28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব এবং আমাদের করণীয়

Must read

তানভীর হোসাইন:

ষড়ঋতুর বাংলাদেশ। শস্য শ্যামলা সবুজ এইদেশের  সম্ভাবনা অপার। অন্য যেকোন দেশের তুলনায় প্রতিনিয়ত এদেশ বহুমুখী সুযোগের হাতছানি দেয়। উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক কাঠামোতে নানান পণ্য দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে সহায়তা করে। এছাড়াও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের নেপথ্যে এদেশে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত গার্মেন্টস শিল্প। সেই সাথে কয়েক কোটি রেমিট্যান্স যোদ্ধারা আমাদের দেশীয় রিজার্ভকে প্রতিনিয়ত সচল রাখার অন্যতম  কারিগড়। উল্লেখযোগ্য এই দুইটি খাত দেশের ৯০ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে।

সম্ভাবনার হাতছানি দেয়া আরেকটি উর্বর খাত হল পর্যটনশিল্প। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। এছাড়াও রয়েছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সেন্টমার্টিন প্রবালদ্বীপ, ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, রাঙ্গামাটি জেলার সাজেক ভ্যালি, বান্দরবান জেলায় বাংলার নায়াগ্রাখ্যাত নাফাখুম জলপ্রপাত, সিলেটের রাতারগুল জলাবন, জাফলংসহ আরও ছোট-বড় দৃষ্টিনন্দন পর্যটনকেন্দ্র। এইসকল পর্যটনকেন্দ্র থেকেও প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য হারে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়ে থাকে।

 

এতসব সুযোগের হাতছানি সত্ত্বেও রয়েছে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা। বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ হওয়ার কারণে এখানকার মানুষদের প্রতিবছর বন্যা, ঘুর্ণিঝড় এবং নদীভাঙ্গনের মত নানা ধরণের দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়। যদিও আমরা এসবকে প্রাকৃতিক দূর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করে থাকি তবে এর নেপথ্যে মানুষের অপ্রাকৃতিক কার্যক্রম বিশেষভাবে দায়ী।

বর্তমানে ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বজুড়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। এর ফলে বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের ‍উচ্চতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে নিচু দেশগুলো অধিক ঝুঁকির মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী আগামি ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৫৩ লক্ষ মানুষ সরাসরি জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবের স্বীকার হতে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ৪ কোটি ৩২ লক্ষ মানুষ দারিদ্রতার মধ্যে বসবাস করছে যা মোট জনসংখ্যার ৩০ ভাগ। আরও আশংকার বিষয় হচ্ছে এর মধ্যে চরম দারিদ্র্য প্রায় ২ কোটি ৪৪ লক্ষ মানুষ যারা  তাদের মৌলিক চাহিদাটুকুও মেটাতে পারছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিশ্বব্যাংক, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম এর হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর  দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি৷ আর এই উপকূলীয় অঞ্চলগুলোই বেশিমাত্রায় প্রাকৃতিক দূর্যোগের সম্মুখীন হয়, যার মধ্যে বন্যা অনতম।

বাংলাদেশ ইনসাইডার এর তথ্য অনুযায়ী ১৯৮৭, ৮৮, ৯৮ সালের বন্যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা। ৮৭ সাালের বন্যা দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ,  ৮৮ তে ৬০ শতাংশ এবং ৯৮ সালে ৬৮ শতাংশ এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়। এই সময় গুলোতে দেশ ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিশেষ করে সিলেটের বন্যায় আমাদেরকে নতুন করে ভাবাচ্ছে। সাধারণত সিলেট বাসবসরত অধিবাসিরা প্রধানত ২ উপায়ে সুপেয় পানি পেয়ে থাকে। নলকূপ ও পাইপলাইন এর মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানি। এই বন্যার কারণে সিলেটের ১২ হাজার নলকূপ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যার ফলে বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। এর পাশাপাশি ৭৮ হাজার শৌচাগারও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সিলেট জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এর তথ্য অনুযায়ী এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকা।

জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব না থাকলে সিলেটের সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা তারই অংশবিশেষ। শুধুমাত্র চলতি বছরেই দেশের সিলেট অঞ্চল ৩য় বারের মত বন্যার মুখোমুখি হয়। এই বন্যার অন্যতম কারণ হিসেবে ভারতের মেঘালয় ও আসামের অতি বৃষ্টি। তবে এছাড়াও আরো কিছু কারণকে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বিবিসি বাংলার এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, গত ১৫ থেকে ১৭ জুন চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৪৮৭ মিলিমিটার। এরকম বৃষ্টি হয়েছিল ১৯৯৫ সালে একবার যা ২৭৯৮ মিলিমিটার ছিল এবং ১৯৭৪ সালে যার মাত্রা ছিল ২৭৬০ মিলিমিটার। এধরণের বৃষ্টি খুব কম দেখা যায়।

এই মেঘালয়ের পানি সারাসরি সুনামগঞ্জ হয়ে হাওরে এসে মিশে এবং ভৈরব বা মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। কিন্তু পানির নব্যতা কমে যাওয়ার কারণে পানি সে অনুযায়ী নামতে পারছেনা। ফলে আশপাশের এলাকাগুলোতে পানি ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে বন্যা দেখা দিয়েছে। এছাড়াও সিলেটে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট অনেক বেশি পরিমাণে হওয়ার কারণে পানি ঠিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছেনা। এর সাথে ইটনা মিঠমিইন সড়ক কেও কিছুটা দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। অতিবৃষ্টির ফলে এই নদীগুলোর অবস্থাও পরিবর্তন হয়েছে। আর বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে বৃষ্টির ধরণেরও পরিবর্তন হয়েছে।

একইভাবে চেরাপুঞ্জিতে যখন বৃষ্টি হয় তা ৬ বা ৮ ঘন্টার মধ্য তাহিরপুরে চলে আসার পর সেটা দ্রুত নামতে না পারার কারণে আশেপাশে ছড়িয়ে গিয়ে বন্যার সৃষ্টি করছে। যার ফলে ভারতেও ব্যপক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, আসামের বন্যার কারণে প্রায় ১১ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তবে যেকোনো দুর্যোগ কিংবা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য মানুষের কাজ যেভাবে দায়ী একইরকম এর সমাধানের জন্য মানুষকেই সর্বাগ্রে ভূমিকা রাখতে হবে।  তাই আসন্ন এসকল দুর্যোগ আমাদের জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ করা, যাতে করে শহরগুলোতে পানি বাড়তে থাকলে সে বাঁধের মাধ্যমে পানি আটকে রাখা সম্ভব হয়। পাশাপাশি পরিকল্পিত বনায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যার ফলে গাছের পানি শোষনের মাধ্যমে পানির চাপ কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হবে।

এছাড়াও পরিকল্পিতভাবে পুকুর, খাল-বিল খননের মাধ্যেমে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পাশাপাশি নদীর দু’ধারে ঘন বনায়নের ব্যবস্থা করা,  সমুদ্র উপকূলবর্তী স্থানে পানির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা এবং নদীর নাব্যতা বাড়ানো প্রয়োজন। আর হাওড় অঞ্চলে অপরিকল্পিত সড়ক নিমার্ণে সতর্ক থাকতে হবে যাতে করে পানি নিষ্কাশনে কোন ব্যাঘাত না ঘটে। এর মাধ্যমে বন্যার মত ভয়াবহ প্রাকৃতিক দূর্যোগগুলো থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article