28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

আমাদের তরুণ প্রজন্মের সংকট যেখানে

Must read

জুবায়ের রহমান:

স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন আমাদের বৃহৎ সম্ভাবনাময়ী তরুণ প্রজন্ম। ফলে সময়টা এখন আর তাদের পক্ষে নেই। সাম্প্রতিক সময়ে সমাজে কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যার প্রভাবে এই প্রজন্ম এবং আমাদের সমগ্র সমাজব্যবস্থা বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। কিন্তু এমন সংকটকালেও তাদের নতুন ভোরের ঠিকানা বাতলে দেবার যেন কেউ নেই। ক্রমশ এই বৃহৎ প্রজন্ম ঘোর অন্ধকারে হারিয়ে যাবার পথে।

বরং অপরাধের প্রতিযোগীতায় আমাদের উঠতি বয়সী কিশোররা সম্প্রতি সমাজের রাজনৈতিক নেতাদের নজরে পড়েছে। আমাদের দেশীয় রাজনীতির হাল ছাল সম্পর্কে যারা কিছুটা অবগত আছেন তারা এই গুরুতর অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে বুঝতে পারবেন। ছোট ছোট অপরাধমূলক কাজের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ তাদের চিহ্নিত করেন। এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে এই কিশোরদের ব্যাবহার করেন। কৌতুহলের বসে এমন কিছু দুঃসাহসিক কাজ তারা করে ফেলে, যার ফলাফল ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ই হতে পারে। তবে বেশিরভাগই নেতিবাচক হয়ে থাকে।

আবার কিশোর অপরাধের বিষয়ে বাংলাদেশের আইনের বেড়াজালে তারা সংশোধনের আশায় পার পেয়ে যায়। এতে অনেকে সংশোধন হয়, আবার অনেকে এসবকেই জীবনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। বস্তত ঠিক এই সময় থেকেই তরুণরা পথ হারাতে শুরু করে।

সহজলভ্যতা এবং সাহচর্যের প্ররোচনায় অল্প বয়সেই প্রথমে তারা সিগারেট, তারপর অন্যান্য মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে৷ একটা সময়ে মাদকের অর্থ যোগাতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে এবং দিগ্বিদিক মাদকের অর্থ জোগাড়ে তারা বিভিন্ন অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। তখনই তাদের হাত করে নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। তাদের হয়ে তরুণরা সমাজে চালায় বিভিন্ন নাশকতা। আবার কেউ কেউ অবৈধ অর্থ সংগ্রহের নেশায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে দ্বিধা করে না।

খুব বেশিদিন হয়নি আমাদের দেশে মাদক সহজলভ্য হয়েছে। এক দশক আগেও সমাজে মাদকের তেমন আধিপত্য ছিলোনা। বর্তমান সময়ে এসকল কিশোররা চলাচলের সময় সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে নিজেদের শৌর্যশালী হিসেবে প্রমাণ করতে চায়। তাদের মনে কোন ভীতি কাজ করে না। বরং এটি যেন আধুনিকতার বহিঃপ্রকাশ। অবস্থাটা এমন যে, কেউ বাধা দিলে তারা দলবদ্ধ হয়ে পেশিশক্তির চর্চা করতে পেছনে ফিরে তাকায় না।

আরেকটি দিক হল, অপরাধ এবং মাদকাসক্তিতে ডুবে কিশোরদের একটি অংশ শিক্ষা-কার্যক্রম থেকে দূরে সরে যায়। তারা মাদকের অর্থ জোগাড়ে বিভিন্ন দিনমজুরের কাজ করতে দ্বিধা করেন না। শহুরে কিংবা গ্রামীণ পর্যায়ে একজন দিনমজুর অটো চালকের দৈনিক উপার্জন ৫শ থেকে ৮শ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে এসকল কিশোরেরা সেই অটো চালকের ভূমিকায় নিজেদের নিয়োজিত করে।

বিশেষত গ্রামীণ স্তরে দিন মজুরির অর্থে নিজেদের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার বিপরীতে কিশোরদের মাদকের অর্থের জোগান দেয়া একটি ট্রেন্ড হয়ে দাঁডিয়েছে।

