রুদ্র ইকবাল
বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী পর্যন্ত আত্মহত্যামুখী হয়ে উঠতেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা এক চাঞ্চল্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও কোন বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর প্রত্যাশিত ফলাফল না পেলে মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা নির্দ্বিধায় আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখে যাচ্ছে ‘সুইসাইড নোট’।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, কেন শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা প্রবণ হচ্ছে? কোন কোন জিনিস আত্মহত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করে? এই ব্যাধি থেকে উত্তরণের উপায়ই বা কী?
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণ হওয়ার পেছনের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গেলে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম ‘আত্মহত্যা’ নিয়ে যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন তার দিকে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি আত্মহত্যাকে একটি সামাজিক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেন।
এমিল ডুর্খেইম আত্মহত্যাকে চারভাগে ভাগ করেন এর মধ্যে দুইটি দিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যাকে ব্যাখ্যা করা যায়। ডুর্খেইমের চারটি প্রকারের মধ্যে একটি- ‘তাগদিরবাদীতা(Fatalistic), এই স্তরে সমাজ কাঠামো একজন ব্যক্তির অবস্থানকে চূড়ান্ত ভাবে নাকচ করে সমাজের বিকাশ চায়। ব্যক্তিকে চরম পর্যায়ের শোষণ করে। এখানে ব্যক্তি তার নিজস্ব জীবনের কোন আশা দেখে না। সমাজ কাঠামোকে ভাঙার সাহস বা পথও খুঁজে পায় না, তখন এই মানসিকতার চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যক্তি আত্মহত্যা করে।’ ডুর্খেইমের এই তত্ত্বকে শিক্ষার্থীদের অবস্থার আলোকে ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, একজন শিক্ষার্থী যখন সমাজ, মা-বাবার প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয় তখন তার উপর চূড়ান্ত ভাবে মানসিকভাবে অত্যাচার শুরু হয়, ঐ শিক্ষার্থীর মতামত প্রকাশের কোন সুযোগ থাকে না। সমাজের লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এক সময় সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এক্ষেত্রে সমাজ, পরিবার আত্মহত্যার কারণ হয়ে উঠে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে সে তার স্বামীর জোর-জবরদস্তি সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
ডুর্খেইমের আরেকটা পর্যায় হলো, বিচ্ছিন্নতা বোধ(Anomic) থেকে আত্মহত্যা। ‘এই স্তরে ব্যক্তি সমাজ কাঠামোর নির্ধারিত পদ্ধতি মেনে জীবন পরিচালনা করতে যায়, করেও। কিন্তু শেষমেষ তার জীবনের কোন বিকাশ সাধিত হয় না। জীবনের অর্থ খুঁজে পায় না। সে তখন জীবনের চূড়ান্ত নীতি নৈতিকতা নিয়ে, ভালো মন্দ নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। এর ফলে ব্যক্তি বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে সবকিছুর সাথে। এর চূড়ান্ত পরিণতি আত্মহত্যা হয়।’ এই স্তরের আত্মহত্যা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন একটা নির্ধারিত সিলেবাসে পড়াশোনা করার পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে সে এসব পড়াশোনার প্রয়োগের কোন জায়গা খুঁজে পায় না। চার-পাঁচ বছরের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর জীবন শেষে চাকরি না পাওয়ার হতাশা সমাজ থেকে চরমভাবে বিচ্ছিন্ন করে তুলে। দীর্ঘসময় একটা বিষয়ের উপর খাপ খাইয়ে নেওয়ার পর সে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পূর্বে কিছু মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়াকে বড় ধরনের সফলতা ও প্রত্যাশার স্বর্গরাজ্য হিসেবে উপস্থাপন করে তোলে ফলে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই শিক্ষার্থীরা কল্পনার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এক নতুন জগৎ সৃষ্টি করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর দেখে, যে প্রত্যাশা নিয়ে তারা ভর্তি হয়েছে তার কোন কিছুই সৃষ্টি করা থাকে না বরং নানা চড়াই-উৎরাই পার করার মধ্য দিয়ে দিন পার করা লাগে শিক্ষার্থীদের। প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির মিল না হলে শিক্ষার্থীরা এক সময় আত্মহননের পথকেই মুক্তির পথ হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।
