উপনিবেশ দেশগুলো থেকে ব্রিটিশদের নেওয়া সবচেয়ে দামী ৯টি জিনিস

মাহমুদুল হাসান:

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ইতিহাসের ধারক। একটি জাতির অতীত সামাজিক, রাজনৈতিক, ও অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল তা বর্তমান প্রজন্মকে জানায় এই নিদর্শনসমূহ। তাই এমন মূল্যবান রত্ন সমূহ চুরি করা আর একটি জাতির ইতিহাস চুরি একই কথা। সভ্যতা ও নৈতিকতার বুলি আওড়ানো ব্রিটিশরা উপনিবেশ শাসনের নামে নৃশংসতা ও লুটতারাজ চালিয়েছে। সে সময় অঞ্চলটি থেকে নানাবিদ মূল্যবান সম্পদ কেড়ে নিয়েছে তারা। বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের চুরি করা সবচেয় মূল্যবান নয়টি প্রত্নতাত্মিক নিদর্শন ও সম্পদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে তুলে ধরা হল।

১- কোহিনূর হিরা
কোহিনূরের কাহিনী সবারই কম-বেশি জানা। এখন সংরক্ষিত আছে লন্ডন টাওয়ারের জুয়েল হাউসে । কোহিনূর বিশ্বের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে বিখ্যাত হীরার একটি । চাকচিক্য আর বিশালত্বে মুগ্ধ হয়ে হিরা বিশেষজ্ঞরা নাম দিয়েছেন-আলোর পাহাড়। ওজন ১০৫ দশমিক ৬ মেট্রিক ক্যারেট বা ২১ দশমিক ৬ গ্রাম। কেটে নতুন আকৃতি দেয়ার আগে প্রকৃত ওজন ছিল ৭৯৩ ক্যারেট। এটির সন্ধান মেলে বর্তমান অন্ধ্র প্রদেশের কোল্লুর খনিতে।

ইতিহাস ঘেটে দেখা গেছে। ঐশ্যর্য ও ক্ষমতার প্রতীক ছিল কোহিনূর। তাই এটি দখলে হয়েছে নানান টানাহেঁচড়া। এখনও চলছে। নিজেদের দাবি করে লন্ডনের কাছে ফেরত চেয়েছে ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, এবং ভারত। কোহিনূর প্রথমে ভারতের মালওয়ার অঞ্চলের রাজাদের হাতে ছিল। পরে তা মোগল সম্রাটদের দখলে আসে। তাই একসময় সম্রাট শাহজাহানের ময়ূরসিংহাসনের শোভা বর্ধন করতো। মোঘল সাম্রাজ্য যখন ধ্বংসের মুখে তখন ইরানের নাদির শাহ এর সাহায্য চায় তারা। মুসলিম শাসনকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্যও করেছিলেন নাদির শাহ। কিন্তু যথার্থ বিনিময় পাননি মুঘলদের থেকে। এ জন্য কৌশলে জব্দ করে কোহিনূর নিয়ে যান ইরানে। কোহিনূর নামটিও দেন তিনি। নাদির শাহ এর মৃত্যুর পর আফগান সম্রাট হুমায়ুন পুত্রের হাত হয়ে আবার ভারতের পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিং এর করায়ত্ব হয় কহনিূর। তার হিরা-জহরতে মহব্বত কম থাকায় সিংহাসন, মুকুট বা আংটিতে না লটকিয়ে এটি উইল করে দেন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে। কিন্তু একটি যুদ্ধে শিখ সাম্রাজ্য দখল করে ব্রিটিশরা। আরেক চুক্তির আওতায় লর্ড ডালহৌসি কোহিনূরসহ মহারাজার যাবতীয় সম্পদ সমর্পণ করে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার কাছে। রাণী ১৮৫২ সালে হিরাটির আকার পরিবর্তন করেন। প্রথমে তার আংটিতে গেঁথে রেখেছিলেন। পরে হয়ত ভেবেছিলেন এত সনামধন্য জহরত একটু সম্মানের সাথে রাখি- তাই স্থান দেন তার মুকুটে। মজার খবর হল- এটাকে পুরুষ অধিপতিদের জন্য অভিশপ্ত রত্ন মনে করা হতো। কারন কহিনূর যে রাজাদের অধীনে ছিল তারা সবাই ধ্বংস হয়েছে। তাই রাণী ভিকটোরিয়া আইন করেছিলেন যে, শুধু ব্রিটেনের রাণীরাই এই হিরা ব্যবহার করতে পারবে, রাজারা নয়। তবে এখন হিরাটি আছে প্রদর্শনীতে।

