শাহীন আলম:
মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত ক্ষুদ্র একটি অঞ্চলে রয়েছে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল। এই দুই অঞ্চলের সমস্যার সমাধান যেন আকাশ কুসুম। দিন যত ঘনিয়ে আসছে ইসরায়েল অবৈধভাবে ফিনিস্তিনি শহর ও গ্রাম দখল করে যাচ্ছে। এদিকে ইসরায়েল নিজেদের স্বাধীন দেশ হিসাবে ঘোষণা করলেও এখনও স্বীকৃত দেয়নি অনেক পশ্চিমা বিরোধী দেশসহ অনেক দেশ। কারণ তারা ফিলিস্তিনির জনগণের উপর দিন দিন বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড সহ বিভিন্ন অনৈতিক আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদেরকে ভিতর থেকে পূর্ণ সমর্থক দিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। জাতিসংঘের মানবাধিকার আইন উপেক্ষা করে আগ্রাসন বেড়ে চলছে। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো কেন নীরব, তা জানতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে ইসরায়েল গঠনের ইতিহাস।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রে কবলে পড়ে তুরস্কের উসমানী খিলাফত ভেঙ্গে যায় এবং যুদ্ধে মিত্রশক্তি বিজয় লাভ করে। তখন ব্রিটিশ বাহিনী ১৯১৭ সালে ইরাক, সিনাই উপত্যকা, ফিলিস্তিন ও পবিত্র জেরুজালেম দখল করে নেয়। তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন সহ বেশিরভাগ আরব এলাকা চলে যায় ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের দখলে। কিন্তু ব্রিটিশরা চায়নি ইহুদীদের ইউরোপে জায়গা দিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করতে। কারণ তারা জানতো ইহুদিরা যে দেশে বসবাস করে সেই দেশের অন্য নাগরিকরা শান্তিতে বসবাস করতে পারে না। তাই ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর ইহুদিবাদীদেরকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। শেষ পর্যন্ত বেলফোর তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইহুদি রাষ্ট্রে গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।
ফলে, ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা কয়েক হাজারে উন্নীত হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পর থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল ২০ হাজারে। ১৯১৮ সালে ব্রিটেনের সহযোগিতায় ইসরাইলের গুপ্ত ইহুদি বাহিনী “হাগানাহ” গঠিত হয়। এ বাহিনী ইহুদিবাদীদের অবৈধ রাষ্ট্র তৈরির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। প্রথম পর্যায়ে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদীদের সহায়তা করলেও পরবর্তীকালে তারা সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে ইসরাইল ইহুদিদের জন্য নিরপরাধ ও স্বাধীন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠার ফলে সেখানে ইহুদির সংখ্যা দ্রুতই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৩১ সালে ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজারে পৌঁছায় এবং ১৯৪৮ সালে সেখানে ইহুদীদের সংখ্যা ৬ লাখে উন্নীত হয়। বর্তমান ইহুদি জনসংখ্যা প্রায় ৬৮ লাখ। যার ফলে এখনও গাজা উপত্যকা অবৈধ রাষ্ট্র দখল চেষ্টা করছে ইসরাইল।
খবরের কাগজ বা ইন্টারনেট খুললে দেখা মিলে ফিলিস্তিনিতে বিমান হামলা অথবা হত্যা। এটা যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়েছে ইহুদিবাদী দেশ ইসরায়েলের জন্য। যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যুর দূত হয়ে হামলা চালায় নিরীহ ফিলিস্তিনির উপর। বিবিসির এক রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১৪ সালে ফিলিস্তিনির ১৯৪৮ জন মৃত্য হয়েছে ইসরাইলের আগ্রাসনের হাতে এবং ৬৬ জন ইহুদি নিহত হয়েছে ফিলিস্তিনির হাতে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত মোট ফিলিস্তিনি ইসরাইলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন ৬২৮৩ জন। আর আহত সংখ্যার আরও দশগুণ। এসব হামলায় নীরব পুরো বিশ্ব।
