মুতাসিম বিল্লাহ, শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়|
হেরোডোটাস, থুকিডাইডিস, পলিবিয়াস, লিভি কিংবা টেসিটাস এর মতো ঐতিহাসিকরা না থাকায় আমাদের ইতিহাসের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। তবুও তো জানতে হবে অতীত। সরাসরি যখন তথ্য পাওয়া যায় না তখন অতীত চর্চায় মনোযোগী হতে প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিকল্প পথে হাটার চেষ্টা করেন। চেষ্টা করেন বস্তুকে বাকশক্তি দেওয়ার। প্রত্নতাত্ত্বিকরা যে সূত্রগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে অতীত খোঁজার চেষ্টা করেন তার মধ্যে মুদ্রা অন্যতম।
মুদ্রা থেকে আমরা যে তথ্যগুলো পেয়ে থাকি তার মধ্যে অন্যতম হলো- কিভাবে মুদ্রা তৈরি হয়েছিলো? এর গঠন, আকার, অবয়ব, ওজন, নকশা, এর প্রস্তুত পদ্ধতি, মুদ্রা প্রচলনের সময়কাল, এর ধাতব মূল্য। একটু গভীরে নজর দিলে মুদ্রা থেকে আমরা আরও জানতে পারি একটি নির্দিষ্ট সময়ের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে। মুদ্রাতাত্ত্বিক জ্ঞান আমাদের প্রচলিত ইতিহাসকেও সত্যয়ন করে।

বাংলাদেশে প্রাচীন কালের অনেকগুলো মুদ্রা আবিস্কার হয়েছে। মহাস্থানগড় থেকে ছাপাঙ্কিত মুদ্রা, কপার কাস্ট মুদ্রা, কুষান মুদ্রা আবিষ্কার হয়েছে। উয়ারী বটেশ্বর থেকে, নওগার মান্ডা উপজেলার ফেতগ্রাম থেকে, রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বাইগাছা থেকে পাওয়া গেছে ছাপাঙ্কিত মুদ্রা। কুমিল্লার ময়নামতি থেকে পাওয়া গেছে গুপ্ত মুদ্রা, গুপ্তোত্তর মুদ্রা, হরিকেল মুদ্রা, ময়নামতি স্বর্নমুদ্রা। সাভারের হরিশচন্দ্র রাজার ঢিবি থেকে পাওয়া গেছে গুপ্তত্তর মুদ্রা।যশোরের মুহাম্মদপুর থেকে পাওয়া গেছে গুপ্ত মুদ্রা, কোটালিপাড়া থেকে পাওয়া গেছে গুপ্ত মুদ্রা। ফরিদপুরের গোয়াখোলা থেকে পাওয়া গেছে গুপ্ত মুদ্রা, পাহাড়পুর থেকে পাওয়া গেছে পাল আমলের মুদ্রা; যদিও এটা নিয়ে সংশয় আছে।
মুদ্রা তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল ও তাতে খাদের পরিমাণ অতীত আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে আমাদের জানান দেয়। ইন্ডিয়াতে যে ছাপাঙ্কিত মুদ্রা তৈরি করা হতো তা মুলত রৌপ্য, তামা ও স্বর্ণের ছিলো। স্বর্ণ দিয়ে মুদ্রা তৈরি করার কথা আমরা জানতে পারি অষ্টধ্যায়ী, জাতক ও মহাভাষ্য বর্ণিত বিবরণ থেকে। আমরা প্রাচীন স্বর্ণমুদ্রা প্রাপ্তির কথা জানতে পারি জে. অ্যালেন, ডি উপাধ্যায়া এবং এসএন চতুর্ভেদি, এস এম দেভি, এ এলবাশামু এর লেখা থেকে।