২- টিপু সুলতানের আংটি
মহীশূরের শাসক ছিলেন টিপু সুলতান।  ১৭৯৯ সালে ব্রিটিশদের কাছে একটি যুদ্ধে হেরে যান। উপনিবেশিক শাসকরা তার তলোয়ার এবং আংটি ছিনিয়ে নেয়। তলোয়ারটি যদিও ভারতে ফেরত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আংটিটি ২০১৪ সালে ব্রিটিশরা পৌনে দুই কোটি টাকায় নিলাম করেছিল। রত্নখচিত আংটিটিতে হিন্দু দেবতা রামের নাম খোদাই করা আছে।

ছবি: টিপু সুলতানের আংটি, সূত্র: ইন্টারনেট

৩- সম্রাট শাহজাহানের পানপাত্র
এটি সাদা জেড পাথর দিয়ে তৈরী। মুঘল সম্রাট শাহজাহান পান করতের এই কাপে। কাপটির গঠনশৈলী অত্যন্ত চিত্মার্ষক। নীচে খোদাই করা একটি পদ্মফুল। ধারক অংশে বাসকপাতার কারুকাজ। হাতলে খোদাই করা শিং-দাড়িসহ একটি ছাগলের মাথা। ১৯ শতকে কর্নেল চার্লস সেটন গুথরিকাপটি চুরি করে ব্রিটেনে পাঠিয়েছিলেন। ১৯৬২ সাল থেকে এটি লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এবং অ্যালবার্ট জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

ছবি: সম্রাট শাহজাহানের পানপাত্র, সূত্র: ইন্টারনেট

৪- রোসেটা স্টোন (শিলালিপি)
রোসেটা স্টোন হল একটি বেসাল্ট ব্লক (আগ্নেয়শিলার খণ্ড)। এটি ১১৪ সেমি উচ্চ এবং ৭২ সেমি চওড়া। ১৯৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৩টি মিশরীয় ভাষার মিশেলে ফারাও টলেমি এই শিলালিপিটি তৈরি করেন। মিশরীয় প্রাচীন সাংকেতিক লেখার পাঠোদ্ধারে এর ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এটি হায়ারোগ্লিফিক, ডেমোটিক মিশরীয় এবং গ্রক লিপিতে মিলিত শিলালিপি বহন করে।

ছবি: রোসেটা স্টোন, সূত্র: ইন্টারনেট

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট মিশরে ১৭৯৯ সালে একটি অভিযান চালন। সে সময় ফরাসি অফিসার পিয়ের-ফ্রাঁসোয়া বাউচারড দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় রোসেট শহরে পাথরটি প্রথম আবিস্কার করেন। তাই নাম হয়েছে রোসেটা স্টোন। ১৮০০ শতকের গোড়ার দিকে ফরাসিদের পরাজয়ের পর এটি ব্রিটিশরা দখল করে। মিশর শিলালিপিটি ব্রিটেনের কাছে ফেরত চেয়েছে, এ নিয়ে দ্বন্দ্বও চলছে। এখন এটি লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে।

৫- হেভিয়া ব্রাসিলিয়েনসিস এর বীজ
হেভিয়া ব্রাসিলিয়েনসিস হলো রাবার গাছের বৈজ্ঞানিক নাম। এই গাছের বীজই হল অন্যতম মূল্যবান সম্পদ যা আছে লন্ডন জাদুঘরে আছে। ভাবছেন, রাবার গাছের কয়টি বীজের এত দাম কেন? আসলে দাম বীজের নয়, ইতিহাসের। এগুলো চুরি করা ও এর সাথে জড়িত ঘটনাই এই ঐতিহাসিক মূল্য সৃষ্টি করেছে।

ছবি: হেভিয়া ব্রাসিলিয়েনসিস এর বীজ, সূত্র: ইন্টারনেট

হেনরি উইকহ্যাম একজন ব্রিটিশ অভিযাত্রী । ১৮৭৫ সালে ব্রাজিলের সান্তারেম অঞ্চল থেকে প্রায় ৭০ হাজার বীজ চুরি করেন। বপন করা হয় লন্ডনের কিউ এলাকায় রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনে। এই গাছ প্রায় ১৪০ ফুট লম্বা হয়। চুরির ঘটনায় ব্রাজিলের রাবার নির্ভর অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে। কারন ব্রিটেন নিজ দেশেই রাবার উৎপাদন শুরু করে। তবে ব্রিটিশদরে উপরেও চোরের তকমা লেগে যায় ঐ ঘটনায়। দক্ষিণ আমেরিকায় অভিযাত্রিক উইকহ্যাম “বায়ো-পাইরেট” বা  উদ্ভিদ-চোর ডাকনাম অর্জন করেন।

