28 C
Dhaka
Saturday, June 28, 2025

নাইন্টিন এইটি ফোর:একটি ডিস্টোপিয়া ও বর্তমানের রূপরেখা

Must read

আনিসুর রহমান

ধরুন, আপনাকে এমন একটি দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো যেখানে দুইটি চোখ আপনাকে সবসময় নজরদারিতে রাখছে। সেখানে আপনার বাক্‌স্বাধীনতাকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এমনকি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে আপনার চিন্তাকেও। আপনার চিন্তাকে রিড করার জন্য প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে লাগানো হয়েছে যন্ত্র। এমনকি মোড়ে মোড়ে টহল দিচ্ছে পুলিশ। ধরুন, আপনাকে বলা হলো ২+২=৫। কিন্তু এটা মিথ্যা জেনেও মেনে নিতে হবে। না মানলে আপনাকে দেওয়া হবে মৃত্যুদণ্ড। প্রতিদিন নিয়ম করে একটা সময়ে গাইতে হবে দেশ প্রধানের গুণগান। বিপরীতে গালাগাল দিতে হবে দেশের শত্রুদের। আপনি কি এসবের বিদ্রোহ করবেন? নাকি চোখ বুজে মেনে নিবেন?

হ্যাঁ, এমনি একটি দেশকে কেন্দ্র করে ১৯৪৯ সালে ‘জর্জ অরওয়েল’ নিজের ‘ম্যাগনাম অপাস’ হিসেবে লিখেছিলেন দূর ভবিষ্যতের চিত্রিক উপন্যাস “নাইন্টিন এইটি ফোর”। ভিক্টর গোলাঞ্জের তত্ত্বাবধানে ১৯৪৯ সালের ৮ জুন প্রকাশিত হয় অরওয়েলের সর্বশেষ ও বিখ্যাত এই সাহিত্যকর্মটি। এই উপন্যাসটিকে বলা হয় বিশ শতকের লেখা ডিস্টোপিয়ান ধারার অন্যতম শক্তিশালী উপন্যাস। এই সাহিত্যকর্মটি যখন প্রকাশিত হয়, সেই সময় পুরো বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধ নামক এক অভিনব রাজনৈতিক যুদ্ধে মেতে উঠেছিলো। তখন এই উপন্যাসে বর্ণিত ১৯৮৪ সাল হয়ে উঠেছিল এক অদূর ভবিষ্যতের আগাম সতর্কবাণী।

তার আগে চলুন জেনে নিই ডিস্টোপিয়া আসলে কী? ডিস্টোপিয়া হলো একটি ইংরেজি শব্দ। যার মানে হলো একটি কাল্পনিক রাষ্ট্র বা সমাজ যেখানে মহান যন্ত্রণা বা অবিচার আছে। অরাজকতার সমাজও বলা যায়।

এবার আসুন মূল আলোচনায় আসা যাক। উপন্যাসটিতে মূল চরিত্র হিসেবে দেখানো হয় ‘আউটার পার্টি’র সদস্য হিসেবে ‘ট্রুথ অফ মিনিস্ট্রি’ এর রেকর্ড বিভাগে সরকারি নথিপত্র সংশোধন এবং পুনর্লিখনের কাজে কর্মরত উইন্সটন স্মিথকে। উপন্যাসটিতে দেখানো হয় তিন ভাগে বিভক্ত একটি পৃথিবীকে। ওশেনিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং ইউরেশিয়া নামক তিনটি সাম্রাজ্য একে অপরের সাথে বছরের পর বছর ধরে এক অমীমাংসিত যুদ্ধে লিপ্ত। ওশেনিয়ায় সর্ব ক্ষমতার অধিকারী সরকার বিগ ব্রাদার নামে পরিচিত। উইন্সটন স্মিথ সহ সরকারি অফিসের সকল কর্মকর্তা থাকে তাদের নজরদারিতে। অফিস, বাসা-বাড়ি, ক্যাফেটেরিয়া, পথঘাট সর্বত্র নজরদারির জন্য লাগানো আছে ‘টেলি স্ক্রিন’। তাদের নজরদারির কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য সব জায়গায় ভেসে উঠে- “বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ”।

ওশেনিয়ার জনগণকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে- পার্টির অভ্যন্তরীণ সদস্য (ইনার পার্টি), কর্মজীবী মানুষ (আউটার পার্টি) এবং শ্রমজীবী মানুষ (প্রোল)। এই শ্রেণি ভাগের মাধ্যমে গড়ে উঠে এক অসম সমাজ ব্যবস্থা। সম্রাজ্যের প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষ ছিল শ্রমজীবী সমাজের। তারপর অবস্থান কর্মজীবী মানুষ। প্রায় ১২ শতাংশ এদের অবস্থান। আর মাত্র ২ ভাগ হচ্ছে পার্টির অভ্যন্তরীণ সদস্য।

