মুরাদুল মুস্তাকীম মুরাদ
এক.
মানুষের ধৈর্য এবং সহ্যের একটা দেয়াল বা লাস্ট স্টেইজ থাকে। খোলা মাঠে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীরটা প্রতিনিয়তই ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই ধরুন আপনি তিন ঘণ্টার জন্য ঢাকার জ্যামে পড়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা খুবই সাধারণ হতে পারে, কিন্তু আপনার অজান্তেই এখানে আপনার ধৈর্যের দেয়ালে কয়েকটা হাতুড়ির বাড়ি পড়ে গেল। সামান্য পলেস্তারা যে খসে পড়ে গেলো, সেটা আপনি বুঝতেই পারলেন না। এরপরে ধরুন আপনি বিসিএস প্রিলিতে টিকলেন না, প্রেশার আসলো পরিবার থেকে। এবার সেই দেয়াল থেকে খসে গেল কয়েকটা ইট। বন্ধুর সাথে নিজের পছন্দের কোনও বিষয় নিয়ে তুমুল তর্ক করলেন, বন্ধু হয়ত ভালোভাবে ট্রিট করেনাই আপনাকে, মানসম্মানে লেগেছে কিছুটা, সামান্য হলেও আঘাত লাগলো তাতে। একসময় প্রেমে ব্যর্থ হলেন, খসে গেল হয়ত মোটে পাঁচটা ইট। কিন্তু কেউ জানতো না আগে থেকে ভাঙতে ভাঙতে এগুলোই দেয়ালের সর্বশেষ ইট ছিল। দেয়াল ভেঙে গেলো, আত্মহত্যা করলো কেউ একজন। খবর এলো ‘প্রেমের কারণে গলায় ফাঁস দিয়ে অমুকের আত্মহত্যা!’
প্রতিটা আত্মহত্যার ক্ষেত্রেই আমরা এভাবে একেবারে লাস্ট ইনসিডেন্টকে ধরে ঘটনাকে বিচার করি, লাস্ট ঘটনাকে দিয়ে আকস্মিক এসব মৃত্যুর ক্লোজার টানি। আমরা বলি ‘কত হাসিখুশি মানুষ ছিলেন, এই যে গতকালও কত উৎফুল্ল ছিলেন, মজায় ছিলেন, মাস্তিতে ছিলেন, কখনোই কিছু বলে নাই, সুইসাইডাল ছিলোই না, পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে, পাশ করতে পারে নাই, বাসায় বকা দিয়েছিলো আর সুইসাইড করে বসলো!’
আমরা চিন্তাই করতে পারি না হয়ত ৪-৫ বছর আগের একটা ঘটনা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল এতদিন। হয়ত একটা ঘটনায় ওর কনফিডেন্স চলে গিয়েছিল নিজের উপর থেকে, আর ভরসা পাচ্ছিলো না নিজের প্রতি। তাকে গুড ফর নাথিং ভাবছিল হয়ত। হয়ত কোনো ঘটনায় সেল্ফ স্টিম শূন্যে নেমে গিয়েছিল, নিজেকে কোনও কিছুর যোগ্য মনে করতে পারছিলো না। বার বার প্রশ্ন করছিলো ‘এই জীবনের আসলে মূল্য কোথায়!’ হয়ত কোনো ঘটনায় সেল্ফ রেস্পেক্টটাও হারাইয়া বসেছিলো, নিজের ভেতর থেকে নিজেকে সহ্য হচ্ছিলো না। নিজে নিজের শত্রু হয়ে এতদিন পার করছিলো।
এমন হয়ত আরো ঘটনা ছিল। প্রেম, ক্যারিয়ার, বন্ধু-বান্ধব, পারিবারিক ব্যাপার নয়তো একদম র্যান্ডম কোনো ঘটনা। কোনো না কোনোভাবেই আঁচড় তো কেটে যেতেই পারে, তাই না?
