27.8 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

যেভাবে আমেরিকায় ইসলামের সূচনা

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা পত্র থেকে নেয়া

Must read

অনুবাদ: সাইয়্যেদ নুরসী

আমেরিকায় ইসলামের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বেশ জটিল ও বিতর্কিত। কিছু ইতিহাসবিদ বলেন, বিখ্যাত অভিযাত্রিক ক্রিস্টোফার কলম্বাসের গমনের অনেক আগেই মুসলিমরা এই মহাদেশ আবিষ্কার করেছিলেন। ১২ শতকে মুসলিমগণ আমেরিকা আবিষ্কার করেন বলে তাদের অনুমান। অনেকের দাবি মুসলমানরা আমেরিকায় অসংখ্য ইউরোপীয় অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষ করে মানচিত্র অঙ্কন এবং ভ্রমণ গাইড হিসাবে কাজ করেছেন। ঐতিহাসিক দলিল থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, মরোক্কোর নাবিক এস্তেভেনিকো ১৫২৭ সালে আমেরিকার ফ্লোরিডায় গিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম মুসলিম যিনি আমেরিকা গেছেন বলে লিখিত প্রমাণ পাওয়া গেছে। এস্তেভেনিকো মূলত সমুদ্রযাত্রায় গাইড বা পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করতেন। ১৭ শতকের শেষদিকের কিছু ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনায় মূর (ইউরোপিয়ানরা মধ্যযুগে উত্তর আফ্রিকা ও ইবেরিয়ান পেনিনসুলার মুসলিমদের এই নামে অবিহিত করত) জাতির মুসলিমগণ বসবাস করতেন। তাদের অধিকাংশই তৎকালীন স্পেন থেকে বিতাড়িত ছিলেন।

কোন সন্দেহ নেই যে, আমেরিকায় মুসলমানদের প্রথম এবং উল্লেখযোগ্য অভিবাসন হয়েছিল দাস ব্যবসার হাত ধরে। অত্যাচার ও নিপীড়নের মাধ্যমে তিনশত বছরে প্রায় এক কোটি আফ্রিকানকে আমেরকিায় দাস হিসেবে নেয়া হয়। এদের ১০ থেকে ৫০ ভাগই ছিল মুসলিম। সে সময় আফ্রিকান ঐ দাসদের অধিকার বলতে কিছুই ছিল না। বর্বরতা ও অসহনীয় অত্যাচারের মাধ্যমে তাদের পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে দেয়া হয় এবং তাদের ধর্ম চর্চাকে নির্মূল করা হয়। নিপীড়নের মাধ্যমে মুসলমানদের খ্রিষ্টান বানানোর ঘটনা ছিল মামুলি ব্যাপার। তাদের অধিকার নিয়ে কারো মাথা ব্যথা ছিল না। অত্যাচারে প্রাণ গেলে কারো বিচার তো দূরে থাক কেউ মৃত্যুর কারণও জিজ্ঞাসা করত না। কেনা দাস, তাই তাদের সাথে যা খুশি করত। ঐতিহাসিক নথি থেকে জানা যায়, নির্মম অত্যাচার মাঝে, এমনকি ধর্মান্তরিত হয়েও অনেকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আগলে রেখেছিল। তবে এই ইতিহাসের অনেক কিছুই উদ্ধার করা বাকি। আমেরিকায় আসা প্রথম দিকের মুসলমানদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হলেও তারা প্রতিদিন সালাত আদায় করতেন, রমজানের রোজা রাখতেন এবং কোরআন তেলাওয়াত এবং অধ্যয়ন করতেন। তৎকালীন নথিপত্র, দাসদের পরবর্তী প্রজন্মের মৌখিক বিবরণ, ক্রীতদাস সম্পর্কে প্রচলিত ঘটনা এবং দাসদের লিখে রেখে যাওয়া ডায়েরিতে এ সকল তথ্য পাওয়া গেছে।

মৌখিকভাবে প্রচলিত ঘটনা ও ঐতিহাসিক প্রামানিক থেকে “বিলালিয়া ফুলা” এর জীবনী থেকে জানা যায়, ‘সি আইল্যান্ড অব জর্জিয়া’য় তাকে ক্রীতদাস হিসেবে নেয়া হয়। এ বিষয় সংশ্লিষ্ট গবেষক ড. অ্যালেন অস্টেন জানান, বিলালিয়া একাধিক ভাষা জানতেন। তিনি ১৮১২ সালে সংঘটিত ব্রিটিশ-আমেরিকান যুদ্ধের একজন বীর সৈনিক। তিনি ১৮২৪ সালের হারিকেন ঝড়ের কবল থেকে বহু মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। বিলালিয়া প্রাকটিসিং মুসলিম হিসেবে জীবন অতিবাহিত করেন। তাকে তার ব্যবহৃত জায়নামাজ ও কোরআনসহ কবর দেওয়া হয়েছে বলে কথিত আছে। তার অধিসংখ্যক সন্তানের মুসলিম নাম রেখেছিলেন। একটি নৃতাত্ত্বিক সাক্ষাৎকারে বিলালিয়ার পরিবারকে চেনেন এমন ব্যক্তিরা জানান তার পরিবার নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন।