যদিও বিবরণে থাকলেও এসব মুদ্রার দেখা এখন বাস্তবে মেলে না।আমরা কুষাণ যুগের আগে তেমন কোনো স্বর্ণ মুদ্রা পাইনা। ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রার চেয়ে, ছাপাঙ্কিত তাম্রমুদ্রা আমরা কম পেয়ে থাকি। আমরা বেশকিছু ছাপাঙ্কিত তাম্রমুদ্রা পেয়ে থাকি রাজস্থানের নাগরি, রাইর, ইসমাঈলকি ডোঙ্গারি, নাগার, নোহ, আহার এবং পাণ্ডুসার থেকে। মহারাষ্ট্রের কাউনদিনইয়াপুর বিহার এর মাধিপুর মধ্যপ্রদেশ এর উজ্জাইন এবং বিধিশা পশ্চিম বাংলার চন্দ্রকেতুগড়, দেউলপোতা, মঙ্গলকোট এবং দিহার থেকে।
তামার আকরিক পাওয়া যায় বিহার, রাজস্থান এবং ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। ছাপাঙ্কিত তাম্রমুদ্রা প্রস্তুতকারি সম্ভবত মুদ্রা তৈরির জন্য স্থানীয় উৎসসমূহ থেকে তামার আকরিক সংগ্রহ করতো। প্রাথমিকভাবে ছাপাঙ্কিত মুদ্রা পাই রৌপ্য থেকে যা সারা ভারতজুড়ে বিস্তৃত ছিলো। তবে কাঁচামাল হিসাবে রৌপ্য ভারতবর্ষে তেমন একটা পাওয়া যেতোনা। তবে অল্পকিছু রুপা পাওয়া যেত আকরিক গ্যালেনা (লেড, সালফাইড) নামক খনিজ ও এর খাদ হিসেবে সীসার আকরিক ব্যবহৃত হতো। প্লিনি তার লেখায় আমাদেরকে জানিয়েছেন যে মোনসকাপিতালি (রাজস্থানের আরাবল্লী অঞ্চলের আবুপবর্ত)ও হিমাচল প্রদেশের কলু অঞ্চলের সেতাই নামক স্থানের খনি থেকে রৌপ্য সংগ্রহ করার কথা উল্লেখ করেছেন।
এছাড়া প্রাচীন ভারতের আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস থেকে গ্যালেনা পাওয়া যেত তাহলো উত্তর প্রদেশের বেলারী জেলার মৈত্রী এবং রাজস্থানের উদয়পুর জেলার জাওয়ার। এছাড়াও অল্প পরিমান রৌপ্য সংগ্রহ করা হয়েছে উড়িষ্যা এবং বিহারের বেহেরাকি এবং সান্তালপরগনার লক্ষীপুর থেকে। আদি ঐতিহাসিক ভারতে রৌপ্যের উৎস হিসাবে অর্থশাস্ত্রে গৌড়িকারর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আদি ঐতিহাসিক সময়কালের মানুষরা এই খনিগুলো থেকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী রৌপ্য সংগ্রহ করেছে। তবে উপরোক্ত উৎসসমূহ থেকে যে রৌপ্য পাওয়া গেছে তা সমগ্র ভারত উপমহাদেশে পাঞ্চমার্ক মুদ্রার যে চাহিদা ছিলো তা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে এমনটি দাবি করার স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ দেওয়া যায় না।
বরং বাহির থেকে রৌপ্য আমদানি করে এই মুদ্রাগুলো তৈরি করা হয়েছে এ বিষয়ে অধিকাংশ একমত পোষণ করেন। সম্ভাব্য যে স্থানগুলো থেকে রৌপ্য আমদানি করার কথা ধারণা করা হয়ে থাকে, তাহলো আফগানিস্থানের হেরাট এবং হিন্দুকুশ। মায়ানমারের বাদউইন এবং চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে। সাধারণত বিশ্বাস করা হয়ে থাকে পাঞ্চমার্ক মুদ্রা প্রচুর পরিমানে তখনি প্রচলন শুরু হয়েছে যখন ভারতে মিয়ানমার, চীন, আফগানিস্তান এমনকি পারস্য থেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বানিজ্যের মধ্য দিয়ে ভারতে রৌপ্য আমদানি করা হয়েছে।