এই প্রতিটি ঘটনা একটা একটা করে সিঁড়িতে তুলে দিয়ে গেছে। ওই আগের কষ্ট বুকে চেপে ও একটা একটা করে সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। হয়ত মাঝে ভালো দিন গেছে, কোনোটায় কয়েক সিঁড়ি নেমে গেছে আবার, কিন্তু মনের ক্ষত তো কমে নাই আর।
এত বছর ধরে চেপে রাখা সেই সব কষ্টের জন্যে সিঁড়িটা তাকে ১০ তলার একটা ছাদে নিয়ে এসেছিল, একদম কোনায়, একেবারে কার্নিশে!
বাসা থেকে বকা খাওয়াটা জাস্ট ছোট্ট একটা পুশ ছিল। ও যদি এই কার্নিশে না থাকতো, হয়ত এই বকা খাওয়াটা ওয় গায়েই মাখাত না।
লটস অব পিপল এরাউন্ড ইউ আর, যারা এই টপ ফ্লোরে অবস্থান করছে! আপনি পাশে থেকেও হয়ত কিছুই জানেন না কিন্তু ওরা উঠে গেছে নিজে নিজে।
এই ব্যাপারটাকে হয়ত মাপা যায় মেন্টাল টলারেন্স স্কেল দিয়ে। আমাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এই মেন্টাল টলারেন্স স্কেল আলাদা। আলাদা সাইকোলজিক্যাল প্রোফাইলও। সুইসাইডের মতো ঘটনা তখনই ঘটে যখন মানুষ তার সহ্যের নির্দিষ্ট রেঞ্জটা অতিক্রম করে ফেলে। এই নির্দিষ্ট রেঞ্জ যে সবার আলাদা আলাদা এই সাধারণ বোধটা আমরা কেন জানি সব সময়ই ভুলে যাই।
এখন একটা প্রশ্ন আসতে পারে, মেন্টাল টলারেন্স স্কেলের কি উন্নতি অবনতি হয় নাকি এটা জন্ম থেকেই ফিক্সড?
অবশ্যই এটা ফিক্সড না। জন্মগতভাবেই মানুষ একটা ভ্যালু পায় ঠিকই, তবে সেটা ব্যক্তিভেদে কম বেশি হতে পারে, কিন্তু যাপিত জীবন সেটাকে উপর নীচ করে প্রতিনিয়ত। আপনি খালি চোখে দেখছেন একটা ছেলে বা মেয়ে প্রেমের কারণে আত্মহত্যা করেছে! কিন্তু এটা হয়ত লাস্ট কারণ হতে পারে, একমাত্র কারণ না।
আপনি বলতে পারেন ঢাকার জ্যামে আমিও পড়ি, পরীক্ষায় ফেইল তো আমিও করছি, বাসায় বকা তো আমিও খাইছি, আমি নিজেও প্রতিদিন সবার সাথে ঝগড়া করি কিন্তু আমার মাথায় তো কোনোদিন আত্মহত্যার কথা আসেনি!
কিংবা অমুক এই ক্যান্সার জয় করেও দিব্যি বেঁচে আছে, তমুক এত কষ্ট করলো জীবনে, তার হাত-পা নেই তাও বেঁচে আছে.. আর ওয় কিনা সামান্য একটা কারণে আত্মহত্যা কইরা বসলো!