আমেরিকান আরেকজন মুসলিম ক্রীতদাস আল হাজ ওমর ইবনে সাইদ। তিনি ১৮৩১ সালে একটি আত্মজীবনী গ্রন্থ রচনা করেন। বইটি আরবিতে লেখা। এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে জানা যায়, ওমর একজন ব্যবসায়ী, একজন সৈনিক এবং একজন বিশ্বস্ত মুসলিম ছিলেন। তিনি হজ্জ পালন করেছেন এবং কৃতদাস হিসেবে বিক্রির পূর্বে পঁচিশ বছর ধরে কোরআন অধ্যয়ন করেছেন।

আল হাজ ওমর ইবনে সাইদ: ১৮৫০। উৎস: অক্সফোর্ড আমেরিকান স্টাডিস সেন্টার।

আল হাজ ওমর ইবনে সাইদ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “খ্রিষ্টান দেশে আসার আগে, মোহাম্মদের (তার উপর শন্তি বর্ষিত হোক) ধর্মই আমার ধর্ম ছিল। তিনি আল্লাহর একজন দূত। ভোর হওয়ার আগে আমি মসজিদে হেঁটে যেতাম। হাত, পা, মাথা ও মুখ ধুয়ে নামাজ পড়তাম। পরে যোহর, আসর, মাগরিব ও এশার সালাতও আদায় করতাম। আমি প্রতি বছর সদকা করতাম। অন্যদের মত মক্কায় হজ্জ করেছি। আমি যখন দেশ ত্যাগ করি তখন আমার বয়স ৩৭ বছর। আর এই খ্রিষ্টান দেশে ২৪ বছর ধরে বসবাস করছি।”

মসজিদ ওমর ইবনে সাইদ, নর্থ ক্যারোলিনা, ফায়েটভিল সাউদার্ন অ্যাভিনিউ। প্রতিষ্ঠা: ১৯৯১। উৎস: অক্সফোর্ড আমেরিকান স্টাডিস সেন্টার।

যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার ফায়েটভিলের সাউদার্ন অ্যাভিনিউতে আল হাজ ওমর ইবনে সাইদ এর নামে একটি মসজিদ রয়েছে। এটি ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত। নাম “মসজিদ ওমর ইবনে সাইদ”। এটি প্রথম আমেরিকান মুসলমানদের পূর্বসূরিদের উত্তরাধিকারের প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এটি আমেরিকায় ইসলামের গোড়াপত্তনের সূচনার ইতিহাস সমসাময়িক আমেরিকাকে জানান দিচ্ছে।

আমেরিকায় আফ্রিকান-আমেরিকান মুসলমানদের অনেক ঘটনা কথিত আছে। তবে তথ্য-প্রমাণের আলোকে এই দুজনের উদাহরণ পেশ করা হয়েছে যা আফ্রিকান-আমেরিকান মুসলমানের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাসের বার্তা দিচ্ছে। ১৯ শতকে একজন ইউরো-আমেরিকান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার নাম মুহাম্মদ আলেকজান্ডার ওয়েব। তিনি ১৮৪৬ সালে নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে ওঠেন একজন প্রেসবিটেরিয়ান (এক ধরনের খ্রিষ্টান চার্চের সদস্যকে প্রেসবিটেরিয়ান বলা হয়) হিসেবে। আলেকজান্ডার ওয়েব ১৮৮৭ সালে ফিলিপাইনে মার্কিন দূতাবাসে কনসাল (প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা দেখভাল করে এমন কর্মকর্তা) পদে নিযুক্ত হন। তিনি ফিলিপাইনে মুসলিমদের জীবন-যাপন দেখে আকৃষ্ট হন এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি বাকি জীবন ইসলাম প্রচারে কাটিয়ে দেন। প্রতিষ্ঠা করেন আমেরিকান ইসলামিক প্রপাগান্ডা মুভমেন্ট। মুহাম্মদ আলেকজান্ডার ওয়েব ১৮৯৩ সালে একজন গর্বিত আমেরিকান মুসলিম হিসাবে শিকাগোতে ওয়ার্ল্ড’স পার্লামেন্ট অব রিলিজিয়ন্স-এ ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

 

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article