28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

নবীন শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক ‘র‍্যাগিং’

Must read

নাঈমুর রহমান রিজভীঃ


বিশ্ববিদ্যালয় একটি মুক্তজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র। মুক্তজ্ঞান, মুক্তচিন্তা ও গবেষণার জন্য একজন শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। এখানে এসে একজন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু  সেই উচ্চ শিক্ষার পথ যদি হয় কণ্টকাকীর্ণ তাহলে সেখানে ভীতি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। বলছিলাম র‍্যাগিং নামক অপসংস্কৃতির কথা। যেখানে সিনিয়র কর্তৃক  জুনিয়রকে সংস্কৃতি, ম্যানার সেখানো এবং সখ্যতা গড়ে দেবার নামে বিভিন্নভাবে হয়রানি এবং মানহানি করা হয়। বাংলাদেশের প্রায় সকল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই প্রথা দেখা যায়। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে সেটি আমরা দেখতে পাই।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতির সাথে র‍্যাগিং শব্দটি ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত।  বর্তমানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র‍্যাগিং শব্দটি নেতিবাচক দৃষ্টিতে বেশ পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন জেলা থেকে আসার কারণে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বুঝতে সময়ের প্রয়োজন হয়। ফলে অজপাড়াগাঁয়ের এসকল শিক্ষার্থীদের মাঝে জড়তা কাজ করে একইসাথে থাকে নতুনত্বকে গ্রহণ করার দূর্বলতা। ঠিক এ মূহুর্তে তাদের জন্য দরকার সিনিয়রদের সাপোর্ট, সাহায্য, পরামর্শ এবং বন্ধুসুলভ আচরণ। কিন্তু এখানে যদি যুক্ত হয় অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনা, বিশেষত হয়রানি এবং অসহনশীল আচরন তবে শিক্ষার্থীরা যে মনস্তাত্বিক ভাবে ভয়াবহ চাপের মুখোমুখি হবে এটা সকলের বোধগম্য।  আর এই ভয় থেকেই বিঘ্নিত হয় শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ। যার বিরূপ প্রভাব পড়ে একজন শিক্ষার্থীর পরবর্তী জীবন পর্যন্ত।

আভিধানিক অর্থে র‍্যাগিং বলতে পরিচয়পর্ব, তিরস্কার করা এবং বর্বর আচরণ করাকে বুঝায়। যদিও প্রাথমিকভাবে র‍্যাগিং বা র‍্যাগ শব্দদ্বয়ের অর্থ হলো আনন্দ, উল্লাস করা। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাগিং এর দিকে দৃষ্টি দিলে বুঝা যাবে র‍্যাগিং আসলে কি। এখানে প্রথমত চোখে পড়ে পরিচিত হওয়া, কবিতা আবৃত্তি, গান গাওয়া,নৃত্য করানো, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন,  সিনিয়রদের প্রপোজ করাসহ বিভিন্ন শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন।

র‍্যাগিংয়ের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের মনে করতে হবে মহাভারতের দূত সভার কথা। যেখানে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির যখন পাশা খেলায় হেরে যান তখন দ্রৌপদীকেও সভায়  হেনস্তা করার নির্দেশ দেয় প্রথম কৌরব দুর্যোধন। প্রবল ক্রোধ নিয়ে কৌরব দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে উদ্যত হয়। তখন স্বয়ং কৃষ্ণ রক্ষক হয়ে দৈববলে দ্রৌপদীর সম্ভ্রম রক্ষা করেন। মহাভারতের যুগ অস্ত গেলেও সেই প্রথা ঢুকে পড়েছে শিক্ষাঙ্গনে। মহাভারতে যা ছিলো দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ আধুনিক কালে সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাগত শিক্ষার্থীদের র‍্যাগিং বা ছিন্নবস্ত্রকরণের নবরূপায়ন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলেও রয়েছে র‍্যাগিং সংস্কৃতির ভয়াবহতা। সিনিয়ররা মনে করেন জুনিয়রদের সাথে সখ্যতা তৈরি করার জন্য এবং আচরণ শেখানোর জন্য র‍্যাগিং অন্যতম মাধ্যম। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা, চড় থাপ্পড় দেওয়া, সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দেওয়া, ভবনের সিড়ি দিয়ে হাটানো এবং রাতে হল থেকে বের করে দেওয়ার মত অবর্ননীয় নানা ঘটনা।

এছাড়াও র‍্যাগিংয়ের মাধ্যমে মূলত প্রথম বর্ষের ছাত্রদের সবক দেওয়া হয়ে থাকে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়রদের সালাম দিতে হবে, সমীহ করতে হবে। পাশাপাশি নবাগত শিক্ষার্থীর ফেসবুকে প্রকাশিত কোনো মন্তব্য যদি প্রভাবশালী সিনিয়রদের পছন্দ না হয়, তাহলেও তাকে আবার নতুন কায়দায় হয়রানির শিকার হতে হয়।

উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ভুক্তভোগী এসকল শিক্ষার্থীরা যখন বিভিন্ন অপবাদ মাথায় নিয়ে এবং হয়রানির শিকার হয়ে ক্যাম্পাসে কিছুদিন পার করেন, তখন তাদের মাঝেও নতুন জুনিয়রদের র‍্যাগ দেওয়ার একটা দৃঢ় প্রবণতা তৈরী হয়। এই প্রবণতা যেন এক পৈশাচিক আনন্দের। কখন আসবে সেদিন, কখন আসবে সেই নবীনরা।

আরেকটি দিক হলো সকল স্তরের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর নির্যাতনের কথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানাতেও ভয় পান৷ কারন ম্যানার সেখানো এসকল প্রভাবশালী সিনিয়ররা যদি ঘটনার লাগাম পান তাহলে একইসাথে ভুক্তভোগীর হলের সিট নামক শেষ সম্বলটুকু হারানোর আশঙ্কা তীব্রতর হয়ে ওঠে।

প্রকৃতপক্ষে র‍্যাগিংয়ের কারণে ব্যাহত হয় শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ। এর প্রভাবে অনেক শিক্ষার্থীরা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেওয়ার মতো বড় সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন র‍্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে যারা র‍্যাগিংয়ের সাথে জড়িত থাকেন তাদের সঙ্গে পেরে ওঠে না। কাজেই, শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ রক্ষা এবং প্রতিটি নবীন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণে আমাদের সকলের সচেতনতাই একমাত্র উপশম হতে পারে।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article