যে অলরেডি আত্মহত্যা করে ফেলছে তাকে যদি আপনি নিজের সাথে এক পাল্লায় মাপেন, কিংবা যারা স্ট্রাগল করে বেঁচে আছে এখনো তাদের সাথে কম্পেয়ার করেন, তাহলে সেটা হবে একপাক্ষিক। আপনাকে এখানে মনে রাখতে হবে প্রতিটা মানুষের টলারেন্স স্কেল আলাদা। এটা আমাদের শরীরের ইম্যুনিটির চেয়ে ভিন্ন কিছুই না। কেউ কেউ ঠান্ডা খাবার খেলেই অসুস্থ হয়ে যায়, সামান্য সর্দিতে কাহিল হয়ে পড়ে। আবার অনেকেই আছে যারা ফাঙ্গাস ওঠে যাওয়া খাবার খেয়েও দিব্যি সুস্থ থাকে। ইম্যুনিটি স্কেল যে আলাদা এটা আমরা জানি, স্বীকৃতি দিই, ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবেই দেখি। কিন্তু যখন মেন্টাল টলারেন্স স্কেলের হিসেব আসে তখন আমরা ভীষণ জাজমেন্টাল হয়ে যাই। প্রতিটা মানুষ যে আলাদা আলাদা সত্তা নিয়ে বাস করে মানতে কষ্ট হয়।
আপনি নিজেকে হয় তো অনেক বেশিই স্ট্রং ভাবতে পারেন, কিন্তু দিনশেষে আপনারও একটা ব্রেকিং পয়েন্ট আছে। ব্রেকিং পয়েন্টে আঘাত পড়লে আপনি সুইসাইড না করলেও ভেঙে পড়বেন নিশ্চিত। অন্য হিসেবে আপনার দুর্বল জায়গা বরাবর এখনো আঘাত পড়ছে না। দুর্বল জায়গা সবার ক্ষেত্রে সমান হয় না। যে পরীক্ষায় পাশ করতে না পারার কারণে আত্মহত্যা করছে তার কাছে সেটাই তার ব্রেকিং পয়েন্ট, যে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করছে তার কাছেও সেটাই তার ব্রেকিং পয়েন্ট, তেমনি পারিবারিক কলহে কিংবা পছন্দের ক্যারিয়ার গড়তে না পারা, বা চাকরি না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে যারা স্বেচ্ছা মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছে তাদের কাছে এসবই তার ব্রেকিং পয়েন্ট। এক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জানেই না তার আসলে ব্রেকিং পয়েন্টটা কোথায়।
এই ব্রেকিং পয়েন্টটাই হচ্ছে আমাদের জীবনের লাস্ট স্টেইজ! যার মাধ্যমে আমরা আমাদের লাইফের ক্লোজার টানি। এখানে চলে আসলে জাস্ট একটা ছোট্ট পুশের দরকার হয় মাত্র। এরপরে আমরা বড় বড় গলায় বলি, ‘মাত্র এইটুকুর জন্য ছাদ থেকে লাফ দিয়া মইরা যাওয়া লাগে নাকি….!’
দুই.
এই পর্বে আমরা একটা কবিতার সারাংশ দিয়ে আলাপ শুরু করবো। যার নাম হচ্ছে ‘Home they brought their warrior dead’। বাংলায় কি হবে জানি না। তবে বাংলায় কবিতাটার সারসংক্ষেপ এমন যে, যুদ্ধে এক সৈনিক মারা যায়, তার লাশ তার বাড়িতে আনার পর সবাই কাঁদছে, তার সকল আত্মীয়পরিজন কাঁদছে, কিন্তু তার স্ত্রী কাঁদছে না। তখন এক বৃদ্ধা সবাইকে বলে ওকে একটু কাঁদাও, নইলে ও মারা যাবে। একে একে অনেক চেষ্টা করার পর যখন কাজ হলো না, তখন তার সন্তানকে এনে তার কোলে দেওয়া হলো, এবার তিনি কাঁদলেন, খুব কাঁদলেন, বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন..
