28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

বাংলার বাঙালি সুলতানের একলাখি সমাধি

Must read

মুতাসিম বিল্লাহ:

সুলতানি আমলে একমাত্র বাঙালি মুসলিম শাসক ছিলেন জালালুদ্দিন মুহাম্মাদ শাহ। তাঁর সমাধি সৌধ ইতিহাসে একলাখি সমাধি সৌধ হিসেবে পরিচিত। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তিনি রাজা গণেশের পুত্র ‘যদু’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যদিও শুরুতে তাকে শর্ত সাপেক্ষে ১২ বছর বয়সে কৌশল করে ক্ষমতা রক্ষা করতে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করিয়েছিলেন তার বাবা রাজা গণেশ। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলেও সে বুঝে শুনে বাবার বিরুদ্ধে গিয়েই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ একজন প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। তিনি হিন্দু মুসলিম উভয়ের স্বার্থকে দেখেছেন। একদিকে যেমন তাঁর নতুন জীবন দর্শনে প্রভাব ফেলা সুফি সাধক নূর কুতবুল আলমের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, গুরুত্বপপূর্ণ বিষয়ে তাঁর পরামর্শকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, আবার রাঢ়ী ব্রাহ্মন বৃহস্পতি মিশ্রকে তিনি তাঁর সভাকবি হিসেবে মনোনীত করেছেন, তাঁর গুণপনায় মুগ্ধ হয়ে তাকে রায়মুকুট উপাধি দিয়েছেন।

বৃহস্পতি মিশ্র তাঁর লেখায় জালালুদ্দিন মুহাম্মাদ শাহকে একজন উদারচেতা ও নিরপেক্ষ সুলতান হিসেবে আক্ষায়িত করেছেন। তিনি আরও লিখেছেন, ব্রাহ্মণদের প্রচুর পরিমাণে অশ্ব, শকট, ভূমি, গাভী প্রভৃতি দান করেছেন এবং তাদের দারিদ্র্য দূরীভূত কর সুলতান ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির আখ্যা পেয়েছিলেন। সভাকবি হিসেবে কিছুটা অতিশয়োক্তি থাকলেও এটুকুন বলা যায় যে হিন্দুদের প্রতি বৈরিতার মনোভাব তিনি পোষণ করেননি। অন্যদিকে একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম শাসক হিসেবে তিনি বাংলায় ইসলামী শাসনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাঁর প্রবর্তিত মুদ্রা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনি মুদ্রায় কালিমা নতুনভাবে উৎকীর্ণ করেন এবং নিজেকে ‘খলিফাতুল্লাহ’ ‘সুলতান’ ও ‘আমির’ হিসেবে উপস্থাপিত করে তাঁর রক্ষণশীল ও বৈধ শাসনের প্রতি মুসলিম জনগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের অনুকরণে তিনিও মক্কা মুয়াযযামায় মাদ্রাসা নির্মাণ করেছেন। মাদ্রাসার পুরো ব্যয়ভার ও এর পরিচালনার খরচ বহন করেছেন। সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের সঙ্গে সর্বপ্রথম বাংলা ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ও দূত বিনিময় রীতি চালু হয়। সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মাদ শাহের সময়েও তা অব্যাহত ছিল বলে চৈনিক সূত্রে জানা যায়। জালালুদ্দিন মুহাম্মাদ শাহ গৌড়ে রাজধানী স্থানান্তরের পর তিনি সেখানে একটি মসজিদ, দুইটি পুকুর এবং একটি সরাইখানা নির্মাণ করেছিলেন। যদিও তার কোনোটিই এখন আর অবশিষ্ট নেই। তবে তার সমসাময়িক সময়ের একটি মসজিদ ঢাকার মোয়াজ্জেমপুর  এখনো আছে বলে ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন। তাঁর শাসনামল ছিলো ১৮১৫ থেকে ১৮৩২ সাল পর্যন্ত।

