28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

দক্ষ যুবকরাই দেশ গড়ার মুল কারিগর

Must read

তানভীর হোসাইন

দেশীয় উন্নয়নে মূল চালিকাশক্তি যুবক। আরও ভালোভাবে বললে দক্ষ যুবক। যারা একটি দেশের উন্নয়নের মূলধারায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে সক্ষম। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে “Morning shows the day” উষা লগ্নই দিবসের প্রতিচ্ছবি। একটা দেশ কোথায় গিয়ে দাড়াবে তা সে দেশের যুবকদের অবস্থা বিবেচনা করলেই উপলদ্ধি করা যায়। যুবকরা দক্ষতার মানদন্ডে পিছিয়ে গেলে সংখ্যায় তারা বেশি হলেও তা আসলে দিনশেষে হতাশার দিকেই যুবকদের, দেশকে ঠেলে দেবে।

 বাংলাদেশে যুব উন্নয়ন নীতি ২০১৭ অনুসারে যুবকদের বয়স সীমা ১৫ বছর থেকে ৩৫ বছর। তারুণ্যের কীর্তি স্বরুপ আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে যে কয়েকটি আন্দোলন এরমধ্যে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবুল কাশেম এর নেতৃত্বে গঠিত হওয়া ‘তমুদ্দম মজলিস’ তারপর ১৯৪৮ সালে ‘রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এবং ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। এছাড়া ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালে লাহোর প্রস্তাব এর ভিত্তিতে ৬ দফা দাবি বাস্তবায়ন, ১৯৬৯ সালের গন অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী জাতি চুড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। স্বাধীনতা উত্তর তারুণ্যের সংগ্রামের মধ্যে ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও পরবর্তী কোটা সংস্কার আন্দোলন অনন্য। এটিকে তারুণ্যের অদম্য সাহসীকতার বিজয় হিসেবে নির্ণয় করা যেতে পারে।

এতো গেল তারুণ্যের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের কথা। পৃথিবীতে এমন অসংখ্য একক নেতৃত্বে বিপ্লবের কথা আমরা জানি। যাদের একক দৃঢ় সংকল্পে একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তাদের একজন ছিলেন, ইরানের বিপ্লবী নেতা যার মূল নাম রুহুল্লাহ মুসাবি আল খোমেনি। আয়াতুল্লাহ খোমেনি ও ইমাম খোমেনি নামেও তিনি অধিক পরিচিত। তিনি ১৯২৬ সালে শুরু হওয়া সেকুলারপন্থী রেজা শাহ পাহলবির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। শাহ পহলবি ইরানে হিজাব নিষিদ্ধ, জুমার খুতবা নিষিদ্ধ করা, দাড়ির উপর কর আরোপ করাসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল। ইমাম খোমেনি শাহ এর বিরুদ্ধতা করে তার মেধা ও যোগ্যতার মাধ্যমে একটি নিরস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন। যার ফল স্বরূপ ইরানের ২৫০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে ১৯৭৯ সালে। আর তার আন্দোলন এর প্রথম পদক্ষেপ ছিল ১৭ বছর বয়সে যুক্তিবিদ্যা ও ফিকহের জ্ঞান অর্জন এবং ১৮ বছর বয়সে কোমে (ধর্মীয় নগরী) গিয়ে তার ধর্মীয় বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে।

আবার আমরা যদি কিউবা বিপ্লবের দিকে লক্ষ করি তাহলে দেখব এ বিপ্লবের অন্যতম ব্যক্তি এর্নেস্তো চে গেভারা। ১৯২৮ সালে আর্জেন্টিনায় জন্ম নেওয়া এই নায়ক কিউবাকে একনায়কতন্ত্রের নেতা ফুলগেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করে কিউবায় বিপ্লব সৃষ্টি করেন। যার সহযোগি হিসেবে ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। আমরা যদি তার শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকে তাকাই দেখা যাবে তিনি একাধারে চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, কূটনীতিবিদ ও সামরিকতত্ত্ববিদ ছিলেন। এমন বহুমাত্রিক মেধার সমন্বয় তাকে বিপ্লব সাধনে সহযোগিতা করেছিল। ঠিক এমনি আমরা যেকোনো দেশের দিকে তাকাইনা কেন সকল দেশের উন্নতির পিছনে যারা ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মূল শক্তি সঞ্চারে যুবকদের যোগ্যতা এবং তাদের সম্মুখ ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। আর এই যোগ্যতা অর্জনের মোক্ষম সময় শিক্ষাজীবন।

এই শিক্ষাকে শক্তিতে রুপান্তরিত করার মাধ্যমে তারা দেশ ও জাতিকে নতুন কিছু উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আবার তাদের অনুসারীরা পুরো বিশ্বজুড়ে নতুন মডেল হিসেবে অনুসরণীয় হয়ে গেছেন। আমরা যদি সিঙ্গাপুরের দিকে তাকাই। যে দেশটিকে মালয়েশিয়ার ফেডারেশন থেকে ১৯৬৫ সালে বের করে দেয়ার মাধ্যমে স্বাধীন করে দেয়া হয়। দেশটি মাত্র ২৫ বছরে তাদের শিল্প খাতে, পর্যটনশিল্প, ও শিক্ষাখাতে চূড়ান্ত মডেল হিসাবে উপস্থাপিত হওয়ার পেছনে যে নায়কের ভূমিকা ছিল তিনি হলেন লি কুয়ান ইউ। যিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে ১ম শ্রেণিতে স্নাতক প্রাপ্ত। তিনি পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন সাধনে যে বিরাট ভূমিকা রেখিছিল সেটা হলো শিক্ষাগত যোগ্যতা । এভাবে একেকজন বিপ্লবী প্রথমে তার তারুণ্যে এবং ব্যক্তি জীবনে নিজেদেরকে অনন্য যোগ্যতায় পরিপূর্ণ করেছেন। তারপর সে যোগ্যতা ‍দিয়ে দেশ ও জাতিকে নতুন কিছু উপহার দিয়েছেন।

