদাম, দই, ডিম এবং টুনা মাছ।
২. মিষ্টি ও চবি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন
নিউট্রিশন আর প্রোডাক্টিভিটি একে অন্যের সাথে উতোপ্রোত ভাবে জড়িত। কিছু খাবার আছে যেগুলোর হযমপ্রক্রিয়ায় বেশি সময় লাগে তাছাড়া ব্লাড প্রেসারের কারণও হয়ে থাকে এবং শারীরিক শক্তিকে কমিয়ে দেয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, মিষ্টি জাতীয় খাবার ও পানীয়, পরিশোধিত দই, পাস্তা, এলকোহল, পক্রিয়াজাত খাবার ও ফাস্ট ফুড।
৩. ব্যয়াম করা
একজন মানুষের সুস্থতার জন্য ব্যায়াম অপরিহার্য। এছাড়াও বহু ধরণের উপকার রয়েছে ব্যায়াম এর মধ্যে। অল্প কয়েক মিনিটের ব্যায়ামে শারীরিক শক্তি কয়েক গুণ বেড়ে যেতে পারে তাছাড়া মনকে প্রফুল্ল করে এবং দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ ও বিষন্নতা দূর করে। প্রতিদিন অল্প সময়ের জন্য হলেও ব্যায়াম করা। ব্যায়াম হিসেবে হাটা, সাইকেল চালানো, খেলাধুলা করা যেতে পারে। যাতে আপনি অলসতাকে কাটিয়ে আরও প্রোডাক্টিভ হতে পারেন।
৪. পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নেয়া
ভালোভাবে আপনার কাজগুলোকে সম্পন্ন করতে পর্যাপ্ত ঘুমের কোন বিকল্প নেই। প্রতিটি মানুষকে কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুম নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এতে মানসিক চাপ ও অলসতা থেকে বেচে থাকতে পারবেন।
ভালো ঘুমের জন্য আপনি ঘুমানোর পুর্বে মোবাইলের স্ক্রিণ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন। এছাড়াও রাতে দ্রুত ঘুমানো খুব ভালো ও কার্যকরী অভ্যাস।
৫. মানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণ করুন
মানসিক ও শারিরীক চাপ আপনার সুন্দর দিনটিকে বিরক্তিকর করে তুলতে পারে তাই যখন আপনি কোন কারণে অস্বস্তিতে ভুগবেন, তখন অস্বস্তিতে কারণগুলো বের করার চেষ্টা করুন। সেগুলোকে কাটিয়ে উঠার সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন। তার জন্য আপনি আপনার প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটাতে পারেন বা এমন কিছু করতে পারেন যেটা আপনাকে আনন্দ দেয়।
৬. সবসময় সাথে বিশুদ্ধ পানি রাখুন
পানির উপকারিতা বলে শেষ করা যাবেনা। পানি শুধু ব্রেনের কার্যক্রমে গতিশীলতাই নিয়ে আসে না বরং শারীরিক শক্তির মাত্রাও বৃদ্ধি করে দেয়। আপনি একটু খেয়াল করে দেখবেন যখন আপনি পানি পান করেন তখন কাজের মধ্যে আরো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যা আপনাকে কাজের প্রতি আরো মনোযোগী করে তোলে।
৭. ধুমপান থেকে বিরত থাকুন
আমরা প্রায় শুনে থাকি যে, ধূমপান করলে নাকি মানসিক চাপ কমে। আপনি হয়তো শুনেছেন একই কথা। কিন্তু বাস্তবে এর কিছুই ঘটেনা বরং ধূমপান আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। শারীরিকভাবে অসুস্থ করে তোলে এবং অস্থিরতা বৃদ্ধি করে। তাই প্রোডাক্টিভিটি বৃদ্ধি করতে হলে ধূমপান থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত জরুরি।
উপরের এই ১৭ টি উপায়ে আপনি আপনার দিনকে আরও সু্ন্দর ও কর্মক্ষম করে তুলতে পারেন। তাই ব্যাক্তিগত জীবনে আপনার দিনকে সুন্দর করতে চাইলে এর বিকল্প নেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।