ভাষান্তর: জুবায়ের রহমান
‘Mindset: The New Psychology of Success’ বইটির লেখক Carol Susan Dweck (জন্ম অক্টোবর ১৭, ১৯৪৬) একজন আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী। তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের লুইস এবং ভার্জিনিয়া ইটন অধ্যাপক। Dweck অনুপ্রেরণা এবং মানসিকতার উপর তার কাজের জন্য পরিচিত। ২০০৪ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে যোগদানের আগে তিনি কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি এবং ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। তিনি অ্যাসোসিয়েশন ফর সাইকোলজিক্যাল সায়েন্সের ফেলো।
বইয়ে লেখক দৃঢ়তা এবং একজন মানুষের অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার জন্য বেশকিছু পন্থা দেখিয়েছেন। তার মতে, আপনার মন-মানসিকতা কেমন, আপনি নিজেকে কীভাবে দেখেন ইত্যাদির উপর গবেষণা করে ক্যারল ডুয়েক নিজের ২০ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেকে কিভাবে চিনতে, বুঝতে এবং নিজের জীবনের সমস্ত দিককে প্রভাবিত করার জন্য একটি মৌলিক পরিবর্তন করতে পারেন সেসব বিষয় তিনি তুলে ধরেন।বইটি ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়। বইটির গুরুত্বপূর্ণ ১০ শিক্ষামূলক বিষয় নিচে তুলা ধরা হলো।
১.
মানসিকতার উন্নতি (গ্রোথ মাইন্ডসেট) কে সব জায়গায় মানিয়ে নেওয়া উচিত সবার। পাশাপাশি অর্জনের চেয়ে বেশি শেখার উপর কড়া নজর দেওয়া উচিত। যখন মানসিক উন্নতির (গ্রোথ মাইন্ডসেট) উপর ফোকাস করা হয় তখন কিছু জিনিসকে সহজভাবে নেওয়া যায়। সচারাচর আমাদের জীবনে যা অনেক কঠিন মনে হয়। যেমন; চ্যালেঞ্জ নিতে না পারা , সংগ্রাম বা লড়াই করতে না পারা, সমালোচনা সহ্য করতে না পকরা এবং বিপদ আসলে সামাল দিতে না পারার মানসিকতা আমাদের মনে গেঁথে আছে। যা গ্রোথ মাইন্ডসেট থাকলে খুব সহজে হয়ে যায়।
কেউ যখন একটি কঠিন বিষয়গুলোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে তখন তারমধ্যে সম্ভাবনা তৈরি হয়। তখন ব্যক্তি যা হতে চায় তা সে ভালভাবে মনে গ্রহণ করে থাকে। আমরা অনেক সময় মনে করি ভাগ্যই আমাদের সবকিছু এনে দিবে। অথবা প্রকৃতি প্রদত্ত প্রতিভা আমাদেরকে এগিয়ে রাখবে। এইসকল চিন্তা থেকে আমরা কখনো আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে পারি না। কিন্তু কেউ যদি ভাগ্য বা প্রকৃতি প্রদত্ত প্রতিভাকে দূরে রেখে নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে তৈরি করার চেষ্টা করে, তাহলে সে খুব দ্রুত তার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারবে। অর্থাৎ প্রকৃতি প্রদত্ত যোগ্যতা দিয়ে কিছুই হয় না, যদি না কেউ মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত রাখতে না পারে।
২.
আপনি কি আপনার মানসিকতা পরিবর্তন করতে পারেন? হ্যাঁ, আপনি পারেন। যেকোন সময় পারেন। বর্তমানে আপনার একটি স্থির মানসিকতা থাকলেও, এটি স্থির করে রাখার কোনো বিষয় না।
মানসিকতার মাধ্যমে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। এটি ব্যক্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। কিন্তু এটি পরিবর্তন করা যায়। যদি কেউ দুই ধরণের মানসিকতা ধারন করে তাহলে সে নতুন করে চিন্তা করতে পারে। এতে তার শেখার নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। তবে ব্যর্থতার তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। তবে ব্যর্থতার গ্লানি টানতে টানতে একসময় যেকোন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে। এ ধরনের মানুষেরা ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে যেকোন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারে।
৩.
মানসিকতার বিকাশ নিজের মধ্যে ধরে রাখতে হবে। মানসিক বিকাশকে একটি আকার দিতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যদি এটি অস্থায়ী হয় তবুও। যেকোনো স্থান বা পরিস্থিতির আলোকেও চালিয়ে নেওয়া উচিত।
মানুষের মানসিকতা কখনো স্থির থাকে না। এটিকে বিকাশের মধ্যে রাখতে হয়। এজন্য মানুষকে নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করতে হয়। যা নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে সহযোগিতা করে৷ কেউ কোন বিষয় সম্পর্কে কম জানলে আমরা সচারাচর ঐ বিষয় সম্পর্কিত বই বা আর্টিকেল পড়তে বলি। এতে করে একজন ব্যক্তি নতুন করে অনেক কিছু জানতে পারে৷ এতে তার মনমানসিকতার পরিবর্তন আসে। এই দক্ষতা বা জ্ঞান বৃদ্ধির কারণে প্রকৃতি প্রদত্ত মেধাবীদের চাইতে অনেক বেশি সৃষ্টিশীল হয়। এমনও হয় যে মেধাবীদের মাথায় সেগুলো ধাক্কাও খায় না। ফলে দক্ষ বা জ্ঞান তাপসী কোন ব্যক্তি অন্য যেকোন ব্যক্তির চাইতে বেশি এগিয়ে থাকে। অর্থাৎ পরিশ্রম যে সাফল্যের চাবিকাঠি সেটিকেই নির্দেশ করে।
৪.