প্রতিদিন এমন হামলায় হামাস ও ইসলামি জিহাদ প্রতিবাদ করলেও জাতিসংঘ থেকে কোনো দেশ এখনও মুখ খোলেনি ইসরায়েলের এমন কর্মকাণ্ড নিয়ে। যেন নীরবে চলছে মৃত্যুর মিছিল। এমনকি ইসলামি দেশগুলো নীরবে দেখছে ইহুদিবাদীদের হামলা। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ সবসময় তীব্র নিন্দা ও দুঃখ প্রকাশ করলে তার তোয়াক্কা করছে না ইসরায়েল। এমন কি আরবলীগ ও ওআইসিসহ ইসলামিক সংগঠনগুলো কোনো প্রতিবাদ করছে না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিভিন্ন সময় সরাসরি ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে কেউ সরাসরি আঙুল তুলছে না তাদের প্রতি। এমনকি বাংলাদেশের সাথে ইসরায়েলের সর্ম্পক বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক নেতারা। কয়েকমাস আগে আন্তর্জাতিক মিডিয়া আল-জাজিরা প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের উপর নজর ধারী করতে নাকি এমন সফটওয়্যার ক্রয় করেছেন। যদিও এটার সত্যটা কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। বিশ্বে উন্নত দেশ থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল দেশগুলো যেন যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল হয়ে রয়েছেন।
নীরব সমর্থক দিচ্ছেন কারা? যুক্তরাষ্ট্র সবসময় কৌশল অবলম্বন করে বিভিন্ন দেশকে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। এমনকি সুদান এবং পাকিস্তানের ওপরে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছিলেন মার্কিন সরকার। সিএনএন সূত্রে জানা যায়, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সৌদি আরব তাদের নিরাপত্তা এবং বেসামরিক পারমাণবিক সহায়তা নিশ্চিত করার শর্ত দিয়েছে। তাহলে বলা যায় সৌদি আরব নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে ইসরাইলের সঙ্গে মরক্কো, বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অন্যান্য আরব দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক চুক্তি করেছেন। তাহলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কারা আঙুল তুলবে? সবাই নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আজকে ফিলিস্তিনি নৃশংসতার শিকার হচ্ছে। এর শেষ কোথায় তা বলা দুষ্কর। হয়ত যতদিন ফিলিস্তিন থাকবে ততদিন এমন হামলা চলতেই থাকবে।
এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইসলামিক দেশগুলোর একতাবদ্ধ হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নিজেদের স্বার্থ বাদ দিয়ে জাতির এবং মানবতার কথা ভাবতে হবে। ইউক্রেন হামলায় যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সমর্থক দিয়ে যাচ্ছে, সেইভাবে অন্য রাষ্ট্রকে সমর্থন দিচ্ছে না কেন? কারণ তারা নিজেদেরও স্বার্থে আঘাত আসলে সেখানে তারা কঠোর। যেমনভাবে, সাদ্দাম কে ক্ষমতায় এনে আবার তাকে ধ্বংস করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র যখন যাকে প্রয়োজন তাকে রাখে, আর যার প্রয়োজন নেই তাকে ধ্বংস করে দিয়ে যায়।
আগামীর ফিলিস্তিন কোথায় যাবে? যদি ইসরায়েলের এমন আগ্রাসন চলতে থাকে তাহলে ফিলিস্তিনি হত্যা আরও জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। তাই যতদ্রুত সম্ভব তাদেরকে এসব সমস্যা থেকে মুক্তি দেওয়া উচিত। মুসলিম দেশগুলো নিজেদের মাঝে সমস্যা দূর করে মুসলিম দেশগুলোকে রক্ষা করতে হবে। এছাড়া ওআইসি যে উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করা। আরব দেশগুলো যদি নিজেদের ভুল বুঝাবুঝি দূর করতে হবে। ন্যাটোর মতো একটি ইসলামিক সংগঠন গঠন করতে হবে। তাহলে ফিরিয়ে পাওয়া যাবে শত বছরের সেই ফিলিস্তিনকে।
লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।