একলাখী সমাধিসৌধ বাংলায় অদ্যবধি বিদ্যমান এ ধরনের স্থাপত্যকীর্তিগুলির আদি নিদর্শন। সৌধটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার হযরত পান্ডুয়ায় অবস্থিত। এ সমাধিসৌধ নির্মাণের অনুপ্রেরণা এসেছে বিহার শরীফে অবস্থিত ইবরাহিম বাইয়ুর সমাধির, এবং দিল্লির কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের পেছনে অবস্থিত সুলতান ইলতুৎমিশের সমাধি থেকে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে সমাধিসৌধ নির্মাণ তেমন জনপ্রিয় ছিল না। তুর্কিদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এ জাতীয় বর্গাকার ইমারতের সর্বপ্রথম নিদর্শন বোখারায় সামানী বংশীয় ইসমাইলের সমাধি। সম্ভবত এর মূল নমুনা ছিল ‘চাহারতক’ নামে পরিচিত ইরানের চার গম্বুজবিশিষ্ট সাসানীয় অগ্নি মন্দির। এই সমাধি সৌধের একলাখি নামের কারণ হিসেবে জনশ্রুতি আছে, এর নির্মাণকার্যে এক লাখ টংকা ব্যয় হয়েছিল; যে কারণে তা ধীরে ধীরে একলাখী বলা হয়ে থাকে। এ সমাধিতে যেহেতু কোনো শিলালিপি পাওয়া যায় না তাই নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক তারিখ পাওয়া যায় না; তবে সাধারণত জালালউদ্দীনের মৃত্যুর বছরকেই (১৪৩৩ খ্রি) এর নির্মাণের কাল বলে ধরে নেওয়া হয়।

আদিনা মসজিদ এর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত এ ইমারতটি ইট নির্মিত। সুফি নূর কুতুব আলম এর সম্মানার্থে তৈরি কুতুবশাহী মসজিদ এর কিছুদূর উত্তর-পূর্বে এর অবস্থান। এর আকার ২৪ মিঃ, ২২.৭ মিঃ চূড়াবিশিষ্ট গোলার্ধ আকৃতির গম্বুজ আছে। গম্বুজের অভ্যন্তরীণ ব্যাস ১৪.৮ মিটার। গম্বুজটি চার কোণের স্কুইঞ্চের উপর স্থাপিত। ইমারতটির চার কোণে চারটি অষ্টভুজ বুরুজ এর বহির্ভাগকে মজবুত করেছে। প্রতি দিকের দেয়ালের মাঝখানে একটি করে মোট চারটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। প্রবেশদ্বারের চৌকাঠের বাজুর উপরিভাগে রয়েছে সরদলসহ সূচ্যগ্র খিলান। এটি হিন্দু মন্দিরের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য যা তুগলক স্থাপত্যের মাধ্যমে প্রচলিত হয়েছে। দরজার বাজু ও সরদলগুলিতে রয়েছে খোদাই করা দেবমূর্তি। দক্ষিণের প্রবেশপথের সরদলে রয়েছে বিষ্ণু মূর্তি এবং দরজার বাজুগুলিতে দ্বারপালের মূর্তি। এগুলো অন্যস্থান থেকে নিয়ে এসে এখানে পুনরায় ব্যবহার করা হয়েছে।

ইমারতটির অভ্যন্তরে তিনটি প্রস্তর সমাধির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এ ধরণের স্থাপনা ‘কুব্বা’ বা ক্যানোপি সমাধি নামেও মুসলিম বিশ্বে পরিচিত। ভেতরের প্রশস্ত প্রকোষ্ঠের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো কোণগুলিতে নির্মিত চারটি কুঠুরি। এগুলি কুরআন তেলাওয়াতকারীদের জন্য সংরক্ষিত কক্ষ বলে মত দিয়েছেন গবেষক আবিদ আলি খান। তবে গবেষক ড. আহমদ হাসান দানী এই রুমের আলো প্রবেশের সুযোগ কম দেখে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তা আদৌ কুরআন পড়ার কক্ষ কিনা সে বিষয়ে। তবে বর্তমানে আলো না থাকলেও সে সময়ে যে আলো ছিলো না এমনটি নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। সে সময়ের অলঙ্করণ ও নানা কারুকাজ এই কক্ষগুলোকে হয়ত আলোকময় করে রাখত এমনটিও ধারণা করা যায়।

