28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

‘হরিজন’- পরিচ্ছন্ন রাখতে যাদের জীবন কাটে অপরিচ্ছন্নতায়

Must read

মুতাসিম বিল্লাহঃ

‘বছরের বারোমাসের রুটিন হলো গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন আমরা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন অভিযান শুরু করি। কিন্তু আমাদের জীবন কেটে যায় অপরিস্কার, স্বাস্থ্যহীন পরিবেশের মধ্যেই,  পোকামাকড়, বিষধর জন্তু, অপরিচ্ছন্ন এলাকা যেখানে কোনো মানুষ স্বেচ্ছায় বিচরণ করতে চায় না, সেখানেই আমরা বিচরণ করি’, এমনটিই বলছিলেন জিতেন দাস, (৪০)। সবই করেন শুধুমাত্র যাপিত জীবনে একটু খেয়ে পড়ে ভালো থাকার জন্য।

অপরদিকে শিক্ষার দিকে না এসে পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া কাজের উপর ক্যারিয়ার গড়াটাও এখন হরিজনদের জন্য চ্যালেঞ্জ। এমনটিই জানালেন ৬০ বছর বয়সী বাবু দাস। তার অভিযোগ ২০১২-১৩ সালে প্রকাশিত গেজেটে সুইপার পদের নিয়োগে হরিজনদের মধ্য থেকে ৮০% কোটা থাকলেও বাস্তবে হরিজনদের নিয়োগ দেওয়া হয় না। বর্তমানে সব শ্রেণির মানুষের জন্য এ কাজের সুযোগ করে দেওয়ায় সেখানেও দক্ষ ও অদক্ষতার কথা বলে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়, দাবি তার। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে ওঠা অনেক ক্লিনিং কোম্পানিও তাদের চাকরি না পাওয়ার কারণ।

পূর্বপুরুষদের পেশা থেকে বের হয়ে নতুন জীবন গড়ার স্বপ্নে উচ্চশিক্ষার পেছনে লেগে থাকেন রুবেল। শেখ বোরহান উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে অর্নাস ও ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর করেছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন এবার হয়ত প্রত্যাশীত স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তু চাকরি খুঁজতে গিয়ে বারবার আঘাত পেতে হয়েছে তাকে। কাঙিক্ষত চাকরি তার হাতের মুঠোয় আসেনি। রুবেলের অভিযোগ, ‘সনদপত্র আর জীবন বৃত্তান্ত দেখে পূর্বপুরুষদের পরিচয় জানার পর কর্তৃপক্ষ তাকে আর চাকরি দিচ্ছে না।’

২৮ বছর বয়সী রুবেল এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। তবে সে প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে চাচ্ছেন না তিনি। তার অভিযোগ ‘আমরা শিক্ষিত হলেই বা কি আর না হলেই কি!’ আমাদের পরিচয় জানার পরে মানুষ আমাদের সাথে বর্ণবৈষম্যর আচরণ করে, এমনটিই দেখে এসেছি ছেলে বেলা থেকে, বলেন তিনি।

পুরান ঢাকার আগাসাদেক রোডের মিরনজল্লাতে রুবেলের বসবাস। এখানে তার মতো আরও ১৫ হাজার সুইপার (হরিজন সম্প্রদায়ের) মানুষ বাস করে। যারা পেশায়, মেথর। এমনকি ১৯৭১ সালে মিরনজল্লার ১০জন হরিজন জনগোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। তাদের পূর্বপুরুষদের থেকে এ পর্যন্ত এ পেশাকেই তারা যাপিত জীবনের জন্য মেনে নিয়েছেন। ব্রিটিশ আমলে হরিজনদের বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন গোটা বাংলাদেশে।

রুবেল জানায় এই মিরনজল্লা কলোনীতে তার মতো আরও অনেক যুবক আছেন কেউ আর্কিটেকচার, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, ডিজাইনার, গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করা। এবছরের এসএসসি পরীক্ষায় ২১জন শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়েছে। কিন্তু যখন কোনো প্রতিষ্ঠান জানতে পারেন এরা সুইপার কলোনি থেকে বেড়ে ওঠা তখন আর তাদেরকে কেউ চাকরিতে নিতে চায় না।

১৫ হাজার সদস্যর মিরনজল্লা হরিজন সম্প্রদায়ের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হয় ‘হরিজন সেবক সমিতি’ ও তাদের পঞ্চায়েত কমিটির মাধ্যমে। হরিজন সেবক সমিতির সিনিয়র সহ সভাপতি ও হরিজন ঐক্যপরিষদের কেন্দ্রিয় কমিটির যুব ও ক্রিড়া বিষয়ক সম্পাদক কৃষ্ণচরণ বলেন, এ কলোনিতে সরকারি স্বাস্থ্য সেবা পর্যাপ্ত নয়, জনসংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না তাদের থাকার জায়গা। প্রতি সপ্তাহে শুধু নারীদের স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে থাকে প্লান বাংলাদেশ নামের একটি এনজিও। তাই সকলের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত সেবা নিশ্চিত করতে একটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকের সহায়তা চান তিনি। তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক বাল্য বিবাহ কমে এসেছে এখন এই কলোনিতে। শিক্ষার জন্য ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত মিরনজল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত। এখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় পঞ্চায়েত কমিটি ও সেবক সমিতির মাধ্যমে তাই এখানে অপরাধ সংগঠিত হওয়ার হার তুলনামুলক কম বলছিলেন তিনি।

সমিতির সাধারণ সম্পাদক শ্রী নির্মল চন্দ্র দাস, বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা ১৮২৬ সালের সময় থেকে এ অঞ্চলে বসবাস করছেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা সিটি কর্পোরেশনের চাকুরিগুলো পাচ্ছি না। অথচ এ চাকুরিগুলো পাওয়া আমাদের অধিকার।

বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি চন্দ্রনাথ বলেন, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ প্রায় ১৫ লাখ হরিজন জনগোষ্ঠীর বসবাস। দেশের  ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা’ করে মানুষের সুস্বাস্থ্য রাখার পবিত্র দায়িত্ব পালন করছি। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এই জনগোষ্ঠী ভূমিহীন। সরকারি কলোনিগুলোয় গাদাগাদি করে মানবেতরভাবে জীবন-যাপন করতে হচ্ছে আমাদের।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article