আপনি যখন কোনো বিষয় নিয়ে মনস্থির করেন এবং সেটি করতে চান তখন মানসিকভাবে আপনি ঐভাবেই প্রস্তুত থাকবেন। যেকোন কাজের চাইতে মনস্থির করা কাজটি যদি কঠিনও হয়ে থাকে তবু আপনি সেটিই করতে পছন্দ করবেন।
মানসিকতার বিকাশ আমাদেরকে ভালো কাজে যেমন আনন্দ দেয়, খারাপ সময়েও আনন্দ দেয়। প্রবৃদ্ধি-মনস্ক এথলেটিক্স, সিইও, সঙ্গীতজ্ঞ ও বিজ্ঞান প্রেমিরা প্রত্যকেই তাদের কাজকে পছন্দ করে৷ কিন্তু অনেকেই এসকল সেক্টরে প্রকৃতিগতভাবে দক্ষ হলেও তাদের মনস্থির থাকে না। ফলে তারা এসকল কাজকে ভালবাসে না এবং এসকল কাজে নিজেদের জড়িয়েও নিতে পারে না। শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তি ও প্রচেষ্টার কারণে পরিশ্রমীরা অর্থাৎ যারা চিন্তা করে যে আমাকে এটা হতেই হবে তারাই এসব কাজে টিকে থাকে।
অনেক গ্রোথ মাইন্ডসেট মানুষ ভালো অবস্থানে যাওয়ার পরিকল্পনাও করেননি। তারা যা পছন্দ করে তা করার ফলে তারা সেখানে পেয়েছে। এটা বলতে বিদ্রূপাত্মক হলেও যারা কোনো স্থানে যেতে চায় তারা অনেকটা ক্ষুধার্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে।
৫.
কোনো কাজের ফলাফল যাইহোক না কেন মানসিকতার বিকাশ (গ্রোথ মাইন্ডসেট) সেই কাজকে মূল্যবান করে তোলে।
আপনি কোনো কাজে সফল না হয়েও কোনো কাজে লেগে থাকলে সফল হবেন না। তবে আপনি একটি ভালো পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করলে সফলতা অর্জনের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অর্থাৎ কোনো কাজে লেগে থাকলেই যে সফল হতে হবে এটাই শেষ কথা না। লেগে থাকার মধ্যেও তৃপ্তি আছে। ফলে যেকোন সময় আপনার লেগে থাকা স্বার্থক হয়ে উঠতে পারে। যেমন, সারাবিশ্বে ক্যান্সার নিরাময়ের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু কেউই প্রতিষেধক বের করতে পারেনি। তবে তাদের কাজের মাধ্যমে অনেক অর্থবহ বিষয় উঠে এসেছে। যা লেগে থাকা ছাড়া সম্ভব ছিলো না।
৬.
গ্রোথ মাইন্ডসেট থেকে নিজের সম্পর্ক দেখা। “আপনি কোন কিছু ভাবুন এবং সেই আলোকে নিজের মনে একটি প্রতিচ্ছবি আঁকতে পারেন। যদি এমন হয়, তবে এটাতে কি নিখুঁত সামঞ্জস্যতা জড়িত! কোন মতবিরোধ নেই, কোন আপস নেই, কোন কঠোর পরিশ্রম নেই?
আবার চিন্তা করুন এগুলোতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে গ্রোথ মাইন্ডসেট থেকে এগুলোকে দেখার চেষ্টা করে দেখুন যে এই সমস্যাগুলোকে ভালোভাবে বুঝতে ও ঘনিষ্ঠতা বিকাশের একটি বাহন হতে পারে। এটিকে ভালোভাবে বুঝতে আপনার সঙ্গী বা বন্ধুর সমালোচনা শোনার চেষ্টা করুন। তাকে দুর্বলতা গুলো প্রকাশ করার সাহস দিন, ধৈর্য ও যত্নের সহিত আলোচনা করা প্রয়োজন। এটি যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে তাতে আপনি অবাক হতে পারেন।”
৭.
