আহমেদ ইউসুফ আকাশ
ঘড়ির দুটি কাটা রয়েছে যার সাথে তিনটি ঘণ্টা আছে যাদের ওজন যথাক্রমে ৮০ মণ, ৪০ মণ ও ৩০ মণ। ছোট ঘণ্টাটি ১৫ মিনিট অন্তর ব্যবধানে বাজে এবং আরও বড় বেলটি এক ঘণ্টা বোঝাতে বাজে। ঘড়ির কাটা আধ ঘণ্টা এগিয়ে নিতে প্রতি সপ্তাহে দুজন লোকের প্রয়োজন হয়, ঘড়ির চাবিটির ওজন ২০ কেজি। ১৮৫২ সালে এটি ১১,৭২১ টাকায় কেনা হয়েছিল।
এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সাথে যে নামটি জড়িয়ে সেটি হল হাজি মহম্মদ মহসিন, যার খ্যাতি ভারতীয় উপমহাদেশসহ সভ্য পৃথিবীতে সমাদৃত। একজন দানবীর মহসিন সর্বদা সম্পদের মোহ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন। একইসাথে পিতা এবং একমাত্র বোন মুন্নুজান থেকে যে পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছিলেন সেটুকু সম্পুর্ণ বিলিয়ে মানবসেবার কল্যানে অবদান রাখতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেননি। একইসাথে জাতধর্মকে পেছনে রেখে সবার জন্য উন্মুক্ত সুবিধা প্রদান করে অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন হাজী মহম্মদ মহসিন। আমরা জানি, প্রথম বাঙালি গ্র্যাজুয়েট ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আর বাঙালি মুসলমানের মধ্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েট ছিলেন দিলওয়ার হোসেন) এঁরা দুজনই ছিলেন হুগলি মুহসীন কলেজের ছাত্র। ছাত্রজীবনে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য তাঁরা দুজনই মুহসীন ফান্ডের বৃত্তি পেয়েছিলেন।
হাজী মহম্মদ মহসীন সম্পর্কে ইতিহাস থেকে জানা যায়, ‘দি মহসিন এনডাউমেন্ট অ্যান্ড দ্যা প্রোসেস অফ এডুকেশন ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল’ গ্রন্থে কলকাতা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমজাদ হোসেন লিখেছেন, সতেরোশো শতকের মাঝামাঝি মুহসীনের পিতামহ আগা ফজলুল্লাহ তার তরুণ পুত্র ফয়জুল্লাহকে নিয়ে ইরান থেকে বাণিজ্য করতে এসে মুর্শিদাবাদে বসবাস করতে শুরু করেন।
কিছুদিন পরে তিনি হুগলির বাণিজ্যিক গুরুত্ব বুঝতে পেরে ছেলেকে মুর্শিদাবাদের দায়িত্ব দিয়ে হুগলিতে চলে আসেন। ব্যবসা বেড়ে যাওয়ায় তিনি পরবর্তীতে ছেলেকেও হুগলিতে নিয়ে আসেন। প্রায় একই সময় দিল্লির মুঘল দরবার থেকে হুগলিতে আসেন আগা মুহাম্মদ মোতাহার। তিনিও পারস্য থেকে এসেছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ইতিহাসের বইগুলোতে। হাজী ফয়জুল্লাহ তার বোনের ছেলে ছিল বলে একাধিক বইতে উল্লেখ করা হয়েছে।
অধ্যাপক আমজাদ হোসেন আরও লিখেছেন, বাদশাহ আওরঙ্গজেব তার বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতায় খুশি হয়ে তাকে এই অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। সেই সময় তাকে জমিদারিও দেয়া হয়। রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি লবণ ব্যবসার মতো নানা খাতে বিনিয়োগ করে অনেক সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন আগা মোতাহার।
তার তিনজন স্ত্রী থাকলেও কোন পুত্র সন্তান ছিল না। আগা মোতাহার যখন মারা যান, তখন তার স্ত্রী জয়নাব খাতুনের গর্ভে জন্ম নেয়া সাতবছর বয়সী একটি মেয়ে ছিল, মরিয়ম খাতুন ওরফে মুন্নুজান। আগা মোতাহার তার সমস্ত সম্পত্তি মেয়ের নামে দিয়ে যান। আগা মোতাহার মারা যাওয়ার পর জয়নাব খাতুনকে বিয়ে করেন হাজী ফয়জুল্লাহ। সেই ঘরেই জন্ম হয় মুহম্মদ মুহসীনের।
