28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

মনের প্রয়োজন বই

Must read

আনিসুর রহমান

পেটের ক্ষুধা মেটায় খাবার কিন্তু মনের ক্ষুধা মেটায় বই। কথাটি বলেছিলেন আমার একজন মাধ্যমিক শিক্ষক। কথাটির বিপরীতে অনেকেই যুক্তি দিতে পারেন যে জীবন ধারনের জন্য বই খাদ্যের তুলনায় অতটা অপরিহার্য কোনো বস্তু নয়। হ্যাঁ, একথা সত্য যে জীবনে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য প্রয়োজন। তবে খাদ্য শুধুমাত্র মানুষের শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু একমাত্র বই পারে মানুষের মন ও মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রাখতে। একজন মানুষ কতটুকু পরিপক্ব হলো কিংবা সে শারীরিকভাবে নাকি মানসিকভাবে পরিপক্ব হলো সেটা নির্ধারণ করে বই।

বই মানুষকে একাধারে সহানুভূতিশীল ও আত্মনির্ভরশীল করে। বই বিষণ্নতা দূর করে নিজের মাঝে জীবনবোধ জাগিয়ে তুলতে এবং নিজেকে চিনতে সাহায্য করে। বই মানুষকে নিজের অন্তরাত্মাকে জানতে ও অপরের সামনে নিজের চিন্তাভাবনাকে তুলে ধরতে সাহায্য করে—আরও কত–কী! নোবেল বিজয়ী লেখক জিনেট উইন্টারসন যথার্থই বলেছিলেন, ‘বই এবং দরজা একই জিনিস। আপনি যখন সেগুলি খুলবেন তখন আপনি অন্য জগতে চলে যাবেন।’

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই এবং বই’। কিন্তু আমাদের এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মাঝে বই পড়ার আগ্রহ নেই বললেই চলে। বইয়ের কথা বললেই তারা নাক সিটকায়। আর সাহিত্য আড্ডার বেলায় তাদের অনিহার শেষ নেই। কোনো স্কুলে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে গুটিকয়েক শিক্ষার্থী ছাড়া কাউকে পাওয়া যাবে না যারা নিয়মিত বই পড়ে।

বর্তমান প্রজন্ম বাঙালি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য কিছুই জানে না। এমনকি তাদেরকে যদি বলা হয় বাংলাদেশের দশজন সাহিত্যিক কিংবা লেখকের নাম বলতে অধিকাংশই পারবে না। অথচ আমাদের পূর্বপুরুষরা  ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাহিত্য সম্পর্কে বিশাল পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। বইপড়া নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতাও ছিল রোমাঞ্চকর। তখনকার সময়ে না ছিল প্রাতিষ্ঠানিক লাইব্রেরি সুবিধা। ছিল না প্রযুক্তির আশীর্বাদ। কিন্তু তাদের মাঝে ছিল জ্ঞান আহরণের অতৃপ্ত ক্ষুধা। এই ক্ষুধার নেশায় তারা বই পড়তে যেত কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে। পরিবারের ভয়ে গভীর রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তো। ক্লাসে কিংবা আড্ডায় তাদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল বই।

বই পড়া নিয়ে শিক্ষক, দাদা ও বাবার কাছ থেকে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলাম। তারা বলতেন, প্রায় সময় ক্লাসে লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়ার কারণে সম্পূর্ণ ক্লাস কান ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এছাড়াও রাতে মা-বাবার শাস্তির ভয়ে কাঁথার নিচে লুকিয়ে হ্যারিকেনের আলোতে বই পড়তেন। বর্তমান সময়ে এসব ঘটনা কল্পনাতীত। যদিও এখন প্রাতিষ্ঠানিক লাইব্রেরি, লেন্ডিং লাইব্রেরি, ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি, ই-বুকসহ আরো নানা রকমের সুবিধা রয়েছে কিন্তু শিক্ষার্থীরা বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারে না। মূলত আড্ডা, ঘোরাঘুরি, সেলফি, মোবাইল গেম আসক্তি, টিকটক ভিডিও বানানোতে কেটে যায় এই প্রজন্মের মূল্যবান সময়। বই পড়ার সময় নেই তাদের। পরিণতি? দিনশেষে হতাশা, প্রাপ্তির খাতার শূন্য।