৬- বেনিন ব্রোঞ্জ
বেনিন ব্রোঞ্জ হলো এক শ্রেণির ছোট ছোট ভাস্কর্য়। ১৩ শতকে বেনিনের ইডো সম্প্রদায়ের শিল্পীরা ব্রোঞ্জে খোদাই করে এ ভাস্কর্য তৈরি করে। তৎকালীন আফ্রিকার বেনিন রাজ্য এখন নাইজেরিয়া। ১৯৮৭ সালে ব্রিটিশরা বেনিন আক্রমণ করে।

ছবি: হেভিয়া ব্রাসিলিয়েনসিস এর বীজ, সূত্র: ইন্টারনেট

চুরি করে ২০০ টিরও বেশি ভাস্কর্য। এর মধ্যে আলোচিত বেনিন ব্রোঞ্জ রাখা আছে ব্রিটিশ যাদুঘরে। বাকিগুলো স্থান পেয়েছে ইউরোপের অন্যান্য দেশে।

৭- ইথিওপিয়ান পাণ্ডলিপি
ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে ইথিওপিয়ার ১২টি ধর্মীয় পাণ্ডলিপি আছে। এতে দেখানো হচ্ছে ইথিওপিয়ার তেওয়াহেডো চার্চের চিত্রকর্ম, ফন্ট আর্ট এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য। অর্থমূল্যে এগুলোর বিচার চলে না। ধর্মীয় ইতিহাস বহনকারী এই পাণ্ডলিপিগুলো আধুনিক নানাবিদ গবেষণায় কাজে লাগছে।

ছবি: ইথিওপিয়ান পাণ্ডলিপি, সূত্র: ইন্টারনেট

এগুলো ছিনিয়ে নিতেই ১৮৬৯ সালে ইথিওপিয়ার সাথে যুদ্ধ করেছিল ব্রিটেন, যা ম্যাগডালার যুদ্ধ নামে পরিচিত। পাণ্ডলিপিগুলো ফেরত নিতে ইথিওপিয়া বেশ আইনী চেষ্টাও চালিয়েছে, তবে সফল হয়নি।

৮- এলগিন মার্বেলস
লর্ড এলগিন নামে এক ব্রিটিশ কূটনীতিক ১৮০৩ সালে গ্রিসের এথেন্স থেকে এই পাথরে খোদাইকৃত ভাস্কর্যগুলো লন্ডনে নেন। তাই এর নাম এলগিন মার্বেলস। এগুলো মূলত ২ হাজার ৫০০ বছরের পুরানো (স্মৃতিস্তম্ভ) পার্থেনন দেয়ালের অংশ। যার অবস্থান এথেন্সে। এগুলোর নকশা খোদাই করেন গ্রীক ভাস্কর ফিডিয়াস। ঐতিহাসিক এ নিদর্শনগুলো ব্রিটিশ ক্যূটনীতিক এলগিন চুরি করেছে বলে অভিযোগ গ্রিসের। দফায় দফায় ফেরতও চেয়েছে।

ছবি: এলগিন মার্বেলস, সূত্র: ইন্টারনেট

এলগিন অবশ্য দাবি করেছেন সে এথেন্সের অনুমতি নিয়েই এগুলো সরিয়েছেন। তবে কোন স্বাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেনি। আবার নির্শনগুলো ফেরতও দেয়নি। বরং ব্রিটিশ মিউজিয়ামে নিজেদের সম্পদ হিসেবেই প্রদর্শন করছেন তারা।

৯- অমরাবতী মার্বেল
ভারতের বিখ্যাত অমরাবতী ভাস্কর্যের ৭০টি খণ্ড অমরাবতি মার্বেলস নামে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।

ছবি: অমরাবতী মার্বেল, সূত্র: ইন্টারনেট

ব্রিটিশরাই ১৪০ বছর আগে প্রত্নতাত্মিক স্থান খনন করে এগুলো সংগ্রহ করে। পরে ১৮৫৯ সালে ভারতের মাদ্রাজ থেকে জাহাজে করে লন্ডনে নেয়া হয়।

উৎস: ইন্ডিয়াটাইমস
ভাষান্তর: সাবেক গণমাধ্যমকর্মী।

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version