আলফ্রেড লর্ড টেনিসন তার এই কান্নাকে বলেন ‘Like summer tempest came her tears’
মানুষের কষ্ট পাওয়ার পরে কান্না করাটা অতি আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়ায় ভালো থাকার জন্য। কান্না অনেক কিছুই ধুয়ে মুছে নিয়ে যায় মন থেকে। অনেক সময় হয়ত একেবারে সাফ করে দিয়ে যায় সব। যারা কথায় কথায় কান্নাকাটি জুড়ে দেয় তাদের বিরক্ত লাগলেও তারা অনেকের থেকেই এক রকম সেরা ভাগ্য নিয়েই দুনিয়ায় আসছে। তাদের দেখে বিরক্ত না হয়ে বরং হিংসা করা জায়েজ।
অনেকেই আছেন একেবারে হতভাগ্য! যাদের জড়িয়ে ধরে কান্না করার মতো আপন কেউ নাই। যাদের কান্না চোখে দেখাও এক রকমের ফলেন স্টার দেখার মতো ঘটনা। অনেক কষ্ট ই তারা বুকে চেপে সহ্য করে নেন। হয়ত নিজের কষ্ট প্রকাশ করে দেখানোর মতো আপন কাউকে ভাবতেই পারেন না তারা কখনো।
যারা সুইসাইড করলো তারা যদি কাউকে জড়িয়ে ধরে একবার মনে খুলে কাঁদার সুযোগ পাইতো, কষ্ট গুলো প্রকাশ করার মতো একটা আপন মানুষ পাইতো, যার কাছে নিজেরে আত্মসমর্পণ করানো যায়, তাইলে হয়ত কখনোই নিজের জীবনটাকে কেউ কখনোই ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারতো না..
তিন.
আত্মহত্যা সম্পর্কে এমিল ডুর্খেইম সর্বপ্রথম তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করেন যে, ‘আত্মহত্যা কোনো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, বরং আত্মহত্যার প্রধান কারণগুলো সামাজিক। সমাজের নানামুখী শক্তির কারণেই মানুষ আত্মহত্যায় বাধ্য হয়। তিনি দেখিয়েছেন, একটি সমাজের সামাজিক অবস্থা, লিঙ্গ, বয়স, ধর্মীয় বিশ্বাস, বৈবাহিক অবস্থা, পারিবারিক পরিবেশ, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক পরিবেশ ইত্যাদি কারণে আত্মহত্যার হার প্রভাবিত হয়।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মানসিক চাপ, পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, যৌন নির্যাতন, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, ঋণের বোঝা, বেকারত্ব, প্রেম বিষয়ক জটিলতা ইত্যাদি আত্মহত্যার প্রধান কারণ। উল্লিখিত প্রতিটি কারণ বিশ্লেষণ করলে এটা বলা খুবই সহজ যে, আত্মহত্যা তখনই সংগঠিত হয়, যখন একজন ব্যক্তির ওপর নানামুখী সামাজিক চাপ অনুভূত হয়।
আত্মহত্যার প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয় ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতাকে। সাধারণত কষ্ট পেয়ে কোনও মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় না, বেছে নেয় দীর্ঘমেয়াদি ডিপ্রেশনের কারণে।
ডিপ্রেশন এমন একটি ভয়াবহ মানসিক রোগ, যা একটা সময়ে বেঁচে থাকার সকল আগ্রহকে ম্লান করে দেয়! এ রোগে বিপুলসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলেও সচেতনতার অভাবে তা নির্ণীত হচ্ছে না এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে না। অনেকের ধারণা মন খারাপ থাকলেই বুঝি আমাদের ডিপ্রেশন ফুটে ওঠে, কিন্তু সর্বক্ষেত্রে এ কথাটি প্রযোজ্য নয়। অনেক ডিপ্রেশনে ভোগা রোগীই হাসিমুখে আমাদের মাঝে বাস করে যাকে ‘স্মাইলিং ডিপ্রেশন’ বলে। তাছাড়া ছোট বাচ্চারাও অনেক সময় ডিপ্রেশনে ভুগতে পারেন।
