রুদ্র ইকবাল
মানব জীবন সুখ-দুঃখের এক মিলনমেলা। প্রকৃতিতে পালা বদলের মতো মানুষের জীবনেও নিয়মিত পালা বদল হয় সুখ ও দুঃখের। কখনো ভেঙে পড়া, কখনো হতাশ হওয়া, কখনো বা আনন্দে বিমোহিত হওয়ায় আমাদের জীবন। মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ আসে প্রকৃতিতে শীতের পর বসন্ত, বসন্তের পরে গ্রীষ্ম আসার মতো। তবে দুঃখ মানুষের কাছে অভিশাপ ও আশীর্বাদ নিয়ে আসে। কিন্তু দুঃখ কখন আশীর্বাদ হয় কখনই বা অভিশাপ হয়?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখি, পবিত্র কুরআন দুঃখ কীভাবে আশীর্বাদ হয় সেই শিক্ষা মানবজাতিকে প্রদান করতেছ। পবিত্র কুরআনে সুখ-দুঃখ নিয়ে বলা হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই দুঃখের পরে সুখ রয়েছে’। ঠিক এই আয়াতের সাথে সূরা বাকারার ১৫৩ নাম্বার আয়াত মিলিয়ে পড়লে দুঃখ থেকে সুখে পৌঁছানোর, দুঃখ আশীর্বাদ হওয়ার পথ পরিষ্কার হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সহিত আছেন।’ এই আয়াত দু’টো বিষয় যথাক্রমে ধৈর্য ও সালাতের উপর গুরুত্ব করতেছে। এই আয়াত মানবজাতিকে একটা প্রক্রিয়া দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে মানুষ দুঃখ থেকে সুখের দিকে গমন করবে। বলেও দিচ্ছে, দুঃখ থেকে সুখের পথে গমন করতে হলে প্রয়োজন- সালাত ও ধৈর্য।
এবার বলতেই হয়, ধৈর্য কী?
মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি ধৈর্যকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলতেছেন, “ধৈর্য মানে শুধু বসে বসে অপেক্ষা করা নয়, ধৈর্য মানে ভবিষ্যৎকে দেখতে পাওয়া। ধৈর্য মানে কাঁটার দিকে তাকিয়েও গোলাপকে দেখা, রাতের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দিনের আলোকে দেখা।”
জালালুদ্দিন রুমির এই বর্ণনায় একটা ইঙ্গিত রয়েছে, খুব বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেও ধৈর্যের দ্বারা জীবনের গুপ্ত রহস্য দেখা ও অনুভব করা। আর এই গুপ্ত রহস্য অনুভব করতে পারলেই মানুষের সামনে দুঃখ থেকে সুখের পথে যাওয়ার উপায় উন্মোচিত হয়ে যাবে। মাওলানা রুমির এই বাণী ব্যাখ্যা করলে আরো কয়েকটা গুণ পাওয়া যাবে। ধৈর্যের মধ্যে রয়েছে অধ্যবসায়, পরিশ্রম, সাধনা ও প্রচেষ্টা যা মানুষকে কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করতে সহায়তা করবে। দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ দেখাবে। একজন ব্যক্তি বিপদে অলস হয়ে বসে না থেকে তার ভিতরের শক্তি, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম দিয়ে প্রচেষ্টা করলে সে ধীরে ধীরে কাঁটার দিকে তাকিয়ে গোলাপ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।
কাহলিল জিবরান দুঃখকে ব্যাখ্যা করেছেন আরো অতীন্দ্রিয় ভাবে। দুঃখকে বেদনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করতেই তিনি রাজি নন। দুঃখ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে জীবনকে গ্রহণ করতে উল্লেখ করেন। তার কবিতায় তিনি উল্লেখ করেন, জীবন হলো- হাসি ও অশ্রুর সমন্বয়। আমাদের অশ্রু আমাদের হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করে এবং উপলব্ধি করায় জীবনের গোপন সব রহস্য।
ধৈর্যকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ণনা করতেছেন তার একটি কবিতায়,
‘বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে
নাই বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কবিতায় সাবলীলভাবে বলে যাচ্ছেন বিপদ যেন ভয় কাবু করতে না পারে। ভয়ের পরিবর্তে দুঃখ যেন জয় করতে পারে, যেন ভেঙে না পড়ে এই প্রার্থনায় কবির। মানব জীবনে নিয়মিত বিপদ আসে, মানুষ তার সম্মুখীন হওয়ার পরিবর্তে ভয়ার্ত হয়ে পড়ে। এই সুন্দর শ্লোক ধৈর্যের দ্বারা দুঃখ/বিপদ উদ্যাপনের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে।
দুঃখ থেকে আনন্দ যে পথের গন্তব্য সে পথে ধৈর্যের পরে আরেকটি বিষয় রয়েছে তা হলো- সালাত। সালাত কী?
সালাতকে এককথায় বললে, সালাত হলো- খোদায়ী স্মরণ। জীবনের প্রতি মুহূর্তে খোদাকে স্মরণ রাখায় সালাত। ধৈর্যের সাথে বিপদের মোকাবেলা করার সময় সালাত’ই নৈতিকভাবে হৃদয়কে পরিশুদ্ধ রাখে, ভেঙে পড়া থেকে রক্ষা করে। কারণ সালাত এই বিষয় উপলব্ধি করায় যে, হৃদয়ে স্রষ্টার উপস্থিতি সমস্ত ধরনের বিপদে স্থির থাকার এবং ভেঙে না পড়ার উৎসাহ। স্রষ্টা কোন না কোন উপায়ে উদ্ধার করবেন এই চিন্তা সালাতের অংশ।
মূলত ধৈর্যের দ্বারা প্রচেষ্টা ও সালাতের দ্বারা খোদায়ী স্মরণই দুঃখের প্রতিকার । যারা ধৈর্য ও সালাত দিয়ে দুঃখ উদ্যাপন করতে পারে না তাদের জন্যই দুঃখ অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।