আপনি যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করছেন তার চেয়ে বেশি শৈল্পিক ক্ষমতা বিকাশ করতে পারবেন। কিছু লোক স্বাভাবিকভাবেই কোনো কিছুতে ভালো হয়ে থাকে। এর মানে এই নয় যে অন্যরা তা করতে পারে না! কখনও কখনও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রকৃতি প্রদত্ত মেধাবীদের চাইতেও ভালো কিছু করা যায়।
“এডওয়ার্ডস নামের এক ব্যক্তি মনে করেন যে, অঙ্কন করতে পারা একটি জাদুকরী ক্ষমতা, যা কেবলমাত্র কয়েকজন মানুষ খুব নিখুঁতভাবে করতে পারে। কারণ অন্যরা অঙ্কন শেখার উপাদানগুলোকে ভালোভাবে বুঝতে পারেন না৷ তারা প্রান্ত, স্থান, আলো এবং ছায়া এবং সমগ্রের উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাখে। অঙ্কনের জন্য আমাদের প্রতিটি উপাদানের দক্ষতা শিখতে হবে এবং তারপরে সেগুলোকে একটি প্রক্রিয়ায় একত্রিত করতে হবে। কিছু লোক তাদের জীবনের স্বাভাবিক গতিপথে এই দক্ষতাগুলিকে সহজভাবে সংগ্রহ করে, যেখানে অন্যদের সেগুলি শিখতে এবং সেগুলিকে একত্রিত করার জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়।”
৮.
আপনি যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করছেন তার চেয়ে শারীরিক দক্ষতা অনেক বেশি বিকশিত হতে পারে।
কখনোই মনে করবেন না যে পৃথিবীর দ্রুতগামী নারী উইলমা রুডলফ এর জন্ম স্বাভাবিক হয়েছিল। মোটেই না।
উইলমা রুডলফ, ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকে স্প্রিন্ট এবং রিলেতে তিনটি স্বর্ণপদক জেতার পরে পৃথিবীর দ্রুততম মহিলা হিসাবে প্রশংসিত হয়েছিল। তবে তার জীবন সংগ্রামের পথটা এতটা মসৃণ ছিলো না।
তিনি তার পিতামাতার ২২ জন সন্তানদের মধে ২০ তম। জন্মের সময়ই তিনি অসুস্থ ছিলেন। চার বছর বয়সেই তিনি দুইবার নিউমোনিয়া আক্রান্ত হোন। এছাড়াও স্কারলেট জ্বর এবং পোলিওর সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ের কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অধিকাংশ সময় তার বাম পা অবশ হয়ে থাকে। তবে ডাক্তাররা তাকে বাঁচার সামান্য আশা দিয়েছিলেন। ফলে একটানা ৮ বছর তার থেরাপি চালাতে হয়েছে এবং ১২ বছর বয়সে স্বাভাবিক হাঁটাচলা শুরু করেন।
৯. পিতামাতা কিংবা শিক্ষকের কথার প্রভাব
পিতামাতা, শিক্ষক ও কোচ সবসময় তারা তাদের কথাবার্তার মাধ্যমে আমাদের মনের মধ্যে প্রভাব ফেলে থাকে। তাদের প্রতিটি কাজ ও শব্দচয়ন আমাদের সামগ্রীক জীবনে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। তারা আমাদের দুর্বলতাগুলোকে চিহ্ণিত করতে পারে এবং সে অনুসারেই পরামর্শ দিয়ে থাকে। তাদের এসকল কাজ মানসিকতার উন্নতির দিকেই আমাদের ধাবিত করে।
আমরা প্রায় সময়ই শিশুদের কাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত প্রশংসা করে থাকি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসকল প্রশংসা তাদের কর্মদক্ষতাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে তুলে। শিশুরা যখনই কোনো ভুল করে থাকে তখনই তাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়ে থাকে। ফলে তাদের অতিরিক্ত প্রশংসা না করে তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে হবে। এতে ভবিষ্যত চলার পথ নিজেরাই তৈরি করে নিতে পারবে।
১০.
আমাদের যে বিষয়ে আগ্রহ থাকে সেগুলোকে নিজেদের ক্ষমতার মাধ্যমে তুলে ধরে থাকি। আপনি যা করতে সক্ষম তা স্থির মানসিকতায় আটকাতে দেবেন না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জের কাজগুলো কখনোই করতে পারতাম না যদি না আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ না হতাম। পৃথিবীতে যেসকল নামকরা বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে মানুষের পথচলা এবং চিন্তাভাবনা এতটা সহজ করেছে তা করতে পারেনি। বরং এতে ছিল চূড়ান্ত ত্যাগ এবং দৃঢ়তা।
এরকম যেকোনো সাফল্য অর্জনে স্থির মন-মানসিকতা লক্ষ্য অর্জনে উৎসাহ যোগায়।
সুতরাং সমাজের প্রচলিত শৃঙ্খলাকে ভেঙ্গে ফেলুন। আপনি যা করতে সক্ষম তাই করে ফেলুন। তাই স্টিভ মারাবোলির ভাষায় বলতে হয়, “একবার আপনার মানসিকতা পরিবর্তিত হলে, বাইরের সবকিছু তার সাথে বদলে যাবে।”
লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।