যে বয়সের কিশোররা এখন বাজার কিংবা গ্রামের প্রধান সড়কগুলোতে প্রকাশ্যে ধুমপান করে, কেউ কিছু বললে তেড়িয়ে আসে, গত এক দশক আগেও পরিস্থিতি এমন নাজুক ছিলোনা। চলনে ভদ্রতা, মুখে সালাম দেয়া, ব্যক্তির স্ট্যাটাস ও বয়স অনুসারে মর্যাদা দেয়া ছিলো সমাজের প্রচলিত রীতি। অথচ আজকের দিনে এসকল কায়দা কানুন প্রায় অসম্ভব কিছু।

রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দলের নাম ভাঙ্গিয়ে নাশকতা, হুমকিধামকি, ঝগড়া বিবাদ লাগিয়ে দেওয়া সংস্কৃতির উত্থানও খুব বেশিদিন হয়নি। অল্প বয়সী তরুণরা নিজেদেরকে এসকল কার্যক্রমে জড়িয়ে লেজুড়বৃত্তির চর্চা স্কুল কলেজেই শিখে নিচ্ছে৷ ফলে নেতাদের অযৌক্তিক কাজকর্ম ও বক্তব্যকে সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার বাইরে রেখে মেনে নেওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিত্বের বালাইটুকুও আর টিকে থাকছেনা তাদের মাঝে।

বর্তমান সময়ে মানুষের বয়স, যোগ্যতা, শিক্ষার মূল্যায়ন সমাজে একেবারে নেই বললেই চলে। লেজুড়বৃত্তির কারণে স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতাদের বাধ্যগত হয়ে কাজ করেন। গণমাধ্যমের কল্যানে বিভিন্ন সময়ে আমরা সেগুলো দেখতে পাই। ফলে সমাজে রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই তরুণদের কাছে সম্মানের ও আদর্শে ব্যক্তি হয়ে উঠছে খুব সহজে।

একইসাথে সমাজে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম বৃদ্ধির অন্যতম কারণও মাদকের আগ্রাসন এবং অবৈধ অর্থের মোহ। জনমনে ভীতির সঞ্চারের পাশাপাশি তারা সমাজ জুড়ে চালায় ত্রাসের রাজত্ব। দেশে কিশোরদের দ্বারা যে পরিমাণ অপরাধ সংগঠিত হয় তার সিকিভাগ মিডিয়ায় উঠে আসে। নিয়মিত চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো হরহামেশা ঘটলেও শুধুমাত্র হত্যার মতো গুরুতর অপরাধের খবরগুলো গণমাধ্যমে উঠে আসে।

গত দুই দশক আগেও তরুণ প্রজন্মের পছন্দের কার্যক্রম ছিলো গ্রামের মাঠে খেলাধুলা করা, বই পড়ার প্রতিযোগিতা, পাঠাগার প্রতিষ্ঠা, গানের চর্চা, ভ্রমণ এবং অন্যান্য সামাজিক কার্যক্রমে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখা। বাদবাকি সময় শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়ির গৃহস্থালির কাজকর্মে সহায়তা করা। এরমধ্যে স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও বার্ষিক বনভোজন ছিলো উৎসব আমেজের বিশেষ দিন।

তবে বর্তমানে সময়ের বড় সংকটে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। দিগ্বিদিক উশৃংখলতা এবং অসামাজিক কার্যকলাপের বেড়াজালে প্রজন্মটি নিজেদের আগত সুন্দর ভবিষ্যতকে হারিয়ে ফেলছে। কৈশোরে পা রাখা কৌতূহলী প্রজন্মটি অনেক সময় পাশ্চাত্যের ভাবধারায় আকৃষ্ট হলেও প্রকৃতপক্ষে ভুলবশত গন্তব্য হারিয়ে ফেলছে। কারন পাঠের সংস্কৃতির বিপরীতে তারা পেশি শক্তির চর্চায় অধিক মগ্ন থাকে। আবার প্রযুক্তির অধিক সহজলভ্যতার দরুন উপযুক্ত দিকনির্দেশনা না পেয়ে পথ হারিয়ে ফেলছে অনায়সে। ফলে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে ব্যার্থ হচ্ছে তারা। অসাবধানতার জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়েও অনেকে কম্পিউটারের স্পেস বাটনের সাথেই পরিচিতি হতে পারছেন না।

