28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

গাজায় বোমা হামলা: বাস্তুচ্যুত আরেকটি ফিলিস্তিনি প্রজন্ম

Must read

জুবায়ের রহমান

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের আক্রমণের পর ৮ অক্টোবর থেকে গাজায় আক্রমণ শুরু করেছে দখলদার ইসরায়েল সেনাবাহিনী। এমতাবস্থায় বোমা হামলায় প্রায় ১৪ লক্ষ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে বাস্তুহারা হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। যাদের অধিকাংশ বর্তমানে জাতিসংঘের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় চেয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ এটিকে ‘বিপর্যয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

হঠাৎ করে জাতিসংঘের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুতদের এমন ভীড় পানি, খাবার, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চরম সংকট ফেলেছে। যা নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলোও গভীরভাবে উদ্বিগ্নতা এবং আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

তবে বর্তমান সময়ে ফিলিস্তিনের বাস্তুচ্যুত শরণার্থী সংকট নতুন করে বিশ্বব্যাপী চিন্তার খোরাক তৈরি করেছে। কারণ এই ধরনের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা ফিলিস্তিনে এই প্রথম নয়। আর ইতিহাসের প্রথম দিকেই ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমানে ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা প্রায় ৫৯ লাখ।

একজন নৃতাত্ত্বিক ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতের উপর ‘মেমফিস বিশ্ববিদ্যালয়’র নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক মাইকেল ভিসেন্ট পেরেজ তার দীর্ঘ ২০ বছরের পর্যবেক্ষণ করে বলছেন, রাষ্ট্রহীন উদ্বাস্তু এসব ফিলিস্তিনি তাদের স্বদেশে ফিরে যেতে এবং তাদের অধিকার গ্রহণ করতে ইচ্ছুক না।

ভয়, সহিংসতা এবং দেশত্যাগ: ১৯৪৮ সালের নাকবা

ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের অধিকাংশই আজ জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থা, (UNRWA) থেকে সাহায্য পায়। জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন এবং ফিলিস্তিন অধিকৃত অসংখ্য শরণার্থী শিবির থেকে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছে। বাকিরা আশেপাশের শহর ও নগরে আশ্রয় নিয়েছে।

ফিলিস্তিনের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা একটি ক্রমশ চলমান এবং একটি কারণে এটিকে কমানো যাবে না। তবে বেশিরভাগ উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনি ইতিহাসের দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার মাধ্যমে তারা তাদের উদ্বাস্তু হওয়ার শিকড় খুঁজে পায়। একটি হলো “নাকবা” এবং অপরটি হলো “নাকসা।”

আরবি শব্দ নাকবা এর প্রতিশব্দ হচ্ছে বিপর্যয়। শব্দটি ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টির সময় প্রায় ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতকে বুঝিয়ে থাকে।

প্যালেস্টাইনের আরব জনসংখ্যার বেশিরভাগই যুদ্ধের সময় তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে অস্থায়ী আশ্রয়ের সন্ধান করেছিল। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পরে ফিরে আসার আশা করেছিল।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক দেশত্যাগের ফলে অঞ্চলটিতে দুটি বাস্তবতা দেখা গেছে। প্রথমত প্রায় ২৫ হাজার ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের সীমানার মধ্যেই বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। তারা বর্তমান ইসরায়েলে বর্তমান সীমানা অতিক্রম না করার কারণে সেই সময়ে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে শরণার্থী মর্যাদা পায়নি। তার পরিবর্তে তারা ইসরায়েলি নাগরিক হয়েছিলেন, এবং বর্তমানে ইজরাইল নিজস্ব আইন তৈরি করে তাদের আলাদা করে রেখেছে।

এই আইনের মাধ্যমে তারা বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে। পাশাপাশি তাদের পৈত্রিক বাড়ি ও গ্রামে ফিরে যাওয়ার অধিকার বাতিল করেছে।

