28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

পশ্চিমা বিশ্ব শিশুদের যেভাবে শেখায়

Must read

মোঃ মেজবাহুল হক, বোলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালিঃ

ইতালির বলনিয়া শহরের অদূরে, শহুরে কোলাহল থেকে একটু আড়ালে গড়ে ওঠা একটা ব্যাতিক্রমধর্মী স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। ইতালিয়ান ভাষায় স্কুলের নাম “i passerotti” বাংলায় “চড়ুই পাখি”, একটা “আউটডোর স্কুল”। এই স্কুলের বৈশিষ্ট্য হল এখানে চার দেয়ালের মধ্যে কোন ক্লাস নেয়া হয় না। নির্দিষ্ট কোন সিলেবাসে এক্সাম নেয়া হয় না। যেমন খুশী তেমন কর স্কুল। অন্যান্য স্কুলের মত এটাও সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ১ থেকে ৬ বছর বয়সে যা যা করতে ভাল লাগে বা যা করতে ইচ্ছা করে সেসব করার সব উপকরণই আছে এখানে। এখানে কোন কিছু করাতে সাধারনত না বলা হয় না, ভাল মন্দ দুই দিক বলে দেয়াহয় তারপর তাকে পছন্দ করতে দেয়া হয় সে কোনটা চায়।

দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেলে নিজেরাই নিজেদের হেল্প করে উঠে দাড়াতে। মারামারিও যে করে না তানা, নিজেরাই আবার সরি বলে কোলাকুলি করে নেয়। একজন কান্না করলে ৩ জন ছুটে আসে থামাতে। মন চাইলে ফুটবল খেলে, মন চাইলে সাইকেল চালায়। মন চাইলে গাছে চড়ে। মন চাইলে মাটিতে গড়াগড়ি দেয়। মন চাইলে পানি নিয়ে খেলে। এরা স্কুল টাইমে সবজি চাষ করে। মুরগী পালে। এদের অভিভাবকরা তাদের অবসরে এসে তাদের সাথে কাজ করে। মনোবিজ্ঞানীরা খেয়াল করেছেন, “ছোট বাচ্চারা বাবা মায়ের আদেশ নিষেধ মুখে শোনার থেকে বাবা মাকে অনুসরণ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে”। আর সেকারনেই হয়তো এই ব্যবস্থা।

প্রতিদিন তারা ইশপ থেকে রুপকথা সবধরনের গল্পই পালা করে শোনে তাদের টিচারের থেকে। যার ছবি আঁকা ভাল লাগে সে ছবি আঁকে যার গান বাজনা ভাল লাগে সে সেটা করে। মনের মধ্যে থেকে প্রতিযোগিতা বা কাউকে নিচে ফেলে আমাকে এগিয়ে যেতে হবে, এই মনোভাব থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা চলে সবসময় এখানে। জুতার ফিতা খুলে গেলে দৌড়ে টিচারকে বলে বেঁধে দিতে, মন চাইলে দৌড়ে এসে টিচারকে জড়িয়ে ধরে বা চুমু দিয়ে আবার দৌড়, টিচার স্টুডেন্টের এই সম্পর্ক থেকেই “সম্পর্ক” এর মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়। প্রতিদিন নানা অ্যাক্টিভিটিস থাকে যেগুলো একা বা গ্রুপে করতে হয়। এখান থেকেই এরা নানা কিছু শেখে। বলা চলে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার হাতেখড়ি। এসব অভিভাবকরা চান প্রকৃতির সাথেই যেন বেড়ে ওঠে তাদের সন্তান। এরকম আরও অনেক বৈশিষ্ট্যই আছে এই স্কুলের।

