28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

প্রাকৃতিক ভূমি সংরক্ষণ টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত

Must read

মোঃ রনি খান:

পৃথিবীর উপরিভাগের শক্ত আবরনকে ভূত্বক বলে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে ও বাইরে থেকে সক্রিয় শক্তি ক্রমাগত এর ভূমিরুপকে পরিবর্তন করে চলছে। এই পরিবর্তনের পিছনে বিশেষ কিছু কারন রয়েছে। ভূমিরুপের পরিবর্তনের মাধ্যমে পৃথিবী তার সম্পূর্ণ ব্যবস্থায় একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করে থাকে। এর একস্থানে শক্তি বেশী এবং অন্যস্থানে শক্তির পরিমাণ কম থাকার কারনে শক্তির প্রবাহ বিদ্যমান থাকে। ফলে ভূমি বিন্যাসের বৈচিত্র এবং ভিন্ন আবহাওয়া ও জলবায়ু তৈরীর মাধ্যমে শক্তির বৈষম্যের প্রতিফলন হয়।

প্রকৃতির নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতিতে যখন ভূমিরুপের পরিবর্তন হয় তখন সেখানে একটি ধারাবাহিকতা বজায় থাকে এবং শক্তির সুষম বন্টন নিশ্চিত হয় । কিন্তু চিন্তার বিষয় এটাই যে, বর্তমান বিশ্বে মানুষ যেভাবে ভূমির যথেচ্ছ ব্যবহার করতে গিয়ে এর অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, এর ফলে সমগ্র  পৃথিবীর সকল ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব আরও বেড়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার বছর ধরে যে পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে সেই পাহাড় কয়েকদিনের ব্যাবধানে কেটে ফেলা হচ্ছে। আবার সমুদ্র, নদী ভরাট করে তৈরী করা হচ্ছে নানা ধরনের স্থাপনা। এছাড়াও প্রাকৃতিক ভূমিরুপের ধ্বংসের পেছনে খনিজ দ্রব্য আহরণ, বন উজাড়সহ আরও নানা কারন কাজ করছে। বিশ্বে সকল দেশ প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর অতিরিক্ত ব্যাবহার করার কারনে ভূপৃষ্ঠের সরাসরি পরিবর্তন হচ্ছে। বিশেষ করে তেল, গ্যাস, কয়লার মত জীবাশ্ব জ্বালানীর ব্যাপক চাহিদা থাকার কারনে কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই খনি থেকে ও মাটির গভীর থেকে এসব পদার্থ উত্তলন করা হচ্ছে। এর কারনে স্বাভাবিক ভাবেই ভূত্বকের রুপ পরিবর্তন লক্ষনীয়।

পৃথিবীপৃষ্ঠের প্রকৃতিক শৃঙ্খলে কোথাও উচু পর্বতমালা আবার কোথাও সমতল ভূমি, কোনো স্থানে সমুদ্র আবার কোনো স্থানে মালভূমি। কিন্তু মানুষের অস্বাভাবিক আচরণের কারণে এই বৈচিত্র এখন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে পৃথিবীর জলবায়ু ভিন্নভাবে আচরণ করছে। যে স্থানে একসময় প্রচুর বৃষ্টি হত সে স্থানে এখন খরা, বন্যার ভয়াবহতা আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে। এক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভোগান্তির পরিমাণ অনেক বেশী। তবে উন্নত দেশেও এর প্রভাব বাড়ছে। কোন একটি এলাকার বিশেষ বৈশিষ্ট ধ্বংস করে সম্পূর্ণ ভূমিকে পরিবর্তন করে দিলে ঐ এলাকার বাস্তুতন্ত্রে নেতিবাচত প্রভাব পড়বেই।

বিশ্বের অনেক দেশই টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। এটা একমাত্র তখনই সম্ভব হতে পারে যখন এসকল দেশগুলো তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট সম্পন্ন ভূমিকে  সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। টেকসই উন্নয়নের প্রধান শর্ত হল সকল  ধরনের উন্নয়ন হবে কিন্তু তা পরিবেশকে ধ্বংস করে  নয়। বরং পরিবেশের সকল উপাদানের সাথে ভূমির নিবিড় সম্পর্ক রেখে। পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো বা পাহাড়ি ভূমিতে কৃষির সম্প্রসারণ করা এখন নিত্ত নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। এতে মৌলিকভাব পাহাড়ের প্রাকৃতিক কাঠামোতে আঘাত করা হচ্ছে। যার ফলে অচিরেই হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের উচ্চতা।

উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ টেকসই উন্নয়নের কথা বললেও কার্যত তারা এর শর্ত সমূহ সঠিকভাবে মানতে পারছে না। এর পথে বড় বাধা হলো ধনী রাষ্ট্রগুলোর স্বেচ্ছাচারী মনোভাব এবং বিশ্ব নেতাদের অসহযোগিতা।একটি নদী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও দেশগুলো নিজেদের স্বার্থ বিবেচনায় ভিন্ন ভিন্ন নীতি গ্রহণ করে থাকে। এতে নদীর প্রাকৃতিক ভূমি গঠন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। নদীর  পানি ও পলি বয়ে আনার ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যাপক পরিবর্তন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও নদী নিয়ে একই সমস্যা দেখা যায়। পৃথিবীর সব দেশ যদি এভাবে নিজেদের সুবিধার জন্য ভূত্বককে পরিবর্তিত করতে থাকে তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব সমস্ত জীবদের উপরই পড়বে। কারন এটা ভাবা বোকামী হবে যে, নিজেদের দেশকে পরিবর্তন করলেও তা মোকাবিলা করার শক্তি আমাদের আছে। এর কারন পৃথিবীর প্রাকৃতিক চক্র একটা আরেকটার সাথে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত।

সুতরাং প্রাকৃতিক শৃঙ্খলের কোন একটি অংশে বিপর্যয় ঘটলে সেটি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশী সময় লাগবে না। বিশেষ করে  পরিবর্তিত জলবায়ুর মাধ্যমে খুব দ্রুত বেগে ছড়িয়ে পড়ে এসব পরিবর্তনের ঢেউ। তবে বেশিভাগ সময়ে ভুক্তভোগী হতে হয় দরিদ্র দেশগুলোকে। যেখানে প্রাকৃতিক দূর্যোগের মাত্রা ও ভয়াবহতা আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে আরও বেড়ে যাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি যেভাবে মানুষের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে সেইসাথে পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশকেও পরিবর্তন করতে সাহায্য করছে খুব দ্রুতভাবে। যেমন এক্সক্যাভেটর দিয়ে নিমেষেই হাজার হাজার ট্রাক মাটি ও পাথর উত্তলন করা যাচ্ছে। এসব প্রযুক্তির ব্যাবহার করে মানুূষ খুব কম সময়ে ভূত্বককে পরিবর্তন করে দিচ্ছে।

পৃথিবীতে মাত্র ১৯ শতাংশ জায়গা  এখনো মানুষের ব্যাবহারের বাইরে আছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হলেও  এ সংখ্যা কম বেশী হতে পারে। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে আমেরিকার মাত্র ১২ শতাংশ জায়গা প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত করা হয়েছে বলে জানা যায়। তবে এ নিয়ে ভিন্ন মতামত প্রকাশ করেন অনেক গবেষক। জীববৈচিত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ অস্ট্রেলিয়ায় মাত্র ১৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ এলাকা সংরক্ষিত আছে। উন্নত দেশগুলোর বেশীরভাগের অবস্থা এইরকম সংকটাপন্ন।

টেকসই উন্নয়নের অন্যতম লক্ষ্যমাত্রার একটি হচ্ছে “life on Land“ তথা ভূমির উপর সবার জীবন ধারন করার অধিকার নিশ্চিত করা। ভূমির বৈচিত্র হারালে আমরা হারাবো হাজারো জীববৈচিত্র্য। যা আমাদের বাস্তুতন্ত্রের জন্য অতিব জরুরী। যেকোনো ধরনের উন্নয়ন করার সময় এ বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনা করা উচিত। বিশ্বনেতাদের সহযোগিতা ও সদিচ্ছা এবং পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষাই পারে পৃথিবীর ভূমিরুপকে অনাকাঙ্খিত পরিবর্তনের হাত থেকে বাচাতে। আসুন আমরা সবাই প্রাকৃতিক ভূমকে সংরক্ষণ করি এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ সুন্দর পৃথিবী নিশ্চিত করি।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article