দ্বিতীয়ত যখন ৭০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের ডি ফ্যাক্টো সীমানা ছাড়িয়ে পালিয়ে গিয়েছিল তারা জাতিসংঘের অধীনে আনুষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী মর্যাদা অর্জন করেছিল। উদ্বাস্তুদের এই দলটি ফিলিস্তিনের নাবলুস এবং জেনিনের মতো ইহুদি বাহিনীর দ্বারা অবিজিত অঞ্চল এবং জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন ও মিশরসহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিতে আশ্রয় চেয়েছিল।

১৯৪৯ সালে UNRWA তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার অধীন ছিল এসব ফিলিস্তিনিরা। পরে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে সরাসরি ত্রাণ কার্যক্রম এবং শরণার্থী শিবিরের অবকাঠামো পরিচালনার জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ক্ষুদ্রঋণ ও চাকরির প্রশিক্ষণ সহ অন্যান্য পরিষেবা প্রদান করার পাশাপাশি UNRWA শরণার্থী শিবির উন্নয়ন প্রকল্পে রাস্তা নির্মাণ এবং ক্যাম্পে গৃহ নির্মাণের মাধ্যমে সহায়তা করেছিল।

জর্ডান, মিশর এবং সিরিয়ার উদ্বাস্তু: ১৯৬৭ সালের নাকসা

ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল-আরব যুদ্ধের সময়ে। যা ফিলিস্তিনিদের কাছে আল নাকসা বা ‘‘বিপত্তি’’ নামে পরিচিত।

একদিকে ইসরায়েল এবং অন্যদিকে সিরিয়া, মিশর ও জর্ডানের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল তার ফলে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট অঞ্চলগুলো দখলে নেয়। এগুলো হলো পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা। এছাড়াও দেশ তিনটির কিছু ভূখণ্ড দখল করে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধের সময় প্রায় ৪ লাখ ফিলিস্তিনি পশ্চিম তীর এবং গাজা থেকে প্রাথমিকভাবে জর্ডানে বাস্তুচ্যুত হয়েছিল এবং ছয়টি নতুন UNRWA শরণার্থী শিবিরের একটিতে তাদের রাখা হয়েছিল।

অন্যান্যরা মিশর ও সিরিয়ায় আশ্রয় পেয়েছিল। ১৯৬৭ সালে বাস্তুচ্যুত হওয়া ফিলিস্তিনিদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি ১৯৪৮ থেকে শরণার্থী ছিল এবং এইভাবে দ্বিতীয়বার জোরপূর্বক অভিবাসনের শিকার হয়েছিল। ঠিক যেমন ১৯৪৮ সালে, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ শেষ হলে, ইসরায়েলি সরকার কোনো শরণার্থীর প্রত্যাবর্তন বন্ধ করে দেয় এবং ইমাউস, ইউলা এবং বেইট ইউবা সহ অধিকৃত ভূখণ্ডের বেশ কয়েকটি ফিলিস্তিনি গ্রাম ধ্বংস করে দেয়। তাদের ধ্বংসযজ্ঞের পর এই অঞ্চলগুলো ইহুদি ইসরায়েলিদের কাছে লিজ দেওয়া হয়েছিল।

আল-নাকবা এবং আল-নাকসার বাইরে বাস্তুচ্যুত

নাকবা এবং নাকসার মতো ঘটনাগুলো ছাড়াও বিভিন্ন কারণে ফিলিস্তিনিদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে। বর্তমানে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার অন্যতম উল্লেখযোগ্য কারণ হল ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দিচ্ছে।

দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৯ হাজারেরও বেশি ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে ইসরায়েল। সাম্প্রতিক যুদ্ধেই শুধু ১৪ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তু ছাড়া হয়েছে।

আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ১৯৯০ সালে সাদ্দামের নেতৃত্বে কুয়েত দখল চেষ্টা করলে ফিলিস্তিনি জাতীয় সংগঠন, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন তাতে সমর্থন দেয়। পরে এর প্রতিশোধ হিসেবে কুয়েত ৩ লাখ ফিলিস্তিনিকে কুয়েত থেকে বাস্তুচ্যুত করে।

২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি শরণার্থী দেশ ছেড়ে প্রাথমিকভাবে তুরস্ক এবং জর্ডানে পালিয়ে যায়। আর অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল আরোও প্রায় ২ লাখ ফিলিস্তিনি।