অলীক কথা শোনা বা দেখা, ভ্রান্ত দৃঢ় বিশ্বাস, অসংলগ্ন কথাবার্তা, চিন্তার জগতে বিশৃঙ্খলা, ঘুম না হওয়া, কম কথা বলা, সন্দেহ করা, নিজের যত্ন নেওয়ায় উদাসীনতা, মন খারাপ থাকাসহ অনেক কিছুকেই আমরা ডিপ্রেশনের কাতারে নিয়ে আসতে পারি। কোন কোন প্রেম ‘লাভ অবসেশন’ নামক জীবননাশী মানসিক রোগে পরিণত হয়। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ভালোবাসার মানুষের সামান্যতম অবহেলাও সহ্য করতে পারেন না এবং এত বেশি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ও সন্দেহ করে যে প্রায়শই এ ধরনের সম্পর্ক একসময় ভেঙ্গে যায়। কিন্তু সে মানসিক রোগাক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় ভালোবাসার মানুষটিকে ফিরে পেতে কিংবা তার বিরহে বিধ্বংসী কাজকর্ম শুরু করে যার একটি হলো আত্মহত্যা। এবং এটাই চূড়ান্ত পরিণাম।
ডিপ্রেশনই বোধহয় এ দেশে একমাত্র মহামারি যেটা রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দূরে থাক, রীতিমতো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়। অথচ এ দেশের অর্ধেক মানুষই নানা কারণে ডিপ্রেশনে পড়ে আছে। মানুষের মেন্টাল টলারেন্স স্কেল যেমন আলাদা, তেমনি ডিপ্রেশনের গভীরতাও সবার ক্ষেত্রে সেইম না।
এক্ষেত্রে আমরা ডিপ্রেশন কে যদি মাইনর ডিপ্রেশন এবং মেজর ডিপ্রেশন দুই ভাগে ভাগ করি, তাহলে দেখা যাবে মাইনর ডিপ্রেশন মোটামুটি সবার জীবনেই কমবেশি আসে, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে এসব আবার কমতে শুরু করে। কিন্তু ঝামেলাটা হচ্ছে কেউ কেউ এই মাইনর ডিপ্রেশনগুলোকে কখনো কাটিয়ে উঠতে পারে না, বা ইগনোর করে রাখতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে ঘটনা ভুলে যায় হয়তোবা কিন্তু রেশ থেকে যায় ঠিকই। এর সাথে যখন চলে আসে বিগত জীবনের বিশেষ কোনো ঘটনা তখনই এই সামান্য জিনিসগুলো টেনে নিয়ে যায় মেজর ডিপ্রেশনের দিকে। উদাহরণ দিই,
ধরুন একটা মেয়ে খুব ছোটবেলায় কোনো বয়স্ক মানুষের দ্বারা সেক্সুয়ালি এবিউজড হয়েছিলো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে হয়তোবা তার মধ্যে ভেতর থেকে এই বীভৎসতা চলে গেছে। হুট করে কোনো বয়স্ক মানুষ তার ইনবক্সে নোংরা কোনো ছবি পাঠিয়ে দিল। এই মেয়ে এক লাফে চলে যাবে অতীতে। ডিপ্রেশন ঘিরে ধরবে তাকে। এই সামান্য ঘটনাটাই তার জন্য হয়ে যাবে মেজর ডিপ্রেশন।
সুইসাইডের ক্ষেত্রে আমরা যেটাকে বলি কারণ সেটা আসলে সরাসরি কারণ না। প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় ফেল, শিক্ষকের বকাবকি, পাখি ড্রেস না পাওয়া এসব একটা জীবনকে কেড়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এসব কারণ কেবল সুইসাইডকে ট্রিগার করে। বিশেষ কারণে ডিপ্রেশনের ডিপ লেয়ারে পৌঁছে যাওয়া মানুষ ছাড়া প্রতিটা আত্মহত্যাকারী আগে থেকেই সময় নিয়ে নিজের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে সুইসাইড করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছে। উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত ট্রিগারে চাপ পড়ে গেলেই এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে যায়।
মেজর ডিপ্রেশনে পৌঁছে যাওয়া প্রতিটা মানুষই আত্মহত্যার জন্য একরকম প্রস্তুত হয়ে থাকে। সমস্যাটা হচ্ছে এটা জ্বর বা কাশির মতো কোনো স্থূল লক্ষণ সমৃদ্ধ অসুখ না। ডিপ্রেশন মেজর অবস্থা যে দীর্ঘদিনের জন্য হয় তাও না। মাসে কিংবা বছরে মাত্র দুই ঘণ্টা থেকে দুই দিনের জন্য কারে কারো মেজর ডিপ্রেশন হতে পারে। অনেকটা বমি লাগার মতো এই অবস্থাটা কেটে গেলে এসব রোগী ভীষণ অনুতাপ বোধ করে। ‘ছি! এসব কী ভেবেছি’ বলে লজ্জা পায়। এজ এ ম্যাটার অব ফ্যাক্ট, মাত্র দুই মিনিটই আত্মহত্যার জন্য যথেষ্ট। কেউ কেউ মাত্র একবার ডিপ্রেশন মেজরে পড়ে, কিন্তু ঐ একবারের জন্য আর ফিরতে পারে না।
বাংলাদেশে কতজন মেজর ডিপ্রেশন রোগী আছেন?