বই নিয়ে বিখ্যাত সাহিত্যিক জনাথন সুইফটের একটি উক্তি আছে। তার মতে ‘বই হচ্ছে মস্তিষ্কের সন্তান’। গবেষকরা বলেন, বই পড়ার সময়ে মানুষের মস্তিষ্কের জটিল কোষগুলো উদ্দীপিত হয় এবং স্নায়ুগুলো উজ্জীবিত হতে থাকে। ফলে বইয়ের ভেতরে থাকা বাক্য ও শব্দগুলো মস্তিষ্কের ভেতর আলাদা একটি জগৎ তৈরি করে। সেখানে তৈরি হয় হাজার হাজার চোখ ও কান। অথচ বর্তমান প্রজন্ম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় এতটাই ডুবে গেছে যে তাদের মস্তিষ্কের ভেতরে মনছবি তৈরি হওয়া বা এ ধরনের মনের ব্যায়াম করার ফুরসতই নেই।

একটা সময় ছিল যখন শিক্ষার্থীদের পিতামাতার লক্ষ্য ছিল তাদের সন্তানদের জ্ঞান অর্জন নিয়ে। কিন্তু বর্তমান পিতা-মাতারা পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়াকে খারাপ চোখে দেখেন। বইয়ের বিরুদ্ধে তাদের রয়েছে ১০১টা অকাট্য যুক্তি। তাদের কাছে বইপড়া মানে সময় নষ্ট। পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বইগুলো ‘বাজে’ বই নামে পরিচিত। তারা তাদের সন্তানদের শুধু এ প্লাস কিংবা ভালো সিজিপিএ পাওয়ার একটি যন্ত্র হিসেবে গড়ে তুলছেন। ফলে ক্লাস কিংবা পরীক্ষার চাপে পড়ে পাঠ্যবইয়ের বাহিরের বৈচিত্র্যময় ও রঙিন পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ বইগুলোর সান্নিধ্য পাওয়ার এতোটুকু সময় তারা পাচ্ছে না। মূলত তাদের পুথিগত বিদ্যা এবং চাকরির বাজারে এগিয়ে থাকার জন্য দম বন্ধ করে মুখস্থ বিদ্যা ছাড়া অন্য কোনো জ্ঞানের অন্বেষণ নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। ফলস্বরূপ এই সমাজ ও দেশ মননশীল, সৃষ্টিশীল, নতুন সময়ের নতুন মানুষ আর পাচ্ছে না!

পৃথিবীতে যত বড় বড় ব্যক্তিত্ব রয়েছে তারা সকলেই বই পড়াকে অন্যান্য জিনিসের তুলনায় গুরুত্ব দিতেন। একজন দক্ষ ও সফল রাজনীতিবিদ হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধুর আলাদা একটা পরিচয় ছিল তিনি একজন সাহিত্যিক। তিনি রাজবন্দি থাকা অবস্থায় তার শ্রেষ্ঠ সঙ্গী ছিল বই।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল নিয়মিত বই পড়তেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সফলতার চাবিকাঠি কী? তিনি উত্তর দিয়েছেন প্রতিদিন পাঁচশ পৃষ্ঠা বই পড়ো।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট বইপড়ার সময় বের করতেন। তার নেশাই ছিল বই পড়া। আপনি জেনে আশ্চর্য হবেন যে, ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ১৯৪৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময়ে তার সংগৃহীত বইয়ের সংখ্যা ছিল ২১০০০। তিনি কলেজে পড়াকালীন সময় থেকেই বই সংগ্রহ করা শুরু করেছিলেন। তিনি অসামান্য দ্রুত গতিতে বই পড়তে পারতেন। তিনি সকালের নাশতার আগেই একটি বই পড়ে শেষ করতেন। তিনি ৩৫টি বই ও ১ লাখ ৫০ হাজারটি চিঠি লিখেছিলেন।

আপনি জেনে আরো অবাক হবেন যে, মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বই পড়ার জন্য দৈনিক ১ ঘণ্টা সময় রাখেন। বিজনেস ইনসাইডারের প্রতিবেদন অনুসারে তিনি বছরে ৫০টি বই পড়ে থাকেন।

নিজেকে জানতে, সমাজকে জানতে, দেশ ও বিশ্বকে জানতে হলে বই পড়তে হবে। অনুরূপ ভাবে দেশ গড়তে চাইলে, দেশকে ভালোবাসলে, নিজেকে ভালোবাসলে, জ্ঞানী হতে চাইলে, আলোকিত মানুষ হতে হলে অবশ্যই বই পড়তে হবে। পরিশেষে এই স্লোগানটি দিয়ে শেষ করতে চাই, ‘পড়িলে বই আলোকিত হই; না পড়িলে বই অন্ধকারে রই।’

লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। 

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article