দলটি মোট চারটি আলাদা মন্ত্রণালয় স্থাপন করা হয়েছে সাম্রাজ্যের সাধারণ জনগণকে আয়ত্তে রাখার জন্য। ‘মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথে’র অধীনে সংবাদ, বিনোদন, শিক্ষা ও চারুকলা। ‘মিনিস্ট্রি অব পিস’ এর অধীনে কেবলই যুদ্ধ। ‘মিনিস্ট্রি অব লাভ’ এর অধীনে আইন-শৃঙ্খলা। এবং ‘মিনিস্ট্রি অব প্লেন্টি’র অধীনে অর্থ সম্পর্কিত বিষয়। এরা বিভিন্নভাবে জনগণকে মুক্ত চিন্তা এবং বুদ্ধি বিকাশ থেকে বিরত রেখে গোড়াপত্তন করে এক পঙ্গু মানব সমাজের। সেখানে সর্বত্র বিরাজমান আছে ‘থট পুলিশ’। যদি কেউ মুক্ত চিন্তা করে তাহলে তাকে তারা হত্যা করে। সমাজের মানুষদের কুক্ষিগত করে রাখার জন্য বিভিন্ন স্থানে লেখা থাকে- “ওয়ার ইজ পিস, ফ্রিডম ইজ স্লেভারি, ইগনোরেন্স ইজ স্ট্রেনথ”। এমনকি সাধারণ মানুষদের ” টু প্লাস টু ফাইভ” এমন মিথ্যা মেনে নিতে বাধ্য করা হয়।

এমন একটি সমাজ ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে বিষয়ে উঠতে থাকে উপন্যাসের নায়ক উইন্সটনের মন। সে উপায় খুঁজে এই স্বৈরাচারী ব্যবস্থা থেকে বাঁচতে। তার মন এসবের বিদ্রোহ করা শুরু করে। গোপনে জড়িয়ে পড়ে আন্দোলনে। এরই মাঝে তার পরিচয় হয় জুলিয়া নামের তার একজন সহকর্মীর সাথে। সেও ছিল এসবের বিরুদ্ধে। একটা সময় তারা প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ে। জুলিয়া হয়ে পড়ে তার আন্দোলনের বাতি। যা তাকে আরো কঠিন ও গভীর আন্দোলনে সোচ্চার হতে সাহায্য করে। আর এই নতুন জীবনে তার সাথে ঘটতে থাকলো দমবন্ধ করা সব ঘটনা। যা আপনাকে আটকিয়ে রাখবে একটি প্রশ্নে- “তারা কি পারবে বিগ ব্রাদারদের পতন ঘটাতে?” এই প্রশ্নের উত্তর পেতে পড়তে হবে উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত।

প্রথমেই বলেছি “নাইন্টিন এইটি ফোর” একটি ডিস্টোপিয়ান ঘরানার উপন্যাস। তো ডিস্টোপিয়া কী এবং ডিস্টোপিয়াতে মানুষের চিন্তা ও চেতনাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় সে বিষয়ে একটু পর্যালোচনার প্রয়োজন।

মহাভারতের রাম রাজত্বের মতো আদর্শ কোনো রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন, সেই ব্যাপারকে যেমন ‘ইউটোপিয়া’ বলে ডাকা হয়। তেমনই রাবন রাজত্বের বিপরীত ধারণাটাই ‘ডিস্টোপিয়া’। আরেকটু ভেঙে বললে, সক্রেটিস যখন তার আদর্শ রাষ্ট্র ধারণার (ইউটোপিয়া) কথা বলেছিলেন, সেটার ভিত্তি হিসেবে তিনি রেখেছিলেন ন্যায়বিচারকে। ইউটোপিয়ান রাষ্ট্র মানেই সেখানে সর্বাবস্থায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। ইউটোপিয়ার বিপরীত ধারণা হিসেবে ডিস্টোপিয়া তাই এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলে, যেখানে গোটা বিচারব্যবস্থাটাই ন্যায়ের বদলে অন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত, বিচার যেখানে প্রহসন।সেখানে দুর্নীতিগ্রস্ত অথবা সর্বগ্রাসী সরকার, পরিবেশগত বিপর্যয়, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও এর নিয়ন্ত্রণের কারণে মনুষ্যত্বের সংকট, অনিয়ন্ত্রিত সহিংসতা, সীমিত সম্পদ ইত্যাদি সহ সবকিছুই ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে। মানুষ হয়ে পড়ে অসহায়। নিয়ন্ত্রণের নিয়ন্ত্রণের তথ্যের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা এককথায় সকল মৌলিক স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধতার মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ক্ষমতায় থাকা দল নানা রকম আইন, হুমকি ও গুমের মতো অবৈধ শক্তির মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়াও সমাজে মানুষের চিন্তাকে কর্পোরেশন, মিডিয়া ও পণ্যের মাধ্যমে ম্যানিপুলেট করে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