সাধারণত আত্মহত্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য খুবই কম পাওয়া যায় বাংলাদেশে। তবে কোন কোনো হিসেবমতে এ দেশের ন্যূনতম ৬৫ লাখ মানুষ সুইসাইড ঝুঁকিতে আছে! এবং এদের মধ্য থেকে লাখে অন্তত ১২৮ জনই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে বসে। আত্মহত্যার চেষ্টা করে আরো একশ গুণ বেশি মানুষ।
সারাবিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করে এবং আমাদের দেশে প্রতি ৫০ মিনিটে একজন আত্মহত্যা করে! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ মতে বাংলাদেশে প্রতি ২.৫ মিনিটে একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনার আলোকে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এর জরিপের রিপোর্ট অনুযায়ী সব বয়সীদের মধ্যেই আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা ও পানিতে ডুবা আঘাতজনিত মৃত্যুর প্রধান তিন কারণ। তবে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের আলাদাভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। কিন্তু আত্মহত্যার এই ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা কখনো চিন্তা করিনা বলেই বুঝি না যে প্রতিদিন ৪০ জন মানুষ যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে তাদের মধ্যে আমি নিজে বা আমার পরিবারের যে কারো নামও চলে আসতে পারে একটা সময়..
চার.
তাহলে আমাদের দায়িত্ব কী?
আত্মহত্যার অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আপনিও আপনার কোনো বন্ধু বা নিকটজনের আত্মহনন রোধ করতে পারেন, হয়ে উঠতে পারেন মর্মান্তিক পরিণতি ঠেকিয়ে দেওয়ার উপলক্ষ্য। এ জন্য দরকার সচেতনতা, পাশে থাকা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা।
আমাদের দেশে তরুণদের হতাশ হওয়ার হাজারটা উপাদান আছে। বিশেষ করে ‘জীবনে সফল হতেই হবে’ এমন ধারণা আমাদের হতাশা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।
জীবনে সবাই সব পাবে না। প্রতি বর্গকিলোতে ১২০০ মানুষের বাস যে দেশে, সেখানে সবাই ৬ ডিজিটের স্যালারি পাবে না। বাঁচার পথটুকু যাতে ডাক্তার-ইঞ্জিয়ার-বিসিএস ক্যাডারে সীমাবদ্ধ হয়ে না যায়, সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদের অগ্রজদের। ফুসফুসে অক্সিজেন এবং পেটে ভাত থাকলে বেঁচে থাকাটা অপমানের না। আমাদের স্কিল বাড়ে না, আমাদের বুদ্ধি আড়ষ্ট, আমাদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ.. কিন্তু প্রজন্মকে আমরা শেখাচ্ছি সেরা হতে। আমরা তুমুল অপমানবোধ গায়ে মাখি। অন্তঃসারশূন্য হয়েও আমরা একেকজন ইগোর টাইটাইনিক।
ভার্চুয়ালটাকে কম গুরুত্ব দেয়া শেখাতে হবে। জীবন বাস্তব হোক। সন্তানকে, ছোট ভাইবোন কে বলুন তাদের কাজ যেন তারাই করে।