একজন আত্মহত্যা করা ব্যক্তির ‘সুইসাইড নোট’ অন্যজনকে আত্মহত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করে। একজন মানুষ জীবন অতিক্রম করার পথে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়, আত্মহত্যা করা কোন ব্যক্তির সুইসাইড নোট পড়ার পর কোন শিক্ষার্থী বিপদের সম্মুখীন হলে তা কাটিয়ে উঠার পরিবর্তে ঐ নোট থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একইভাবে আত্মহননের পথে এগিয়ে যায়। এছাড়াও আত্মহত্যাকারীর জন্য অন্যান্য মানুষের বিলাপ আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় লালন করা কাউকে আত্মহত্যা প্রবণ করে তোলে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটা খারাপ দিক হলো মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় না। মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয় কোন পর্যায়েই মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গুরুত্ব দিয়ে কোন পাঠ্যসূচি নেই। জীবনের চলার পথে মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়, এটা প্রকৃতির নিয়ম। মানুষের শরীর ও মন দুটোই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানসিক ভারসাম্যের উপর গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদান শুরু হলে শিক্ষার্থীরা অবসাদগ্রস্ত অবস্থায়, হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় আত্মহননের পথ বেছে না নিয়ে কীভাবে কাটিয়ে উঠবে তার পথ খুঁজবে।
শহর অঞ্চলে অনেক শিশু-কিশোর মা-বাবার স্নেহ বঞ্চিত হয়ে পড়ে। একটি পরিবারে মা-বাবা যখন তাদের সন্তানকে পরিমিত সময় প্রদান করে না তখন সন্তানেরা মানসিকভাবে একা হয়ে পড়ে, চারপাশ থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে, অনেক সময় খেলার সাথীদের সাথে মিশে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, শুরু হয় অবসাদ ও হতাশা। এই হতাশা এক সময় রূপ দেয় আত্মহত্যায়। কিশোরদের মধ্যে আত্মহত্যা রোধ করতে প্রয়োজন পরিবারের সময় প্রদান ও পরিচর্যা করা।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার মূলে রয়েছে সামাজিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, পারিবারিকসহ নানা কারণ। তবে প্রায় আত্মহত্যা কেন্দ্রীভূত হয় ব্যক্তির প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির মিল না হলে। আত্মহত্যা কী একমাত্র সমাধান?
আত্মহত্যা প্রবণ হওয়ার যেমন নানা কারণ রয়েছে ঠিক একইভাবে আত্মহত্যার ব্যাধি থেকে বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিরও বিভিন্ন পথ রয়েছে। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রচার ও প্রসার আত্মহত্যা রোধে বিরাট এক খুঁজবে পালন করতে পারে। প্রত্যেক ধর্ম আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ করেছে, ঘোষণা করেছে মহাপাপ হিসেবে। অনেক দার্শনিক আত্মহত্যাকে বিভিন্নভাবে নিন্দনীয় কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হতাশা ও একাকিত্ব মানুষকে আত্মহত্যা প্রবণ করে তোলে। এর থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন সঙ্গী/বন্ধু/পরিবারের মানসিক সাহায্য যারা ব্যর্থতায় দোষ না চাপিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করবে, সাহায্য করবে, সান্ত্বনা দিবে। মানুষ যখন সবার সাথে মিশতে থাকে তখন ধীরে ধীরে আত্মহত্যার চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসে। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মানসিক স্বাস্থ্যের উপর জোর দিয়ে বিশেষজ্ঞ কর্তৃক বিভিন্ন সেমিনারের আয়োজন করা। শিক্ষার্থীরা তাদের নির্দিষ্ট একটা কারণে আত্মহত্যা করার জেদ মাথায় প্রবেশ করায়, আত্মহত্যা থেকে ফিরিয়ে জীবন উপলব্ধি করাতে পারলেই তারা জীবন উপভোগ করবে আত্মহননের পরিবর্তে।
লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়