এর অলংকরণে কোণের বুরুজগুলিতে দড়ির ছাঁচ নক্শা বলয়, বাইরের সবদিকে বিভাজনকারী ছাঁচ নকশা, প্যানেলের নিচে পোড়ামাটির ফলকের পাশে কার্নিশে বর্তমানে ভগ্ন তিন স্তর বিশিষ্ট ছাঁচ নক্শা দেখা যায়, যা আদিনা মসজিদ হতে অনুকরণ করা হয়েছে। গম্বুজের অভ্যন্তরভাগ এক সময় পলস্তারা বিভিন্ন লতাপাতা, উদ্ভিদের অলংকরণ ও নানা কারুকাজ খচিত ছিলো যা এখন প্রায় সবই বিধ্বস্ত। গম্বুজটি সুলতানি আমলের বাংলার অন্যান্য গম্বুজের মতোই শীর্ষদন্ডহীন; তবে বৌদ্ধ রীতিতে হরমিকা আকারে গোলাকার বেষ্টনী দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল বলে মনে হয় যা স্পষ্টত একটি বৌদ্ধ স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য। গোলার্ধ আকৃতির গম্বুজটি বস্তুত সাঁচী (খ্রি.পূ. প্রথম শতক) ও পাঞ্জাবের মানিক্যলা (খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক) মহাস্তুপের গম্বুজগুলির আকৃতির সঙ্গে এতোটাই সাদৃশ্যপূর্ণ যে, এসব গম্বুজের ধারণা যে ঐসব স্তূপ থেকে নেয়া তা সহজেই অনুমেয়।

বাংলার স্থাপত্যশিল্পে এ ভবনটির প্রধান অবদান হচ্ছে বাংলার কুঁড়েঘরের ঢালু চালার অনুকরণে মধ্যভাগ হতে কার্নিশকে নিচের দিকে বাঁকিয়ে বঙ্গীয়করণ করা। একবার চালু হওয়ার পর এ রীতি বাংলায় সুলতানি আমলের স্থাপত্যশিল্পের শুধু এক গম্বুজবিশিষ্ট ইমারতেই নয়, বরং বহু-গম্বুজবিশিষ্ট বৃহৎ আকারের মসজিদগুলিতেও ব্যবহূত হয়েছে। শুধু সুলতানি আমলের ভবন নির্মাণের পাশাপাশি মুগল স্থাপত্যশিল্পেও এই ধরণের এক-গম্বুজবিশিষ্ট স্থাপত্যের নিদর্শন দেখা যায়। স্থাপত্যশিল্পের বঙ্গীয় রীতি গঠনে এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান পনেরো শতকের শেষার্ধে এবং ষোল শতকের প্রথম দিকে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিগোচর হয়।

একলাখি সমাধীসৌধের কথা উল্লেখ পাওয়া যায় গোলাম হুসাইন সালিম এর রিয়াজুস সালাতিন এ। সেখানে বড় কবরটি তাঁর ও এর দুইপাশে স্ত্রী ও সন্তানের কবর এর কথা বলা হয়েছে। মুনশি ইলাহি বখশি তার খুরশিদ ই জাহান নুমা তে পশ্চিম পাশের সমাধিকে জালালউদ্দীন মুহাম্মদ শাহের ও পূর্বের টি তার সন্তানের এবং মাঝখানেরটি সুলতানের স্ত্রীর বলে উল্লেখ করেছেন।

পরবর্তী সময়ে একলাখি সমাধি সৌধ নিয়ে গবেষণা করেন আলেকজান্ডার কানিংহাম। তার মতে মাঝের সমাধি হচ্ছে সুলতানের স্ত্রীর, পূর্বের বড় সমাধিটি সুলতানের, পশ্চিম পাশেরটি আহমেদ শাহ এর। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে পশ্চিম পাশের সমাধিটি সুলতানের, তার পরে তার পুত্র আহমেদ শাহ এরপর তার স্ত্রীর সমাধিটি পূর্ব দিকে। যা উপারে উল্লেখিত মুনশি ইলাহি বখশির মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করে।

বাংলার মধ্যযুগের মুসলিম স্থাপত্যের ইতিহাসে পান্ডুয়াতে একলাখি সমাধি সৌধ একগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এটি বাংলার নিজস্ব স্থাপত্যরীতিই শুধু নয় এর সাথে বাংলার শাসকের সম্পর্কও জড়িয়ে আছে। এটি যেন বাংলার কুড়েঘরকে ইট দিয়ে বদলে দেওয়া এক অনন্য স্থাপত্যরীতি। আবার দেশীয় দোচালা চৌচালার বদলে এ সমাধিসৌধে মুসলিম প্রতীক ‘গম্বুজ’, পোড়ামাটির ফলক, গ্লেলজ টাইলস এর ব্যবহার করা হয়েছে। যা বাংলার সাথে তৎকালীন ইসলামী সভ্যতার বিভিন্ন স্থাপত্যকীর্তির আত্নীকরণের এক অনন্য নিদর্শন।
লেখকঃ শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article