নিজের সকল সম্পত্তি দান করা, শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারে ব্যয় করার জন্য এই অঞ্চলে ‘দানবীর’ হিসাবে খ্যাতি পেয়েছেন হাজী মুহাম্মদ মুহসীন। অকৃতদার, অবৈষয়িক মুহসীন তার জীবনে বহু দেশ ঘুরেছেন। জীবন সম্পর্কে তার গড়ে উঠেছিল আলাদা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি। বাঙালি শিক্ষাবিদ, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ১৮ শতকের সেরা বাঙালি সন্তানদের অন্যতম বলেছিলেন।
হাজী মুহাম্মদ মহসিন ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার একজন প্রখ্যাত মুসলিম জনহিতৈষী, ধার্মিক, উদার ও জ্ঞানী ব্যক্তি। যিনি তাঁর নিজের দানশীলতার মহৎ গুণাবলীর জন্য দানবীর খেতাব পেয়েছিলেন। বিরাট এক এলাকায় ৪২ বিঘা জায়গার ওপর নির্মিত ইমামবাড়া স্থাপনাটি। এটি নির্মাণে খরচ হয়েছিল দুই লাখ ১৭ হাজার টাকা। নির্মাতা ছিলেন কেরামত আলী নামের এক বিখ্যাত প্রকৌশলী। দক্ষ নির্মাণশৈলী এবং ভিন্নতার কারনে ইমামবাড়া এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। সাথে হুগলী ইমামবাড়া বিখ্যাত মূলত বিশালাকৃতির ঘড়ির জন্য। সেই ১৮৪১ সাল থেকে ঘণ্টা বেজে চলেছে অনবরত। ইসলামি শিল্পকলার
আর ওই মিনারের সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় যখন ঘণ্টাটা বেজে উঠবে, তখন যেন মনে হবে সেই ঘড়িতে নয়, ঘণ্টাটা বাজছে একেবারে হৃদয়ের মধ্যে।
তবে ইমামবাড়ার পেছনে যাওয়ার পরে পর্যটকদের নিকট নতুন চমকে হল সূর্যঘড়ি। সামনের এলাকাবাসীর জন্য দেয়ালে ঘড়ি লাগিয়েছিলেন দানবীর। আর পেছনের মানুষের জন্য তৈরি করেছিলেন একই সময়ে এই বিশাল সূর্যঘড়ি। ইমামবাড়ার পেছনেই গঙ্গা। সে নদীর কিনারে এই সূর্যঘড়ি। ইট, বালু, সিমেন্টের একটি স্তম্ভ। স্তম্ভের ওপরেই সিমেন্টের পাত। সাদা সেই পাতের ওপর একটি ঘড়ির আদল দেওয়া আছে। ডায়ালগুলো কালো কালি দিয়ে দাগ কাটা। মাঝখানে ত্রিভুজাকৃতির দণ্ড। সেটির ওপর সূর্যের আলো এসে পড়ে। ফলে দণ্ডের ছায়া পড়ে ডায়ালের ওপর। ডায়াল সব রোমান হরফের। চাঁদের আলো সময় জানায়, সূর্যের আলোও। কেবল অমাবস্যার রাতে অচল থাকে সূর্যঘড়ি, আকাশ একেবারে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেও সময়ঘড়ি চলে না। অর্থাৎ সূর্যের আলোর সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় এটিকে সূর্যঘড়ি হিসাবে নামকরণ করা হয়।
১৭৬৯-৭০ সালের সরকারি দলিল অনুযায়ী তৎকালীন দুর্ভিক্ষের সময় তিনি অনেক লঙ্গরখানা স্থাপন করেন এবং সরকারি তহবিলে অর্থ সহায়তা প্রদান করেন। ১৮০৬ সালে তিনি ‘মহসিন ফান্ড নামক তহবিল প্রতিষ্ঠা করেন। এ তহবিল ধর্মীয় কর্মকাণ্ড, পেনশন, বৃত্তি ও দাতব্য কর্মকাণ্ডের জন্য বরাদ্দ করা হয়।
১৮১২ সালে এ ধার্মিক দানবীর হুগলিতে ইন্তেকাল করেন। তাকে হুগলির ইমামবাড়ায় দাফন করা হয়। ইতিহাসে দাতা হাজী মুহাম্মদ মহসিনের নাম চিরস্মরণীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের নাম তার স্মরণে রাখা হয়েছে। এছাড়াও মহসিন ফান্ডের অর্থে অসংখ্য দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাটির নাম বিএনএস হাজী মহসিন।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।