ছাপাঙ্কিত মুদ্রাপ্রস্তুত প্রক্রিয়া
কিভাবে ছাপাঙ্কিত মুদ্রা তৈরি করা হয়েছিলো এ নিয়ে কৌতুহল আছে অনেকেরই। এ বিষয়ে অভিমতও আছে বেশকিছু। প্রাসাদ; তিনি মনে করেন, এই মুদ্রাগুলো তৈরি করা হয়েছে গোলাকার রৌপ্যের রড কেটে টুকরোগুলো পিটিয়ে। তার এই ধারণাটি বা অনুকল্পটি গ্রহণ করা যায় গোলাকার মুদ্রাগুলোর ক্ষেত্রে, কিন্তু স্কয়ার আকৃতির মুদ্রা তৈরির ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রয়োগযোগ্য নয়। মুখার্জি এবং লি তারা পাঞ্চমার্ক মুদ্রা প্রস্তুত প্রক্রিয়া সম্পর্কে যে মতামত দিয়েছেন তাহলো-

ড্রপলেট মেথডঃ এ পদ্ধতিতে এক বা একাধিক ধাতুকে একটি ধাতু গলানোর মাটির পাত্রে যাকে আমরা ক্রসিবল বলে থাকি, তাতে গলানো হতো। তারপর গলিত ধাতুকে নির্দিষ্ট পরিমানে ঢালা হয়। এরপর একে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পাতলা পাতে পরিনত করা হয়। এটি যখন করা হয় তখন ধাতু গরম ও নমনীয় অবস্থায় থাকে। এরপরে ব্লাঙ্ক ধাতুর খণ্ডটিকে স্টাম্প দিয়ে এক বা একাধিক প্রতীক দেওয়া হয়ে থাকে, যখন নাকি এটি অর্ধগলিত অবস্থায় থাকে। এমন পদ্ধতিতে গোলাকার মুদ্রাগুলো প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। এর প্রান্তসীমা চিড় ধরানো থাকে।
কাটশিট মেথডঃ অধিকাংশ ছাপাঙ্কিত মুদ্রা তৈরি করা হয়েছে কাটশিট পদ্ধতিতে। এ ধরণের পদ্ধতির কথা প্রথম উল্লেখ করেছেন কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে। এ পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট পরিমান ধাতু ক্রসিবল পাত্রে উত্তপ্ত করা হয়। তারপরে তা একটি শিটে ঢালা হয়। সেখানে তা শক্ত ও মজবুত করার জন্য অন্যান্য ধাতুর ও মিশ্রন দেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় পুরো আকৃতির শিটকে নির্দিষ্ট আকৃতি ও ওজন ঠিক রেখে তার পরে কাটা হয়। ধাতুকে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে চতুর্ভুজাকৃতি (স্কোয়ার) ও আয়তাক্ষেত্রাকার (রেকট্যাংগুলার) আকৃতি প্রদান করা হয়। ওজন ঠিক রাখার জন্য এ ধরণের মুদ্রার প্রান্ত সীমা মাঝে মাঝে কাটা হয়। ফলে এ ধরণের মুদ্রাগুলো দেখতে পরবর্তী সময়ে পঞ্চভূজাকৃতি (পেন্টাগোনাল) অথবা ষড়ভুজাকৃতির (হেক্সাগোনাল) অথবা অসম আকৃতির হয়ে থাকে। ড্রপলেট পদ্ধতির চেয়ে এই পদ্ধতিতে মুদ্রার ওজনের অনুপাত ঠিক রাখা অনেক বেশিসহজ হয়। পরবর্তীতে মুদ্রার সাথে ক্ষার মিশ্রণ করে একে বর্ণহীন করা হয়। এবং হালকা তাপ দিয়ে (অ্যানেলিং) একে নরম করা হয়। তারপরে বিভিন্ন নকশার ডাইস ব্যবহার করে এক পাশ বা উভয় পাশে তাতে ছাপ দেওয়া হয় হাতুড়ির সাহায্য নিয়ে। এভাবে ছাপাঙ্কিত মুদ্রা তৈরি করা হয়। উপরোক্ত পদ্ধতির বাইরেও ছাপাঙ্কিত মুদ্রা তৈরির বিষয়ে পরমেশ্বরিলাল গুপ্ত আরেকটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন। এ পদ্ধতিকে বলা হয় কাস্ট পদ্ধতি।
