তানভীর হাসান:
‘অমুক মার্কায় দিলে ভোট শান্তি পাবে দেশের লোক’, ‘আমার ভাই তোমার ভাই অমুক ভাই তমুক ভাই’ এটি একটি নির্বাচনকালীন প্রার্থীর প্রাচারণা চিত্র। উন্মাদনার সাথে আছে ক্ষমতার পালাবদল। কে হতে যাচ্ছেন পরবর্তী জনপ্রতিনিধি! যিনি নির্বাচনী এলাকায়, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রকে পরিচালনা করবে। নেতা আসবে এতে কোন সন্দেহ নেই তবে পছন্দের নাকি অপছন্দের সেটি প্রধান প্রশ্ন হয়ে থেকে যায়। এভাবেই প্রতি ৫ বছর অন্তর বাংলাদেশের জাতীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে নির্বাচন হয়ে থাকে।
এই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ জুন ইভিএম পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে স্থানীয় নাগরিকদের মাঝে নানা জল্পনাকল্পনা এবং পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ে ব্যাতিক্রম পরিকল্পনা দেখা গিয়েছিল। একইরকম নির্বাচনে অংশগ্রহনকারী প্রার্থীদের মাঝে বিভিন্ন পরিকল্পনা দেখা যায়। এক্ষেত্রে কারও সুষ্ঠু নির্বাচনের ইচ্ছা থাকলেও কারও নির্বাচনে হেরে যাবার ভয়ে ভোট ক্রয়ের পরিকল্পনার খবর গণমাধ্যমে উঠে আসে।
কারন জনসমর্থনের কথা বিবেচনায় নন্দিত প্রার্থীরা জানেন সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জয়ী হবেন আবার জনসমর্থন না পেলে নির্বাচনে জিততে অবৈধ পন্থা বেছে নেন নিন্দিত প্রার্থীরা। এসকল পন্থার মধ্যে রয়েছে ভোট ক্রয়, লোকবলের মাধ্যমে কেন্দ্র দখল করা, বা কেন্দ্রে যেসকল নির্বাচনী কর্মীরা থাকেন তাদেরকে টাকার বিনিময়ে কেন্দ্র নিজের আয়ত্তে এনে জয়লাভ করা ।
২০২১ সালের ২২ নভেম্বর দৈনিক দেশ রুপান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও পৌরসভা নির্বাচনে পাবনার বেড়া পৌরসভা নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের প্রতি কোনো দয়ামায়া না করে পিষে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু এমপির বিরুদ্ধে। একইভাবে মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গাংনী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখল করার অভিযোগ উঠে।
এছাড়াও গত বছরের ডিসেম্বরে ইউপি নির্বাচনে বিভিন্ন স্থানে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে ভোট ক্রয়ের অভিযোগ উঠে। প্রার্থীরা রাতের আধারে ভোটারদের ঘরে ঘরে গিয়ে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এর চেয়েও বেশি অর্থ প্রদান করার খবর জনসম্মুখে আসে।
এমনও তথ্য উঠে এসেছে, ভোটাররা অর্থ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাদেরকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে । এতেই শেষ নয় পরবর্তীতে ভোটের আগের দিন রাতে দেখা যায় প্রার্থীর লোকেরা ভোট কেন্দ্রের কর্মরত পুলিশ ও প্রিজারডিং অফিসারদের সাথে অর্থের বিনিময়ে সমযোতার মাধ্যমে কেন্দ্রকে নেজের আয়ত্তে নেওয়ার ঘটনা ঘটে । এভাবেই ঘটছে এলাকার দখলদারিত্ব । এই চিত্রটি মোটামুটি দেশের প্রতিটি এলাকার ঘটনা । তুলনামূলক ভাবে এশিয়ার দেশ গুলোতে সাধারণত এধরণের ঘটনা বেশি হয়ে থাকে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ইভিএম এর ব্যবহারে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে এই অঞ্চলে।
ইভেএম হলো কাগজের পরিবর্তে টেকনোলজি নির্ভর ভোটিং সিস্টেম যার ফলে একজন ভোটার নির্ভয়ে তার ভোট দিতে পারে। যেখানে একজন ভোটার একাধিকবার ভোট দিতে পারেনা। ভোটারকে জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বার দিয়ে সনাক্ত করা হয় । ইভিএম সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্টে চালু হয় । চালু হওয়ার পরবর্তি ৪ বছরের মধ্যে সে দেশের ৭ টি অঙ্গরাজ্যে এর ব্যবহার চালু করা হয় এবং পরবর্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর ব্যবহার চালু হয় ।