তো একটি প্রশ্ন আসে যে ১৯৪৮ সালে লিখিত ‘১৯৮৪’ কী কোনো ভাবে ২০২৩ কে প্রতনিধিত্ব করছে? হ্যাঁ। উপন্যাসটিতে অরওয়েলের সৃষ্টি করা ওশেনিয়ার সাথে বর্তমান বিশ্বের বাস্তব রূপরেখা ফুটে উঠেছে। কয়েকটি পয়েন্ট তুলে ধরা যাক।

প্রথমত: বর্তমানে স্যাটেলাইট, মোবাইল ফোন, স্মার্ট ওয়াচ, থার্মোস্ট্যাট, টোস্টার সহ সকল প্রযুক্তির ব্যবহার যেন অরওয়েলের ওশেনিয়ায় ব্যবহৃত ‘টেলি স্ক্রিন’। এই নজরদারি যন্ত্র ওশেনিয়ার জনগণের জন্য যতটা না ক্ষতিকর ছিল তার চেয়ে শতগুণ বেশি ভয়াবহ আমাদের বর্তমান বিশ্বের জন্য। “নাইন্টিন এইটি ফোর” বইতে রাষ্ট্রই তার নজরদারির সাম্রাজ্যকে কাজে লাগাতো শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে। অন্যদিকে বর্তমানে এই ভূমিকা পালন করছে প্রাইভেট কোম্পানিগুলো। গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফট, অ্যাপলের মতো কোম্পানিগুলো জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাদের নজরদারি করে।

দ্বিতীয়: জর্জ অরওয়েলের কল্পনার সমাজে ‘চিন্তা অপরাধ’ (ক্রাইম থট) থেকে মানুষকে মুক্ত রাখতে চেষ্টা করা হতো। বর্তমান সময়ও এর ব্যতিক্রম নয়। ডিজিটাল আইন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ফলে তৈরি হচ্ছে একটি অসুস্থ জাতি।

তৃতীয়: অরওয়েলের কল্পনার ওশেনিয়ায় অভ্যন্তরীণ (ইনার পার্টি) মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত ও বৈষম্যের শিকার হতো প্রোল (শ্রমজীবী) সম্প্রদায়ের মানুষ। বর্তমানেও পৃথিবী এর ব্যতিক্রম নয়। দেশে দেশে নির্যাতিত হচ্ছে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণি। আর তাদের অত্যাচার চালাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের কুকুর নামক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অন্যদিকে ওশেনিয়ার মতো ব্যবসায়িক শ্রেণি সকল সুবিধা ভোগ করছে।

চতুর্থত: ওশেনিয়ায় রাজত্ব ছিল বিগ ব্রাদারদের। তারা স্বৈরশাসনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ওশেনিয়াকে জাহান্নামে পরিণত করেছিলো। ঠিক এমন একটি সমাজব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। ক্ষমতাসীন দলগুলো হয়ে উঠেছে অরওয়েলের বিগ ব্রাদার। যে প্রতিবাদ করছে তাকেই গুম কিংবা হত্যা করা হচ্ছে। বোমার আঘাতে ছিন্ন করছে পৃথিবী।

“নাইন্টিন এইটি ফোরে” এমন আরো অনেকে বিষয় রয়েছে যা সরাসরি বর্তমান সময়কার পৃথিবীকে প্রতিনিধিত্ব করে। সর্বোপরি, আমরা এখন দিনে দিনে এগিয়ে চলেছি আরও বেশি সেন্সরশিপ আর নজরদারির অরওয়েলীয় পৃথিবীর দিকে। ১৯৮৪ সালে না হলেও এর ৩৯ বছর পরে এসে এই ২০২৩ সালে আমরা অরওয়েলীয় পৃথিবীতেই বসবাস করছি।

লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article