কাস্ট পদ্ধতিঃ মথুরা, কাশি, ঝুশি, উত্তরপ্রদেশ, হারিয়ানার খোকারকোট, বিহারের নালন্দা, উড়িষ্যার শিশুপালগড়, মধ্য প্রদেশের ইরান, অন্ধ্র প্রদেশের কোন্দাপুর থেকে পাঞ্চমার্ক মুদ্রা তৈরির পোড়ামাটির কাস্টিং মোল্ডপাওয়া গেছে। কোন্দাপুর খনন করে পরমেশ্বরিলাল গুপ্ত ৪টি পাঞ্চমার্ক মুদ্রা পেয়েছেন যা পরীক্ষা করে তিনি দেখতে পেয়েছেন এ মুদ্রাগুলো অন্যান্য মুদ্রার মতো নয় বরং এগুলো কাস্টিং মোল্ড দ্বারা তৈরি হতে পারে বলে তিনি অভিমত দিয়েছেন।
এমনকি তিনি তার এই পরীক্ষা শেষে দাবি করেছেন মৌর্য পরবর্তী সময়ে এই কাস্টিংপদ্ধতিতে ছাপাঙ্কিত মুদ্রা তৈরি করা হতো। পরমেশ্বরি লালগুপ্তের এই অনুমান এখনো সন্তোষজনক হয়ে ওঠেনি অনেকের কাছে। ইন্ডিয়ার পাঞ্চমার্ক মুদ্রা নিয়ে ড. প্রাসাদ ও পি. লাল তারা মথুরা মোল্ড নিয়ে গবেষণা করেছেন। তারা ধারণা করেছেন এ ধরণের পোড়ামাটির মোল্ড তৈরি করা হয়েছে ফোর্গিং সিলভার পাঞ্চমার্ক মুদ্রা তৈরি করতে কাস্টিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে। তবে কাস্টিং মেথড বিষয়ে অধিকতর গবেষণা হওয়া ও অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। পাঞ্চমার্ক মুদ্রা তৈরি করতে অন্যতম টুলস হলো ডাইস। ডাই হলো এমন একটা ধাতু যেখানে নেগেটিভভাবে প্রতীক উৎকীর্ণ থাকে। মজার ব্যাপার হলো পুরো ভারত উপমহাদেশে এখন পর্যন্ত এরকম কোনো ডাইস আবিস্কার হয়নি। সর্বোপরি পাঞ্চমার্ক মুদ্রা তৈরির প্রক্রিয়া আরও গবেষণার দাবি রাখে।

ডাইস্ট্রাইক মুদ্রাঃ আমরা আদি ঐতিহাসিক সময়ের মুদ্রায় কিছু মুদ্রা পাই যেগুলো তৈরি করা হয়েছে ডাইস্ট্রোক পদ্ধতিতে। এর একপাশে শুধুমাত্র ডিভাইস আছে। এর উৎকীর্ণের সময় পাই আমরা খ্রিঃপূঃ ৪ শতক। এর কিছু আছে সিংহ ডিভাইস দিয়ে তৈরি। যা ট্যাক্সিলা থেকে উৎকীর্ণ বলে মুখ্য পিঠ থেকে জানা যায়। অন্য মুদ্রাগুলোতে দেখি বৌদ্ধদের প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বোধি বৃক্ষ, স্বভাস্তিকা অথবা মঠ বা আশ্রমের নকশা। এটা সাধারণত অশোক এর সময়কালে এ ধরণের মুদ্রা তৈরি করা হয়েছিলো। যখন নাকি বৌদ্ধধর্ম উত্তর পশ্চিম ভারতে তথা গান্ধারা অঞ্চলে সর্বোপ্রথম বিকাশ লাভ করেছিলো। এই ডাই (মুদ্রা বানানোর ধাতব ছাঁচ) দিয়ে ছাপ দেওয়া হতো যখন নাকি ধাতব উত্তপ্ত অবস্থায় থাকত। এটি ডিপ স্কোয়ার ইনকাস আকৃতির হতো যেখানে সিংহের প্রতীক থাকত। পরবর্তী সময়ে এমন দুই পাশেই ডিভাইস পাওয়া যায়। যা ইনকাস করা। এ মুদ্রাগুলো পাওয়া যায় পাঞ্চালা, কৌশাম্বী ও মথুরা থেকে। এ ধরণের