28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ

Must read

নাইমুর রহমান রিজভী:

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আত্নহত্যা একটি নিত্যনৈমিত্তিক খবরের শিরোনাম। আত্নহত্যার হার যেন দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। কারণে অকারণে অনেকেই বেছে নিচ্ছে এই আত্নহননের পথ। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনার পর সবাইকে বিষয়টি নতুন করে ভাবাচ্ছে ।

তবে মানুষ কেন আত্মহত্যা করে, এর কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর কেউ জানেনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে,আত্মহত্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের আবস্থান বিশ্বে দশম। একটি বেসরকারি ও সেচ্ছাসেবী সংগঠনের তথ্যমতে, স্বাভাবিকের তুলনায় করোনাকালে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। যার অন্যতম কারণ হতে পারে বেকারত্ব, হতাশা, পারিবারিক কলহ, বিচ্ছেদ এবং প্রেমঘটিত জটিলতা। 

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের  শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ কখনো না কখনো হতাশা বা বিষন্নতার মধ্যে দিয়ে যায়। অনেকেই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বা আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছেন। তাদের এই করুন পরিনতির অন্যতম কারণ হল, প্রেমে বিচ্ছেদ বা প্রেম ঘটিত জটিলতা, পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক সমস্যা, মানসিক চাপ, পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা ও আর্থিক সংকট। তবে বিশেষ করে করোনার সময় দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা তাদের স্নাতক শেষ হওয়া ও ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন। ক্যারিয়ার ও পরিবারের স্বপ্ন,  তাদের কাছ থেকে  পরিবারের  প্রত্যাশা সবই ছিল অনিশ্চয়তায়। তাই তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

সম্প্রতি ২০২০ সালের ১৭ আগস্ট করোনা মহামারীর সময়ে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের(আইইআর) ২য় বর্ষের মেধাবী ছাত্র ইমাম হোসেন সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের টাইম লাইনে ‘সিলিং এ ঝুলে গেল সত্তা, নাম দিলে তার আত্মহত্যা’ এমন একটি স্ট্যাটাস দিয়ে নিজ ঘরের সিলিং ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। যার মৃত্যু অনেকটা নাটকীয় ছিলো। পরবর্তীতে জানা যায়, এই আত্নহত্যার পিছনে মূলত প্রেমঘটিত ব্যাপার দায়ী ছিলো।

আত্মহত্যার প্রবণতার অন্যতম আরেকটি কারণ হতে পারে বেকারত্ব। যার ফলে হতাশায় নিজের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে না পেরে এই পথ পাড়ি জমান অনেকেই। অনেকে আবার নিজের স্বপ্ন অথবা বাবা-মায়ের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারার হতাশায়  আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। 

নেপোলিয়ান তার একটি উক্তিতে বলেছেন, ‘আত্মহত্যা জীবনের সবচেয়ে  বড় কাপুরুষতার পরিচয়’। তবুও দুঃখজনক বিষয় হলো, সামাজিকভাবে যারা আত্মহত্যা থেকে সমাজকে মুক্ত করার কথা, আত্মহত্যার বিরুদ্ধে অধিক ভূমিকা নেওয়ার কথা এবং মানুষকে সচেতন করার কথা তারাই ক্রমান্বয়ে এই আত্মহত্যা নামক ব্যধিতে তীব্রভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। যেটি একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নের মাত্রাকে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করে। কারন প্রখর মেধার অধিকারী এসকল শিক্ষার্থীরা কখনও বুঝে কিংবা না বুঝে অমূল্য সম্পদ আত্মাকে বিসর্জন দিয়ে যায়। বিকশিত হওয়ার আগেই সুপ্ত মেধার শেষ অধ্যায় রচিত হয়। 

সাধারণত আত্মহত্যায় মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের ঝুঁকি বেশি থাকে। পাশাপাশি মাদকাসক্ত ব্যক্তি, গুরুতর শারীরিক অসুস্থ ব্যক্তি, প্রিয়জনের মৃত্যু বা সম্পর্ক বিচ্ছেদ বা চাকরি হারিয়েছে এমন ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া ব্যক্তি এবং ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের ঝুঁকি বেশি। এছাড়াও  জীবনে একবার যিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন তিনি বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। 

প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা দিবস প্রতিরোধ পালিত হয়। তবে আমরা আসলে আত্মহত্যা কতটুকু প্রতিরোধ করতে পেরেছি? বস্তুত এই সংকট মোকাবেলায় আমাদের আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। সেক্ষেত্রে  সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা একটি উপায় হতে পারে। আত্মহত্যার উপকরণের (কীটনাশক, স্লিপিং পিল) সহজলভ্যতা কমিয়ে আনতে হবে। 

অনেকে মনে করেন, বর্তমানে আত্মহত্যা একটা ট্রেন্ডের মত হয়ে উঠছে। অর্থাৎ কে কতোটা সিনেমাটিকভাবে আত্মহত্যা করতে পারেন সে ব্যাপারে প্রতিযোগিতা চলে। এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। সংবাদমাধ্যমগুলো যদি আত্মহত্যার কৌশল এবং মাধ্যমগুলোকে কম প্রচার করে অথবা নির্দিষ্ট কিছু নিয়মের মধ্যে থেকে প্রচার করে তাহলে আত্মহত্যা ব্যাধিতে পরিণত হবার সম্ভাবনা কিছুটা কমে যেত।

এছাড়া আত্মহত্যার ভয়াবহতা নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে  সামাজিক এবং সেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিকে অবহেলা না করে সাহস এবং অনুপ্রেরণা দিতে হবে। সর্বোপরি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। শিশু কিশোরদের পাঠ্যপুস্তকে  আত্মহত্যা কি, এর ভয়াবহতা, প্রতিরোধ এবং প্রতিকার সম্পর্কিত বিষয় সংযুক্ত করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যে উন্নয়ন এবং যারা আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের কাউন্সিলিং করার জন্য শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী, কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং মনোচিকিৎসক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে ধর্মীয় শিক্ষা, তাই এ বিষয়ে মসজিদ, মন্দির, গীর্জার কর্নধারদের অনেক করণীয় আছে। বিশেষ করে ইসলামের শিক্ষা এ বিষয়ে অনেক বেশি কার্যকর। ইসলাম আত্মহত্যাকে সমর্থন করে না এটি মহাপাপ ঘোষণা করে, পাশাপাশি যে কোনো দূর্যোগ মুহূর্তে ধৈর্য ধারণ কে সফলতার মানদণ্ড ও সফল মানুষদের বৈশিষ্ট্য বলে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে ধর্মীয় এ বিধিনিষেধের প্রচার ও প্রচারণা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। 

প্রত্যেকটি আত্মহত্যা একটি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও পুরো বিশ্বকে প্রভাবিত করে এবং যারা বেঁচে থাকে তাদের উপরেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। তাই আমাদের সবার উচিত জীবনের সকল সমস্যাকে মোকাবিলা করে, ধৈর্যকে সঙ্গী করে  জীবনকে যাপন করা।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। 

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article