স্মার্টফোন আসার আগে প্রজন্মটি অজানা বিষয়ে জানার আগ্রহ থেকেই বই, ম্যাগাজিন, পত্র-পত্রিকায় মনোযোগ দিতো। এখনকার দিনে স্মার্টফোন এবং আধুনিক প্রযুক্তির কল্যানে এসম্পর্কিত জ্ঞান আরও গভীরে গিয়ে গ্রহণ করার কথা থাকলেও বস্তুত তারা সেটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সমাজে বিভিন্ন ধরণের অসামাজিকতা উল্লেখিত কারনে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব ও সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে বাড়ছে অনৈতিক কার্যক্রমও। ফলে হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি সমাজে বেড়েই চলেছে। আত্মহত্যা ও ডিভোর্সের বৃদ্ধির অন্যতম কারণ অপসংস্কৃতির চর্চা ও মাদকের আগ্রাসন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে একই কারণে।

প্রজন্মের যখন এই অবস্থা, তখন সমাজ পরিবর্তনের তাগিদে এগিয়ে আসছেন না কেউ। আবার সমাজ পরিবর্তনে যাদের অসামান্য অবদান রাখার কথা সেই নতুন প্রজন্মই এমন নাজুক পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত। বরাবরের মত যারা সমাজের মাদক নির্মূল ও অপসংস্কৃতি রোধে ভূমিকা রাখার কথা, তারাই সেসবের প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখছে বেশি।

আমাদের দেশের সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলগুলো মাদকের নিরাপদ আবাসস্থলে পরিণত হবার খবর নতুন নয়। গণমাধ্যমের কল্যানে সেটি প্রকাশিত হয় বিভিন্ন সময়ে। শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই এখানে এসে ধুমপান শিখে ও পরবর্তীতে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের এমন আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি থেকে ফিরিয়ে আনতে তেমন কোন উদ্যোগ লক্ষনীয় নয়। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হিসাবে প্রচলিত। ধূমপানের বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি আইন উল্লেখ করা থাকলেও সেটি মেনে চলার তাগিদ দেখা যায়না।

বরং এসকল প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শিক্ষক, কর্মকর্তাদের মাঝে অনেকে ধূমপান করেন নিয়মিত। বলতে দ্বিধা নেই, প্রায় প্রতিটি ছাত্রনেতার দেহেও এমন ভয়ংকর মাদক বাসা বেঁধে আছে। অর্থাৎ যারা সমাজের হাল ধরার কথা, তারাই সবার আগে নিজেদের হাল ছেড়ে দিয়ে অন্যদের সুযোগ করে দিয়েছে।

তবে এভাবে যদি সমাজ চলতে থাকে আমরা খুব শীঘ্রই একটি গুনেধরা মেধাহীন জাতিতে পরিণত হব। পাশ্চাত্যের লোকদেখানো ভদ্রতা আমাদের পেয়ে বসবে। তবে পাশ্চাত্যের সভ্যতার উপর আঙ্গুল তোলার কিছু নেই। পাশ্চাত্য সভ্যতাই আমাদের শাসন করে চলছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। তবে আমাদের ভঙ্গুর মানসিকতা সেই সভ্যতার উর্বর রীতিনীতি গ্রহণে নিজেদের ব্যার্থতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। ফলে আমরা নিজেদের গুনেধরা জাতিতে পরিণত করেছি। তবুও এই সকল সমস্যা সমাধানে সর্বশেষ কর্ণধার হয়ে  যদি রাষ্ট্রও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যার্থ হয় কিংবা এগিয়ে না আসে তাহলে সমাজকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না৷

সমাজের অবস্থা যখন এই টানাপোড়েনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে তখন বলতেই হয়, ‘আমরা সবই জেনেছি, সবই বুঝেছি। কিন্তু কিচ্ছু করিনি, কিচ্ছু করবোও না।’

লেখকঃ শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article