অনেকেই শরণার্থী, বহু নির্বাসিত

যেহেতু ফিলিস্তিনিরা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সরকারের অধীনে বাস করে, কোনো একক অভিজ্ঞতা তাদের নির্বাসনের অভিজ্ঞতার জন্য দায়ী করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, জর্ডানে এক নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের অসংখ্য গ্রুপে বিভক্ত করা যেতে পারে এবং প্রতিটির নিজস্ব সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ আলাদা আলাদা।

১৯৪৮ সালে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা জর্ডানের নাগরিক হয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো মৌলিক বিষয়গুলোর জন্য UNRWA-এর উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও ১৯৬৭ সালে গাজা উপত্যকা থেকে যেসব বাস্তুচ্যুত শরণার্থী রয়েছে তাদের কোনো নাগরিকত্ব নেই। ফলে কিছু নাগরিক রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অতি সম্প্রতি সিরিয়া থেকে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের জন্য জর্ডানে চলাচল ও কাজের সুযোগ কঠোরভাবে সীমিত করা হয়েছে।

জর্ডানের ওপারে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরাও আলাদা পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। পশ্চিম তীরে আনুমানিক ৯০ হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থী ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অধীনে বাস করে। আর একে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বর্ণবৈষম্য বলে উল্লেখ্য করেছে।

হামাস-শাসিত গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা, যাদের সংখ্যা আজ প্রায় দেড় মিলিয়ন। বর্তমানে ইসরায়েল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ১৬ বছরের অবরোধের মধ্যে বসবাস করছে কিন্তু মিশরীয় সরকার দ্বারা সমর্থিত। ২০০৭ সালে বন্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা, মানুষের চলাচল এবং বিদ্যুতের মতো মৌলিক সংস্থানগুলিতে সহজে সুবিধা না পাওয়ায় ফিলিস্তিনিদের জন্য ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। যার মধ্যে রয়েছে ৪৫% এরও বেশি বেকারত্ব এবং ৭০% পরিবারের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা।

১৯৪৮ সাল থেকে লেবাননের ফিলিস্তিনিরা কাজ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কঠোর নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছে। তারা লেবাননের অবাঞ্ছিত জনসংখ্যা হিসেবে বিবেচিত লেবাননের গৃহযুদ্ধ এবং ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার মধ্যে সিরিয়ান-সমর্থিত মিলিশিয়া এবং অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে যুদ্ধ সহ অসংখ্য সংঘাতের একটি কারণ তারা।

স্থায়ী নির্বাসন নাকি প্রত্যাবর্তন?

বর্তমান সময়ে সবচেয়ে দীর্ঘতম ও দীর্ঘস্থায়ী উদ্বাস্তু পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে ফিলিস্তিনিরা। প্রায় ৭৫ বছর ধরে তারা তাদের দেশে ফিরে যাচ্ছে না। রাষ্ট্রহীন মানুষ হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তারা বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে।

বাসস্থান ত্যাগের সাথে সাথে তাদের দুর্দশার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যখন ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশ থেকে পালিয়ে যায় তখন তারা ভিন্ন কোনো রাষ্ট্রের জনসংখ্যায় রূপান্তরিত হয়। আর যদি এই ফিলিস্তিনিরা আবার ফেরার চেষ্টা করে তখন ইহুদি নেতৃবৃন্দ তাদের এই প্রত্যাবর্তনকে নিজেদের জনসংখ্যাগত হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।

ইহুদিরা মনে করে, ফিলিস্তিনিরা যদি নিজ ভূখণ্ডে ফিরতে তাহলে তাদের ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল হুমকির মুখে পড়বে। কারণ একচেটিয়া ইহুদি রাষ্ট্রের যে তকমা সেটি তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। আর প্রত্যাবর্তন নিয়ে এই সময়ে ইসরায়েলের সাথে ফিলিস্তিনির শান্তি চুক্তি আলোচনা কখনোই আশার আলো দেখাবে না।

(দ্য কনভারসেশন থেকে অনুবাদিত। মূল লেখক: মাইকেল ভিসেন্ট পেরেজ)

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article