অপরদিকে আমরা যদি আমাদের সমাজের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব দেশের অধিকাংশ যুবক অলস জীবনযাপন করছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে বেকার সমস্যা। জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৮ লক্ষ মানুষ শ্রমবাজার নতুন করে যুক্ত হয় তার মধ্যে ৬ লক্ষ বিদেশে পাড়ি জমায়। প্রতি বছর ১০ লক্ষ্যের বেশি কর্মসংস্থান তৈরী হয় দেশের শ্রম বাজারে। কিন্তু বাংলাদেশে পরিসংখ্যা ব্যুরো (বি বি এস) এর ২০১৬-১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বি আই ডি এস) এর এক গবেষণায় দেখা গেছে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তোর ডিগ্রিধারী দের ৩৩ শতাংশের বেশি বেকার । এই বেকারত্বের পিছনে সবচেয়ে বড় কারন হিসেবে দক্ষতার অভাবকে দায়ী করা হচ্ছে।

আরেকটি জরিপ এ উঠে এসেছে, দেশে অশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা মাত্র ৩ লক্ষ কিন্তু শিক্ষিত বেকার ২৩ লক্ষ ৭৭ হাজার। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৪ লক্ষ ৫ হাজার। বলা যেতে পারে উচ্চশিক্ষিতদের মাঝে বেকারত্বের হার তূলনামূলক বেশি। যার মুল কারণ হলো অদক্ষতা। তবে দেশের সাক্ষরতার দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই ২০২১ সালে স্বাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ছিল ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

বর্তমানে সাক্ষরতার হার দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও সে অনুযায়ী বাড়ছে না কর্মস্থান এর ব্যবস্থা। সি আই এ (CIA) ফ্যাক্টবুক তথ্য অনুযায়ী ৭৭ দশমিক ৫ কোটি পূর্নবয়স্ক নিরক্ষর মানুষের প্রায় ৭৫ শতাংশ লোক মাত্র ১০ টি দেশে বাস করে। দেশগুলোর মধ্যে (ভারত, চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, মিশর, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া এবং গনতান্তিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র)। সারাবিশ্বে ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব সামগ্রিক জনসংখায় সাক্ষরতা হার ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ। পুরুষ ৮৮ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মহিলা ৭৯ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের মত নিম্ন আয়ের দেশ গুলোতে সাক্ষরতার হার বেশি হলেও সমানুপাতিক হারে বেকারত্ব রয়েছে।

তবে সমস্যা যতই গুরুতর হোক যেকোনো সমস্যাকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সমাধান সম্ভব। তবে তার জন্য কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মানতে হবে। কতগুলো সুনিপুণ সিদ্ধান্ত গ্রহন করা আবশ্যক। তাহলো- দক্ষতা অর্জনে তরুণদের ব্যক্তি উদ্যোগ বাড়ানো, সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহন ও সে অনুযায়ী নিজেকে তৈরি করা, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি, সরকার কর্তৃক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরী দক্ষতা বৃদ্ধি করা।

এসম্পর্কিত ”হার্বিসন ও মায়ার্স” এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে একজন মানুষের উন্নয়নের পিছনে তারা ৫ টি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন।

প্রথমত, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা- এখানে প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে বুঝানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কর্মকালীন প্রশিক্ষণ- ধারাবাহিক বা উপানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করা। তৃতীয়ত, আত্মোন্নয়ন- যেমন জ্ঞান, দক্ষতা ও সামর্থ্যের উন্নয়ন যা ব্যক্তি তার নিজের চেষ্টাতে আনুষ্ঠানিক উপায়ে অথবা দূরশিক্ষন পদ্ধতিতে আনুষ্ঠানিক উপায়ে পড়ে বা অন্যের কাছ থেকে শিখে। একইসাথে নিজের আগ্রহ ও কৌতূহল অনুযায়ী ব্যাপক গুণগত মান, দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করা। চতুর্থত, স্বাস্থ্য উন্নয়ন- উন্নতর চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং গণস্বাস্থ্য কার্যক্রমের মাধ্যমে কর্মরত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য উন্নয়ন। এবং সর্বশেষ, পুষ্টি উন্নয়ন- পুষ্টি মানুষের কার্য দক্ষতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে মানুষ অধিক সময় ধরে কাজ করতে পারে এবং তার কর্মজীবন দীর্ঘ হয়।

তথ্যসূত্র- 

যুব উন্নয়ন নীতি ২০১৭, রুহুল্লাহ খোমেনি- উইকিপিডিয়া, চে গেভেরা- উইকিপিডিয়া, সিঙ্গাপুর উন্নয়ন গল্প ও বাংলাদেশ, অয়ন দেবনাথ, বাংলা ইনসাইডার,(৯ আগস্ট ২০১৭), সাক্ষরতার হার অনুযায়ী রাষ্ট্রের তালিকা, সাক্ষরতা উইকিপিডিয়া, বেকারত্বের বড় কারন দক্ষতার অভাব, সমকাল,রূশিদান ইসলাম রহমান, (৮ জানুয়ারি ২০২০), উচ্চশিক্ষিত বেকার : প্রধান অভাব দক্ষতা, জান্নাতুল নাইম পায়েল,(৩০জুন২০২০)।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article