স্কুল প্রধানের সাথে লেখক মেজবাহুল হক

এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা “স্টেফানিয়া”, তিনি জার্মানি থেকে এই এইধরনের স্কুলের কারিকুলাম নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করার পরে এই স্কুল চালান। তিনি বলেন, “সন্তানের সুস্থ ও সম্পূর্ণ বিকাশের জন্য প্রকৃতি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান! তাই আমরা চাই প্রকৃতির সাথেই হোক আমাদের পথচলা। প্রকৃতির মাঝেই শিশুরা অবলকন, প্রতিফলিত ও কল্পনা করতে শেখে। তারা শেখে অপেক্ষা করতে এবং যত্ন নিতে। এই স্কুলে আমরা বিশ্বাস করি খারাপ আবহাওয়া বলে কিছু নেই, সাময়িক কিছু কাপড় নোংরা হওয়া ছাড়া কোন কিছুই ভয়ঙ্কর নয়। বৃষ্টি বা রোদ, তুষার বা ঝড় বাতাস সবকিছু মোকাবেলা করার মত সামর্থ্য আমাদের থাকা উচিৎ। প্রকৃতির মাঝে থেকেই দায়িত্বশীল, সচেতন, বিবেকবান, স্নেহপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য হয়েই বেড়ে ওঠে, যেটা কিনা অনেক সময় বড়দেরকেও শিক্ষা দিয়ে থাকে”।

নরওয়ে, সুইডেন থেকে শুরু করে জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি সবখানেই এই আউটডোর স্কুলের কনসেপ্ট খুব দ্রুততার সাথে সমাদৃত হচ্ছে। শুধু ইউরোপ অ্যামেরিকা না, এমনকি জাপান, সিঙ্গাপুরেও ছোটদের জন্য নির্দিষ্ট সিলেবাসে এক্সাম ব্যবস্থা বন্ধ করে দিচ্ছে। মানুষকে মূল্যায়ন, সম্পর্ক গুলোকে অনুধাবন, মানবিকতা, সহনশীলতা বা শিষ্টাচার এগুলোর প্রতি তারা ছোট বয়স থেকেই যেন যত্নবান হয় সেটার উপর বেশি জোর দিচ্ছে।

অথচ আমাদের দেশে বর্তমানে “অতি সচেতন” এক অভিভাবক শ্রেণী তৈরি হয়েছে যারা সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়াবহ রকমের সিরিয়াস। দৌড়ালে পড়ে যাবে, রোদে গেলে বা বৃষ্টিতে ভিজলে অসুস্থ হবে, এইটুকুন বয়সে ১০ ঘণ্টা না পড়লে বা ৪/৫ টা টিউটর না দিলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার, এরকম তুলুতুলু করা নিয়ে ব্যস্ত। তার উপর আবার যোগ হয়েছে স্মার্ট ফোন বা ট্যাবের আদিখ্যেতা। স্মার্টফোনে গেম খেলতে না দিলে বা ভিনদেশী ভাষার কার্টুন না দেখতে দিলে খায় না । শহুরে জীবন আর ইন্টারনেট এর প্রভাব পরের প্রজন্মকে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত করে বেড়ে তুলবে। প্রযুক্তির এই যথেচ্ছ ব্যাবহার খারাপ বৈ ভাল কিছু বয়ে আনবে না।

আমার আফসোস হয় এই ভিডিও গেমস আর নানা আদিখ্যেতার চাপে এরা চাঁদমামা, চাঁদের বুড়ির খোঁজ পাবে না কখনো।

রাজার কুমার, কোটাল কুমার, পঙ্খীরাজ ঘোড়ার কথা জানবে না কখনো। কাজলা দিদির কথা শুনবে না, জোনাকি পোকাও কখনো দেখবে না। আলাদিন আর জাদুর জীনি বা আলীবাবা চল্লিশ চোরের গল্প শুনবে না কখনো। বৃষ্টিতে ভিজে কাদামাটির গন্ধ পাবে না কখনো। পুকুরে বা নদীতে পা দাপিয়ে সাঁতরানোর আনন্দ পাবে না কখনো। জ্যৈষ্ঠ মাসে আম কুড়ানোর মজা পাবে না কখনো। গ্রামের মেলায় হাওয়াই মিঠাই এর স্বাদ পাবে না কখনো।

আমার খুব প্রিয় নচিকেতার একটা গানের লিরিক্স দিয়ে শেষ করি-

“ভিড় করে ইমারত আকাশটা ঢেকে দিয়ে

চুরি করে নিয়ে যায় বিকেলের সোনারোদ

ছোট ছোট শিশুদের শৈশব চুরি করে গ্রন্থ কীটের দল বানায় নির্বোধ।”

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article