মো. রনি খান:
ভাদ্রের শেষে তীব্র গরমের পর প্রশান্তির বৃষ্টি যেনো মনকে শীতল করে গেল। এবারের ভাদ্রের গরমের তীব্রতা ছিল অন্যন্য বছরের তুলনায় অনেক গুন বেশী। বৃষ্টির দেখাও মিলেছে খুব কম। সব মিলিয়ে দুর্বিষহ গরমের সম্মুখীন হতে হয়েছে বাংলাদেশের বেশীরভাগ অঞ্চলকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল খুব ভালোভাবেই টের পাচ্ছে বাংলাদেশ।
জনবহুল দেশ হওয়ার কারনে ক্রমেই বিলীন হচ্ছে প্রাকৃতিক বনভূমির পরিমাণ। যার ফলে কাটা পড়ছে গাছ। গাছ পালা কমে গেলে বৃষ্টিপাতের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমার নিজের গ্রামে আমি একটাও শতবর্ষী গাছ খুজে পাই না এখন। আমার ছোটোবেলায় যেটি চারপাশের খুবই সাধারন ব্যাপার ছিল। আমরা সবাই এখন পুরনো গাছগুলোকে কেটে নতুন গাছ লাগাই অধিক ফল উৎপাদনের জন্য।
কিন্তু আমরা ভুলে যাই এই বর্ষীয়ান গাছগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কতটা গুরুত্ব বহন করে। অধিক লাভের আশায় কৃষকরা এখন বিদেশী বিভিন্ন ফল ও নানা জাতের গাছের প্রতি বেশী ঝুকছে, পরিবেশের অভাবনীয় বিপর্যয়ে যেটি নতুন মাত্রা যোগ করছে। কারন এসব গাছ নতুন হওয়াতে বাস্তুসংস্থানে এদের কারনে তৈরী হচ্ছে নানা রকম অসংগতি। অল্প দিনে ফল লাভের আশায় মানুষজন এসব বিদেশী জাতের খাটো চারা রোপন করছে দেশী জাতের লম্বা চারার জায়গায়। এতে করে একটি অঞ্চলের উঁচু ও বিস্তৃত গাছের পরিমান ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
যেমন বিভিন্ন জাতের আমের চারা, নারকেল গাছের চারা পেয়ারার চারাসহ আরও বিভিন্ন প্রজাতির বিদেশী ফলের গাছের প্রতি মানুষ ঝুকছে বেশী। অনেক কৃষক মনে করেন অল্প জায়গায় চাষ করা যায় বলে অধিক লাভবান হন তারা। একটি বড় আমগাছের জায়গায় তারা ছোট দশটা আমগাছ লাগাতে পারেন এবং তা তাদের লাভের কারন হিসেবে দেখছেন তারা। তবে বাস্তবতার নিরিখে কতটুকু লাভবান হচ্ছেন তা সত্যিই অনেক কৃষক জানেন না।
সবাই এই বামন জাতের বিদেশী ফল গাছগুলোর ব্যাপক বানিজ্যিক সম্ভাবনাকে গুরুত্বের সাথে নিচ্ছেন।এ ব্যবস্থার কারন হলো নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর পরিবেশ বিষয়ক জ্ঞানের প্রচন্ড অভাব। অথবা অল্প সময়ে অধিক লাভের আশায় এর ক্ষতির দিকটি বিবেচনা করছে না।
প্রথমত বড়গাছগুলো যে উচ্চতায় পৌছায় সেই উচ্চতায় যদি আর কোনে গাছ না থাকে তবে নির্দিষ্ট ঐ এলাকার বায়ুপ্রবাহে তার সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে ।আবার বায়ুপ্রবাহের সাথে গাছের জলীয়বাষ্প নিঃসরনের একটা সম্পর্ক আছে তাই একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় গাছ না থাকলে নানাদিক থেকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে আমাদের স্থানীয় আবহাওয়া ও জলবায়ুর নানা ঘটনার ক্ষেত্রে। একইভাবে বলা যায়, ঝড় ঝাপ্টা থেকে বাচতে উচু গাছের বিকল্প নেই ।সুন্দরবন যার প্রকৃষ্ট উদাহরন। আমাদের গ্রামে কিন্তু এক সময় ঝড়ের হাত থেকে বাচতে বাড়ির খোলা দিকে বাঁশঝাড়, আম, জাম, কাঠাল ইত্যাদি গাছ লাগানোর প্রচলন ছিল। এখনও কিছু বাড়িতে সেটি চোখে পড়লেও বেশীরভাগ গ্রামবাসীও ঝুঁকছে ছোট জাতের গাছের দিকে।
দ্বিতীয়ত আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করার মত। তা হল, এই ছোট গাছের শেকড় অবশ্যই স্বাভাবিক ভাবেই বড় গাছের মত গভীরে যেতে পারবে না। যার কারনে ছোট গাছ মাটির খুব উপরের স্তর থেকে পানি শোষণ করবে। যেখানে একটি বড় গাছের শিকড় মাটির খুব গভীর থেকে পানি শোষন করবে। এতে করে মাটির উপরের স্তরে পানির অভাব দেখা দিবে খুব সহজে। যা রোধে আগাছা গুলোকে সবসময় কেটে ফেলবে কৃষকরা। কিন্তু বাস্তুতন্ত্রে বিভন্ন কীটপতঙ্গ ও ছোট প্রাণীর বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে আগাছারও প্রয়োজন আছে। আবার বড় গাছ ভূমি ক্ষয়ের মাত্রাকে যে মাত্রা রোধ করতে পারবে ছোট গাছগুলো সেই ক্ষমতা অর্জন করতে অনেক বছর লাগবে।
তৃতীয়ত একটি বড় গাছে অনেক প্রাণী তাদের আশ্রয় গ্রহন করতে পারে। তারা নিরাপদে খাবার খেতে পারে সেখানে থেকে। কিছু পাখি এবং প্রানী আছে যারা নির্দিষ্ট উচ্চতার গাছ না হলে প্রজনন করতে পারে না। যেমন নানা প্রজাতির বক, টিয়া, চিল, শকুন ইত্যাদি পাখি। দিন দিন এই পাখিগুলোর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। যার একটা কারন হিসেবে এদের বসবাসের যায়গার সংকটকে দায়ী করছে অনেক প্রাণীবিদরা।
দেশী ফলের গুণগত মানের কথা আমরা সবাই কমবেশী জানি। তবে এবার দেশী গাছকে বাচানোরও দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের। দেশী গাছকে বাঁচাতে সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরকে প্রচারণা আরও জোরদার করতে হবে। এছাড়া পরিবেশ বিষয়ক সামাজিক সংস্থাগুলোকেও এ বিষয় নিয়ে কাজ করার পরিবেশ তৈরী এবং উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশী জাতের গাছ গুলোকে বাঁচালে বাচবে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র আর বাচব আমরা।
ভাষান্তর: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।