নাঈমুর রহমান রিজভী
“মোগো থাহার জমি নাই। কি করমু স্বামী-সন্তান লইয়া গাঙ্গে থাহি। মোগো যদি এউক্কা স্থায়ী থাহার জায়গা থাকতে হেলে মোগো এতো দুর্ভোগ ওইতেনা। গাঙ্গে মোরা এ্যাকছের অনিরাপদ। এইহানে এ্যাকছের অসুখ অয়, নিরাপত্তাও নাই। কিন্তু কিছু তো হরারও নাই সরকার জমি দেয়, থাহার ব্যবস্থা হইরা দেয় এসব তো মোরা পাই না। যেডিতে পায় হেডিতেই খালি পাইতে থাহে। দুন্নইতে মামু মোগোলগে কেউ নাই”। এমনিভাবেই নিজের দুর্দশাগ্রস্থ জীবনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন সুলতানা।
সুলতানা মান্তা সম্প্রদায়ের একজন সদস্য। যাদের জীবনযাত্রা অন্যান্যদের চাইতে আলাদা। নদীর বুকেই তাদের জন্ম এবং সেখানেই তাদের বাস। ঝড় বৃষ্টিকে জয় করে বছরের পর বছর নৌকাতেই ভেসে বেড়ায় তারা। ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলার বাসিন্দা হলেও বর্তমানে নৌকাই তাদের স্থায়ী আবাসস্থল। তাদের জীবন সম্পর্কে জানতে সুলতানার সাথে কথা হয় লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার মাছঘাট সংলগ্ন মেঘনার তীরে।
অধিকাংশ মান্তা সম্প্রদায়েরই বাড়িঘর, জমিজমা বিলীন হয়ে গেছে নদীগর্ভে। তাই বাধ্য হয়েই এই পথটাকে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে বেছে নেয় তারা। সুলতানার জন্মও এমন একটি মান্তা পরিবারে। নদীগর্ভে ভিটেমাটি বিলীন হয়ে যাওয়ার পর বাবা মায়ের সঙ্গে নৌকায় করে মাছ ধরতে ধরতে ছাড়তে হয় জন্মভূমি। ঠাঁই মেলে ছোট একটি ডিঙ্গিতে। যে বয়সে সহপাঠীদের সঙ্গে দাপিয়ে বেড়ানোর কথা ছিল, সেই বয়সে সংসারের বোঝা বইতে কোমল হাতে তুলে নিয়েছেন বৈঠা। এই কঠিন জীবনে সুলতানার সঙ্গী এখন আজমত আলী।
দুই ছেলে ও তিন মেয়েসহ ছোট্ট একটি ডিঙি নৌকাতেই তার সংসার। বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সুষ্ঠু পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত তারা। অভাবের তাড়নার কারণে সুলতানার ছেলে মেয়েরা পায়নি লেখাপড়ার সুযোগ। সংসারের হাল ধরতে সময়ে সময়ে তাদেরও ধরতে হয়েছে বৈঠা। বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন মান্তা পরিবারেই।
জোয়ারের সময় তারা মাঝ নদীতে যায় মাছ শিকার করতে এবং ভাটার সময় তীরে ফিরে আসেন। নদীতে মাছ শিকার করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন এবং সেখানেই মলমূত্র ত্যাগ করেন। এই নদীর পানি পান করার কারণেই বিভিন্ন সময় তাদের শরীরে ছড়াচ্ছে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন রোগ জীবাণু। যার ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি রয়েছে শিশুরা এবং নদীর তীরবর্তী সাধারণ মানুষরা। দুর্যোগের সময় দীর্ঘদিন মাছ শিকারে যেতে না পারায় তখন তাদের কাটাতে হয় অভাবগ্রস্ত জীবন। সরকারি কোনো আর্থিক সহায়তাও পায় না তারা।
সময়ের সাথে সাথে সবকিছুর পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন আসেনি মান্তাদের জীবনধারায়। সারাদিন নদীতে মাছ শিকার করে ভাটার সময় তীরে ফিরে আসায় তাদের দৈনন্দিন কর্মযজ্ঞ। তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার কারণে একদিকে বাণিজ্যিকভাবে মাছ ধরা বেড়ে গেছে, অন্যদিকে অতিরিক্ত মাছ ধরার কারণে মাছের সংখ্যাও গেছে কমে। এ কারণে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করাও দিনদিন তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।
দু:খ প্রকাশ করে সুলতানা বলেন, আমাদের স্থায়ী বলতে কিছু নেই। আজ এই তীর তো কাল ওই তীর। মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে এই একটিমাত্র নৌকাই রয়েছে। স্বামী সন্তান নিয়ে এই ছোট্ট নৌকাতেই রাত্রিযাপন করতে হয়। আমাদের যদি একটা স্থায়ী বাসস্থান থাকতো, তাহলে ঝুঁকি নিয়ে এই নদীতে বসবাস করা লাগতো না। শুনেছি সরকার নাকি মান্তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কই, আমাদের নাম তো কেউ লিস্ট করেনি। মূলত স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় অধিকাংশ মান্তা রাষ্ট্রীয় সেবা পাচ্ছে না। আমাদের জন্ম মৃত্যু সব পানিতেই। কেবল মৃত্যুর পরেই ডাঙ্গায় ঠাঁই জুটে।
ধারণা করা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও নদী ভাঙ্গনের বৃদ্ধির ফলে আরও বহু বাংলাদেশিকে জীবনযাপনের এই পথ বেছে নিতে হতে পারে। জেনেভা ভিত্তিক সংগঠন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের তথ্য মতে, ২০২০ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের ৪ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যার অন্যতম প্রধান কারণ নদীভাঙ্গন।
যদি নদী ভাঙন রোধ করা যায় এবং মান্তাদের শিক্ষা ও স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে মান্তারা তাদের অবহেলিত জীবন থেকে নিস্তার পাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।