এই প্রজন্মের টেম্পারমেন্টের যে দেয়াল সেটা এমনিতেই একটু নড়বড়ে! এক সময় চাপ নিতে পারে না আর। এটা এমনি এমনি শক্তও হয় না, শক্ত করতে হয়। শক্ত করার জন্য দরকার খারাপ সময়গুলোতে মাথায় হাত বুলিয়ে পাশে থাকা।
এছাড়া ডিপ্রেশন কে রোগ হিসেকে প্রতিষ্ঠা করা। নাহয় সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে সবাই যেতে আগ্রহ দেখাবেনা। অধিকাংশ মানুষই তাদের বিষণ্নতা নিজেদের মধ্যে হজম করে রাখে। আমাদের সমাজ এখনো একজন বিষণ্নতার রোগীকে সাইকিয়াট্রি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। সেটা তৈরি করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সাইকিয়াট্রিতে এসব রোগীরা ভিড় করুক। সামান্য কটা ট্যাবলেট, দুই সেশনের কাউন্সেলিং, কতগুলো জীবন বাঁচায়ে দিতে পারে সেটা হয়ত স্বাভাবিক মাথায় ভাবাও অসম্ভব।
আর সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা। ‘সুইসাইড মহাপাপ, জাহান্নাম নিশ্চিত’ এই নিষেধ বাণী সুইসাইড প্রতিরোধের অন্যতম হাতিয়ার। কিন্তু এর মাধ্যমে একজনকে এক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ঘরে তালা দিয়ে রাখার সমান নয়। সঠিক ধর্মচর্চাকারী মানুষদের মধ্যে হতাশা কম কাজ করে। সুইসাইড থেকে বাঁচার জন্য ধর্মকে যদি ব্যবহার করতে হয় তবে সেটা হলো ধর্ম চর্চা, ধর্মীয় আইন না। ধর্মের প্রতিটা নিয়ম মানতে পারলে এমনিতেই সুইসাইডের হার কমে যাবে কয়েকশ গুণ।
একটা মানব প্রাণের চেয়ে দামি কিছু জগতে নেই। সেই প্রাণ যখন একজন নিজের হাতে নিজে কেড়ে নিচ্ছে, ব্যাপারটা হালকা কিছু না।
এইডস হওয়ার যে মূল কারণ সেটাকে ধর্ম বা সমাজ স্বীকৃতি না দিলেও এই রোগ নিয়ে কত মাতামাতি। ডিপ্রেশন নিষিদ্ধ কিছু না। আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণা, লিফলেট প্রচারের সময় এসেছে। সব জায়গায় পজিটিভিটি ছড়িয়ে দিতে হবে। নাটককে ভাঁড়ামো, সিনেমাকে প্রেম আর মারামারি, গল্পকে ন্যাকামির জায়গায় সীমাবদ্ধ না রেখে ছড়িয়ে দিতে হবে জীবনের গান।
আমরা খারাপ আছি, কষ্টে থাকি, তারপরও চাইলে ভালো থাকা যায় এই বোধটা ছড়িয়ে দিতে পারলেই বেঁচে যাবে অনেকগুলো প্রাণ। আপনি একটু কনসার্ন থাকলে আপনার কাছাকাছি থাকা ডিপ্রেশন মেজরে ভোগা বন্ধুটাকে হয়ত হারাতে হবে না আর।
আত্মহত্যা গৌরবের নয়, আবার আত্মহত্যা অভিশাপেরও নয়। আপনি আপনার জায়গা থেকে আপনার পাশে থাকা বন্ধুটার জন্য, কিংবা আপনার ছোট ভাই বা বোনটার জন্য, কিংবা যে-কোনো মানুষের জন্যই হয়ে উঠুন লাইব্রেরির মতো, যেখানে নিজেকে যেমন গুটায়ে রাখা যায়, তেমনি প্রয়োজনের সময় আবার তুলেও নিয়ে আসা যায়, নতুন নতুন জ্ঞান আহরণের মতো করে…!
লেখক: শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।