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ১৯৯০ সালে ইভিএম এর ব্যবহার শুরু হয়। যার পিছনের কিছু গরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল যার মধ্যে ছিল ভারতে ১৯৫০ সালের পর থেকে ভোটের কারচুপি ব্যপক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ভোট কেন্দ্র গুলোতে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভোটের আগের রাতে গণহারে জাল ভোট পরতে থাকা যার ফলে ক্ষমতাসীন দল গুলোর হাতেই ক্ষমতা কুক্ষিগত থেকে যায়। এর ফলস্বরূপ ১৯৯০ সালের দিকে তৎকালিন ভারতের নির্বাচন কমিশনার “টি এন সশান” এই ইভিএম পদ্ধতি চালু করার উদ্দ্যেগ গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ইভেএম চালু করা হয় ২০০৭ সালে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে। বুয়েটের আইআইসিটি বিভাগের প্রধান ডঃ এস এম লুৎফুর কবির এর উদ্দ্যেগে পাইল্যাব নামক কোম্পনির সহোযোগিতায় ইভিএম তৈরীর প্রকল্পে হাত দেয়া হয় । প্রথম বারের কোন স্থানীয় নির্বাচনে ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরীক্ষামূলক ভাবে নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বে ১৪ টি কেন্দ্রে এর ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় যান্ত্রিক ক্রটি দেখা যায় কিন্তু কোন সমাধান বের করতে না পারায় সারে ১২’শ ইভিএম বাতিল ঘোষণা করা হয় । পরবর্তীতে কে এম নূরুল হুদার তৎত্বাবধানে বিদেশ থেকে উন্নত মানের ইভিএম আনা হয় । এবং ২০১৭ সালে আবার রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এর ব্যবহার শুরু করা হয় ।
সর্বশেষ গত ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও চিরাচরিত প্রথায় আকাঙ্খা উদ্দীপনার পরিপূর্ণতা ছিল। ইভিএম পদ্ধতিতে মোট ২৭ টি ওয়ার্ডের ১০৫ টি কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হয়েছে। তবে সরাসরি ভোটের কারচুপির ঘটনা না ঘটলেও বিভিন্ন প্রার্থীর বিরুদ্ধে অর্থ প্রদানের মাধ্যমে ভোট কেনার অভিযোগ আসে। নির্বাচনের প্রচারণা শেষ হলে মঙ্গলবার (১৪ জুন) আলাদা আলাদাভাবে সংবাদ সম্মেলন করেন মেয়র প্রার্থীরা। এসময় ভোটের মাঠে নানাভাবে টাকা ছড়ানোর অভিযোগ করেন তারা। এমনকি শুধু ভোটারদের মাঝেই নয়, প্রশাসনের মাঝেও টাকা ছড়ানোর অভিযোগ প্রার্থীদের!
এছাড়াও ভোটের আগে গত ১৩ জুন সকালের দিকে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী এলাকা দক্ষিণ চর্থার স্থানীয় নাগরিকদের সাথে অর্থ লেনদেনের বিষয়ে খোঁজ নিলে নাম প্রকাশ করতে অনাগ্রহী একজন ভোটার জানান, অন্যান্য বারের ন্যায় ভোটারদের বাড়িতে গিয়ে তাদের কাছে টাকা পৌছানো হয়েছে।এমনকি একাধিক বার টাকা পৌছানোর ঘটনাও ঘটেছে। এতে ভোট না দিলে হুমকি শুনতে হয়েছে অনেককে।
ফলস্বরূপ অসচেতন ভোটাররা এই অর্থের বিনিময়ে তাদের ভোট বিক্রি করতে কোন দ্বিধা করেনি। আবার কিছু ভোটার অনেকটা নিরূপায় হয়েই তাদের অপছন্দ ব্যক্তিকে ভোট দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে তারা সৎ ব্যাক্তিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করাকে দায়ী করেন। আবার কিছু যায়গায় সৎ লোকদের উপস্থিতি থাকলেও ভোট ক্রয়ের প্রবণতায় তারা নির্বাচিত হতে পারেননি।
তবে পরিতাপের বিষয় হল, যেসকল ভোটাররা অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচিত করেছেন তারা মূলত স্থানীয় উন্নয়নে নিজেদেরকে প্রতিবন্ধক হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন। ২০২১-২২ অর্থবছরে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নে ৪৮৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবিত হয়েছিল। প্রতি বছর এমন বড় অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ হলেও অদক্ষতা এবং উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবে সেটি জনকল্যাণে পুরোপুরি খরচ হয়না। আবার মোট বরাদ্দের যে অংশটুকু ব্যায় হয় সেটিও জনগণের অবস্থার তেমন পরিবর্তন বয়ে আনতে দেখা যায় না।
পক্ষান্তরে অসাধু উপায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ব্যায়কৃত অর্থ একই পন্থায় বরং আত্ন উপার্জনের পথ সুগম করতে পারে। কারন একজন জনপ্রতিনিধি যদি অসাধু উপায়ে নির্বাচিত হন তাহলে তিনি জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে উৎসাহ খুজে পায় না। বরং ব্যাক্তি উন্নয়নে প্রতিনিধিত্বের জায়গাটিকে ব্যাবহার করে থাকেন। কাজেই এই দুর্ভোগ কমিয়ে আনতে হলে জনগনের সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। প্রয়োজন নতুনভাবে উদ্যোগ গ্রহন করা।
লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।