আমার প্রাথমিক শিক্ষা জীবন সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে। মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য খিলগাঁও গভর্মেন্ট স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই। বাবার ইচ্ছাতে সে সময়ের সবথেকে স্বণামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গভর্ণমেন্ট ল্যাবরেটরী স্কুলএ ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হই। এবছর আমার মা মারা যাওয়ায় লেখাপড়া করা হয়ে ওঠেনি। স্কুল থেকেও তাই নাম কেটে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এস.এস.সি পাশ করে ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই। কলেজে আমার বাংলা শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক আবূ সায়্যিদ কিন্তু সে সময়ে তার সাথে আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় নি।
আমি কলেজ সময় থেকেই লেখালিখির সাথে যুক্ত ছিলাম, আমার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায়; আমি সেখানে প্রস্তাব করেছিলাম ১ বছর দেশের সকল স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে। কারণ এ সময়ে দেশের সকল যুবকদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দেশপ্রেমের একটি উদ্মাদনা ছিল, আমার ইচ্ছা ছিল একবছর দেশের মৌলিক চাহিদা মেটাতে সবাই কাজ করুক। ১৯৭৪ সালে দূর্ভিক্ষ কবলিত মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে সিরিজ লেখা লিখেছিলাম শিরোনাম ছিল ‘আপনারা কেমন আছেন? আমার লেখা লিখির সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্বেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক আমাকে নামে চিনতেন। তার বিভাগে ভর্তি হওয়ায় অল্প সময়েই তার সাথে আমার একটি আস্থা ও বিশ্বাসের মিথস্ক্রিয়ায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমর প্রিয় শিক্ষক ছিলেন মির্জা মোজাম্মেল হক। তার দেশের বাড়ি ময়মানসিংহ জেলার কোতয়ালী থানার পোনঘাঘরা গ্রামে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে তিনি অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তার বড় পরিচয় তিনি একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক। উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য তিনি যখন ইংল্যান্ড গমন করেন ঠিক সে মুহুর্তে দেশে সংগঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধ। উচ্চতর গবেষণা ব্যাতিরেখে মুক্তিযোদ্ধাদের ও দেশের ক্রান্তিকালে সহযোগিতার হাত বাড়াতে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন প্রবাসীদের দ্বারে দ্বারে। উচ্চতর/ডক্টরেট ডিগ্রী ছাড়াই দেশে ফিরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্যয় করেছেন শিক্ষা ও গবেষণায় জীবনের বাকি সময়।
অর্থশাস্ত্রের মধ্যে গাণিতিক ধারা, তাত্ত্বিক বিভিন্ন স্কুল ও মার্ক্সসীয় ধারায় তার জ্ঞানের পরিধি ছিল অনেক গভীরে। ১৯৭৬-৮০ সাল পর্যন্ত স্যারের সাথে আমার একটি দীর্ঘ জীবন কেটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে। শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর আমি ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তার সঙ্গ পেয়েছি। শিক্ষক হিসেবে তার যে দিকটি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে তা হলো; আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবনে আমি যে কয়জন শিক্ষকের ক্লাস আগ্রহ নিয়ে করেছি তাদের মধ্যে স্যারের ক্লাসে সবথেকে বেশি মনোযোগী ছিলাম। তিনি নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস নিতেন। প্রত্যেকটা ক্লাস নেওয়ার পূর্বে আলোচ্য বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে আসতেন। প্রত্যেকটা ক্লাস থাকত প্রাণবন্ত। শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপস্থিতি ছিল তার ক্লাসে। শিক্ষার্থীদেরকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন স্যার, কেউ যদি ক্লাসের সময়ের বাইরেও তার সাথে কোন বিষয় নিয়ে বুঝতে চাইত তাহলে কোন ধরনের বিরক্তভাব তো নয়ই বরং অনেক সময় তিনি ব্যয় করতেন শিক্ষার্থীদের বোঝাতে। শিক্ষার্থীদের টিউটোরিয়ালসহ পরীক্ষার খাতায় প্রত্যেকটি বাক্য পড়তেন এবং দিকনির্দেশনা মুলক কমেন্ট করতেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পরীক্ষার খাতা জমা দিতেন।
ক্লাসের শিক্ষকতার বাইরেও তার যে দিকটি আমাকে আকৃষ্ট করত তা হলো স্যারের সাথে আমার চিন্তার ঐক্য। আমি যখন আমার বন্ধুদের সাথে আলাপ করে একটি লাইব্রেরী করার চিন্তা করি তখন স্যারের কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি আমাদের একাজকে উৎসাহিত করতে এগিয়ে আসেন। স্যারের সহকর্মী ভূগোল বিভাগের শিক্ষক কলিমুল্লাহ কে তিনি লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠার সাথে সম্পৃক্ত করেন। আমরা চাঁদা সংগ্রহ করে যেদিন লাইব্রেরীর জন্য বই কিনতে যাবো ঠিক সেই দিন সকালে ভূগোল বিভাগের শিক্ষক কলিমুল্লাহ স্যার মারা যান। আমরা কোন ধরনের মতানৈক্য ছাড়াই তার নামে লাইব্রেরীর নামকরণ করি কলিমুল্লাহ লাইব্রেরী। লাইব্রেরী ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে আমরা রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পাঠচক্র করতাম। সেখানে স্যার প্রায় প্রতিটি পাঠচক্রেই উপস্থিত থাকতেন, বক্তৃতা করতেন এবং তার সাথে সখ্যতার কারণে আমাদের পাঠচক্রে উপস্থিত হতেন বাংলাদেশের অর্থনীতির জগতে যিনি প্রতিথযশা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক ড. আবূ মাহমুদ। আইয়ুব বিরোধী ভূমিকার কারণে হামলারও স্বীকার হয়েছিলেন তিনি। স্যার ক্যাম্পাসেই সার্বক্ষনিক অবস্থান করতেন। তিনি কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি কিন্তু তিনি লেখা লিখিতে, প্রকাশনায় সর্বদাই শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতেন।
আমার লেখার নিয়মিত পাঠক ছিলেন স্যার। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে সমালোচনা করে লেখা লিখতাম। এমনকি আমার নিজ বিভাগের নানা অসঙ্গতি ও ক্ষোভ নিয়েও প্রকাশনা বের করতাম। স্যার সেগুলো পড়তেন আর বলতেন তোমার ভবিষ্যাত খুব খারাপ তুমি যেভাবে লিখে চলছ তোমার বিপদ আছে আবার হেসে বলতেন তোমাকে দিয়ে শিক্ষকতা ছাড়া আর কিছুই হবে না। স্যারের যে দিকটি এখনো আমাকে একজন শিক্ষক হিসেবে অনুপ্রাণিত করে তা হলো তার সহজ সরল জীবন যাপন। ইংল্যান্ডে ডিগ্রীর জন্য গিয়েও দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে ডিগ্রী না নিয়ে ফিরে আসেন। তিনি ছিলেন সৎ, কর্মঠ এবং তার দায়িত্বের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমার লেখা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন কী অসম্ভব’ এটি আমি আমার তিন জন শিক্ষককে উৎসর্গ করি যার মধ্যে স্যার হচ্ছেন অন্যতম। অন্য দুজন হলেন আখলাকুর রহমান ও আবূ মাহমুদ। স্যার ২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
অণুলিখন-মুতাসিম বিল্লাহ নাসির