মুদ্রা তৈরির পদ্ধতি সাধারণত পারস্য থেকে আসতে পারে। এ ধরণের পদ্ধতি মুলত এসেছিলো সিলমোহরের খোদাই কর্ম থেকে। এ ধরণের পদ্ধতির সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলো মুদ্রার দুই দিকেই ছাপ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। এর গোলাকার আকৃতি বা চতুর্ভজাকার আকৃতি ডাই কাটিং এর শিল্পের সর্বোচ্চ উন্নতির পরিচায়ক। গান্ধারা থেকে আমরা এর কিছু মুদ্রা পাই যারা মুখ্য পাশে সিংহ ও গৌণপাশে হাতির প্রতিকৃতি পাওয়া যায়। এটি অন্য কারণেও গুরুত্বপূর্ণ যে এতে গ্রিক প্রিন্স, প্যান্টালিওন ও আগাথোক্লেস এর মাধ্যমে মুদ্রাগুলো উৎকীর্ন। যারা নাকি খ্রিঃপূঃ দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে শাসন করত। ডাই স্ট্রোক মুদ্রাগুলোতে আমরা নিঃসন্দেহে বহির্ভারতীয় প্রভাব পাই তবে এই ডিভাইস এ পিঠ বাকানো ষাঁড়, হাতী এবং ধর্মীয় প্রতিকগুলো শতভাগ ভারতীয় ছিলো।
আকৃতি ও মাত্রাঃ সাধারণত ছাপাঙ্কিত মুদ্রা ড্রপলেট পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়ে থাকলে গোলাকার আকৃতির হয়ে থাকে। আর যদি কাটশিট পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় সেখানে দেখা যায় এটি চতুর্ভুজাকৃতি (স্কোয়ার) ও আয়তাক্ষেত্রাকার (রেকট্যাংগুলার) আকৃতি প্রদান করা হয়। ওজন ঠিক রাখার জন্য এ ধরণের মুদ্রার প্রান্ত সীমা মাঝে মাঝে কাটা হয়। ফলে এ ধরণের মুদ্রাগুলো দেখতে পরবর্তী সময়ে পঞ্চভূজাকৃতি (পেন্টাগোনাল) অথবা ষড়ভুজাকৃতির (হেক্সাগোনাল) অথবা অসম আকৃতির হয়ে থাকে। পাঞ্চমার্ক মুদ্রার মাত্রা সব সময়ে একই হয় না, এটি নির্দিষ্ট নয়। সাধারণত জনপদ পাঞ্চমার্ক মুদ্রা বড় ও পাতলা হয়। সাম্রাজ্য মুদ্রা ছোট ও পুরু হয়। আসলে মুদ্রা আকৃতি ও মাত্রা তার ওজনকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। ওজনের বিষয়টি মাথায় রেখে মুদ্রাকার মুদ্রার আকৃতি ও মাত্রার দিকে নজর দিয়ে থাকেন।
প্রাপ্যতা ও সময়কালঃ রৌপ্য ছাপাঙ্কিত মুদ্রা বলতে গেলে শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানসহ পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে পাওয়া গেছে। প্রায় ২০০ হোর্ড পাওয়া গেছে এছাড়া প্রায় ১০০ অধিক ফাইন্ডস্পোট পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত হোর্ডগুলোর মধ্যে প্রাচীন পাঞ্চমার্ক হিসেবে শামানহাজুরি (কাবুল, আফগানিস্তান), ভনজা, ভীরমাউন্ড (ট্যাক্সিলা, পাঞ্জাব, পাকিস্তান), সাহেত-মাহেত হোর্ড (বাহরাইচ-উত্তরপ্রদেশ) গুরুত্বপূর্ণ যেগুলোকে শতমন সিরিজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রামনগর (জৈনপুর জেলা, উত্তরপ্রদেশ) গুরুত্বপূর্ণ কাপ আকৃতির কারণে। পাইলা হোর্ড (উত্তরপ্রদেশের খেরি জেলা) খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোশাল রাজ্যর জনপদ সিরিজের মুদ্রা হওয়ার দিক থেকে। গোলাকপুর (পাটনা জেলা, বিহার), নারহান, উত্তরপ্রদেশ, অমরাভতি (গুনতুর জেলা, অন্ধ্র প্রদেশ), করিমনগর (করিমনগর জেলা, অন্ধ্র প্রদেশ), গুলবার্গা (গুলবার্গা জেলা, কর্নাটক), কইমবাটর (কইমবাটর জেলা, তামিলনাড়ু), ভনজ, বারওয়ানি, (বারওয়ানি জেলা, মধ্যপ্রদেশ), তিলোরা (বিরভূম জেলা, পশ্চিমবাংলা) এবং চন্দ্রকেতুগড় (২৪পরগনা জেলা, পশ্চিমবাংলা) থেকে সাম্রাজ্য সিরিজের গুরুত্বপূর্ণ হোর্ড পাওয়া গেছে।
https://bangla.thedailystar.net/node/171253
পড়ুন জনকল্যানমূখী স্থাপত্য বিনির্মান ও রক্ষণাবেক্ষণে ঢাকার নবাব পরিবারের অবদান
ইন্ডিয়া থেকে যদি বাংলাদেশকে আলাদা করি, তাহলে দেখতে পাই বাংলাদেশে ৩টি পাঞ্চমার্ক মুদ্রার হোর্ড পাই। এগুলো হলো বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে রাজশাহীর বাইগাছা থেকে এবং নরসিংদী জেলার উয়ারী বটেশ্বর থেকে। এই পাঞ্চমার্ক মুদ্রার গুরুত্বপূর্ণ ফাইন্ড স্পোট প্রাপ্তি আমাদেরকে জানান দেয় সে সময় কালে বিস্তৃত পরিসরজুড়ে মুদ্রা ব্যবস্থা জারি ছিলো। পাঞ্চমার্ক মুদ্রা দীর্ঘকাল জারি ছিলো। এর সময়কাল নির্ধারণে স্কলারদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন এর সময়কাল ছিলো খ্রিঃপূর্ব ১০০০ থেকে খ্রিঃপূঃ ৪০০। কানিংহাম মনে করেন ছাপাঙ্কিত মুদ্রার সময় হলো প্রায় খ্রিঃপূঃ ১০০০ থেকে। জে. অ্যালেন এর মত হলো এই মুদ্রা প্রচলনের সময় কাল খ্রিঃপূঃ ৩য় এবং ২য় শতক থেকে খ্রিঃপূঃ ৪র্থ শতক।পরমেশ্বরীলাল গুপ্ত, টি.আর হার্ডেকার এর মত হলো ছাপাঙ্কিত মুদ্রা খ্রিঃ পূঃ ৬ শতক বা খ্রিঃপূ ২য় শতক এর শুরু থেকে। ছাপাঙ্কিত মুদ্রা বিষয়ে অধিকাংশ স্কলার একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলেন যেটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৬৬ সালে বারানসীতে। এর শিরোনাম ছিলো ‘সেমিনার অন দ্যা ক্রনলজি অব দ্যা পাঞ্চমার্কড কয়েনস’ এখানে উপস্থিতিরা একমত হয়ে বলেছেন পাঞ্চমার্ক মুদ্রা খ্রিঃপূঃ ৫০০ এর আগে আসেনি।
খননে পাঞ্চমার্ক মুদ্রা সাধারণত এনবিপিডব্লিউ এর স্তরায়ন থেকে পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে এনবিপি ডব্লিউ এর সময়কাল নির্ধারণ করা হয়ে থাকে খ্রিঃপূঃ ৫০০ থেকে খ্রিঃপূঃ ৫০ পর্যন্ত। এনবিপিডব্লিউ এর সময়কালের সাথে তুলনা করে এস. আর গোয়্যাল নির্দেশ করেছেন যে খ্রিঃপূঃ ৫০০ এর আগে পাঞ্চমার্ক মুদ্রা জারি হয়নি। মৌর্য রাজবংশের পতনের মধ্য দিয়ে মাঞ্চমার্ক মুদ্রা জারি বন্ধ হয়ে যায় খ্রিঃপূঃ ২য় শতক এ। যদিও তারপরেও প্রায় ৪-৫ শতবছর এই মুদ্রার প্রচলন ছিলো।